অমিতাভ দাস । কবি , গল্পকার ও প্রাবন্ধিক । অবগুণ্ঠন সাহিত্য পত্রের সম্পাদক । প্রকাশিত বই ২৪টি । সদ্য প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ " বিষাদ-সুন্দরী ও লালপদ্ম " । পেয়েছেন নানা পুরস্কার ও সম্মান ।
সিগারেট
বিষয়টা যখন পছন্দ হল , তখপ মন ও আঙুল আপন ইচ্ছেতেই কী বোর্ডে হাত চালাল । বললে , এই তো বিষয় — লিখতে হবে , লিখতে হবে ।
সিগারেট আর লিকার চা প্রতিদিনের যাপনের সঙ্গী ।তা নিয়ে লিখব না ! কিন্তু সমস্যা হল কী লিখব ! কে যেন কানে কানে বললে , আরে বাপু নিজের কথাই লেখো না । তোমাকে তো কেউ সিগারেট নিয়ে গবেষণা করতে বলেনি ।ঠিক কথা ।
স্মৃতি হাতড়ে দেখা গেল , প্রথম সিগারেটে টান কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই । যদিও তার অনেক আগে থেকেই বন্ধুরা সিগারেট খেত । আমাকে বললেও খেতাম না । মানে খেতে ইচ্ছে করেনি । কেন ইচ্ছে করেনি আমি জানিনা । তবে তখন টিউশানের মায়না পেলে বাবার জন্য প্যাকেট প্যাকেট সিগারেট এনে দিতাম । কারণ বাবা সিগারেট পছন্দ করতেন । প্রিয় ছিল । চ্যান্সেলার মনে হয় । তখন ব্রাউন কালারের একটা সিগারেট ছিল । টেস্ট করে দেখিনি , তবে রঙটা চমৎকার । বাবা আপত্তি করতেন না । খুশিই হতেন । মাঝে মাঝে হলুদ প্যাকেটঅলা চারমিনার , ফিল্টার ছাড়া । সে নাকি দারুণ কড়া সিগারেট । অনেকেই বলতেন । ফেলুদা খেতেন বলে আমার একটা আলাদা আকর্ষণ ছিল । প্যাকেটের ছবিটাও দারুণ লাগত ।
ইংরেজি স্যারকে দেখতাম নিজের হাতে সিগারেট বানিয়ে খাচ্ছেন । সুন্দর একটা তামাকের গন্ধ নাকে লেগে থাকত । আহা , সে কী আভিজাত্য– মনে হত কবে বড় হব ! কবে সিগারেট ধরিয়ে এভাবে ছাত্র পড়াব ! তখন ছাত্র পড়ানো স্বপ্নের মতো মনে হত ।এখন ক্লান্ত লাগে ।
প্রথম যখন পুজোর সময় পত্রিকার স্টলের পিছনে সিগারেট ধরিয়েছি বোনের চোখে পড়ে গেল । মনে আছে সেদিন ছিল দুর্গা-সপ্তমী । বোন মা-কে এসে বলে দিল , জানো মা , দাদা সিগারেট খায় । আজ দেখলাম খাচ্ছিল অভীকদার সঙ্গে । মায়ের সে কী রাগ– বললে , আমি নাকি খারাপ হয়ে গেছি । উচ্ছন্নে গেছি । অমানুষ হয়ে গেছি । ইত্যাদি আরো কত বিশেষণ । সেদিন প্রথম বুঝলাম সিগারেট খাওয়া খুব খারাপ । প্রায় মানুষ খুনের মতোই অপরাধ , মানে মাতৃদেবী তেমনটাই বোঝালেন । অথচ বাবা খেলে সমস্যা নেই– এ কেমন বিচার !
তখন আমি নব্য কবি । চা- সিগারেট ছাড়া আবার কীসের কবি ? এমনটাই ভাবতাম । চোখের সামনে আদর্শ স্যারদের দেখছি সিগারেট খাচ্ছেন । মোল্লা সাহাবুদ্দিন , বিজয় সিংহ স্যারেরা তখন আমার চোখে হিরো । কী দারুণ সিগারেট খান– কী স্টাইল রে বাবা !! কেউ কেউ সিগারেট টেনে ধোঁয়ার রিং করতে পালতেন । আমি অবিশ্যি পারতাম না । এখন পারি । কবে , কীভাবে শিখেছি মনে নেই ।
রাতের পর রাত সিগারেটের সঙ্গেই কেটে যায় । কতবার যে ছেড়েছি মনে নেই । প্রেমিকারা জীবনে এসে প্রথমেই যে ব্যাপারটার ওপর শাসন করেছে সেইটে সিগারেট ।একজন বললে , যে আমার জন্য সামান্য সিগারেট ছাড়তে পারেনা , সে কী আর করতে পারবে । ঠিক কথা । ছাড়তে হল । শর্ত পরিবর্তে চাই চুমু । তাতে তাঁর আপত্তি ছিল না । কয়েক লক্ষ চুমু খেয়েছি জীবনে । চুমু আর সিগারেট যেন যমজ বোনের মতোই আমার জীবনে । এই তো কিছুদিন আগে পাখি বললে , আমাকে যদি এত ই ভালোবাসেন সিগারেট খাবেন না । ছাড়তে পারবেন ? মদ্যপান করবেন না — কথা দিন । আমি কথা রেখেছিলাম । পাখি কথা রাখেনি । বললে , বাবা-মা না চাইলে আমি ভালোবাসতে পারব না । তাঁরা এ সম্পর্ক মেনে নেবে না । সে এখন প্রবাসী একটি ছেলেকে ভালোবাসে । বিদেশে যাবে । এ সম্পর্কটা ওর বাবা-মা মেনে নিয়েছেন । ছেলেটির মদ- সিগারেট- মেয়ে সবকিছুর নেশাই আছে । তাতে অবিশ্যি পাখির আপত্তি নেই । আপত্তি ছিল আমার ওপর । সিগারেট নিয়ে আরো কত যে গল্প আছে । আজ এ টুকুই থাক ।
হ্যাঁ , সিগারেট আমার একটা প্যাশান , একটা নেশা , একটা মানসিক আশ্রয় । তবে সেই শ্বেতপরী না টানলে হাগু হবে না– এমনটাও নয় । ভালোবাসা , বিরহ , আবেগ – আড্ডার সঙ্গে বন্ধুর মতো সে জড়িয়ে । আমি সিগারেট খাই , সিগারেট আমাকে খায়নি কখনো । যেভাবে প্রেমিকারা চুষে খেয়েছে রক্ত -মজ্জা-হাড়-মাংস…