• Uncategorized
  • 0

বিশ্ব ব‌ই দিবসে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

নাস্তিকের রবীন্দ্রপাঠ

(বিশ্ব ব‌ই দিবসে রবীন্দ্রপাঠ)

নাগরিক নির্ভয়ে নিঃসংকোচে মাথা উঁচু করে বাঁচবে এমন একটা দেশের কথা তিনি ভাবেন। সেখানে সকলের অবাধ শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত থাকবে। সে দেশ গোটা পৃথিবীর সাথে অচ্ছেদ্য প্রাণময় বন্ধনে সঙ্গত। সেখানে মানুষ নিজের বিবেক বোধ থেকে উঠে আসা চিন্তা ও কথা প্রকাশ করতে অন্তরে কোনো ভীতির সম্মুখীন হবে না। যুক্তিসঙ্গত বিজ্ঞানমুখী মিলনমূলক কাজে ব্রতী হয়ে দেশে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়তে বাধা পাবে না। যে দেশে কুসংস্কার কু আচার নাগরিকের বিচারবোধকে অসাড় করে রাখবে না। প্রয়োজনে কঠিন আঘাত সয়েও সেই উচ্চতর রুচি সংস্কৃতি মনুষ্যত্ব আমাদের অর্জন করতে হবে।
স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যেও স্তরবিন্যাস আছে খুঁজে পায় এক দেশপ্রেমিক যুবক। তার উৎসাহ অফুরন্ত। আবেগ গতিময়। তবু কেবলই তার মতো যুবকদের দেশপ্রেমের কাজ হিসেবে মঞ্চ বাঁধা ও স্লোগান দেওয়া ছাড়া আর কোনই ভূমিকা নিতে দেয় না। তাদের আবেগের বান বন্যা দেখে অন্যরা ব্যঙ্গ করে ‘বাঙাল’ বলে উপহাস করে। সেই যুবকটি টের পায় এভাবে মঞ্চ বেঁধে আর স্লোগান দিয়ে গলা ফাটিয়ে নিজের মনুষ্যত্বকে ফুরিয়ে যেতে দেওয়া যায় না। সে ঠিক করলো শিক্ষকতা করবে। ছাত্রদের গড়ে তুলবে এক একটি ম্যাৎসিনি গ্যারিবল্ডি। কিন্তু কিছুই হয় না। সিলেবাসের বাইরে কিছু বললেই তাড়া করেন প্রধান শিক্ষক। ‘একরাত্রি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বেয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন তিনি দেখতে পান নি। কেন না, 1941 এই অশীতিপর হয়ে তিনি প্রয়াত। কিন্তু নিজের জীবৎকালে দেশের ভিতর আর একটা দেশ তিনি দেখতে পেতেন। উদ্বিগ্ন থাকতেন যে কোন দেশটির স্বাধীনতা আসন্ন?
আমি কৃষ্ণকান্ত লোকটির কথা ভুলতে পারি না। সে ছিল এক বাড়ির চাকর। চাকর মানে ছোটো থেকে একটি পরিবারের সাথে জুতে যাওয়া। পায়ের সাথে যেমন জুতো, তেমনি ভদ্র শিক্ষিত সম্পন্ন পরিবারে একটি চাকর। ভদ্র লোকের সমস্ত প্রয়োজনে সে জুতে থাকে সারাক্ষণ।
দাস ব্যবসা, বেগার শ্রম, এগুলোর তুলনায় কিছু কম নয় এই বাড়ির চাকরের ব্যাপারটা। বাড়ির চাকর মানে তার কোনো আলাদা আইডেন্টিটি নেই। সকালে মালিক (ও মালিক পত্নী) ঘুম থেকে ওঠা মাত্র তাদের নানাবিধ প্রয়োজন মেটাতে তৈরী থাকতে হয় তাকে। তাকে তুই বলে ডাকা হয়। তার পোশাকের পারিপাট্যের কোনো প্রশ্নই আসে না। প্রাইভেসির কোনো স্বীকৃতি নেই। কাজের ঘন্টা মিনিটের হিসেব নেই। চাকরির নিরাপত্তা নেই। যখন তখন তাকে টিকি ধরে টেনে আনা চলে, চড় চাপড়টা দেওয়া চলে। সে সর্বংসহ হয়ে থাকবে এটাই দস্তুর। আমাদের সেই কবিতায় কৃষ্ণকান্ত তথা কেষ্ট কাজ করার পরেও বহুতর অপবাদ সইতে থাকে। জিনিস পত্র কিছু অজর অমর অক্ষয় নয়, টুকটাক ভাঙলেই কেষ্টার দোষ। হারালে কেষ্টা বেটাই চোর। কৃষ্ণকান্ত এভাবেই চালিয়ে দিচ্ছে জীবন। সম্মান হীন, নিরাপত্তা হীন, ভবিষ্যৎ হীন একটা জীবন। তার জীবনে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা থাকতে নেই, যৌনতার সাধ আহ্লাদ থাকতে নেই। এই মানুষ কিন্তু সভ্য সমাজের একেবারে ভিতর মহলে বাস করে তবু বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে। এই বিচ্ছিন্নতা সাংঘাতিক। প্রাণটুকু বেরিয়ে না গেলে কেষ্টাদের কোনো রেহাই নেই। দেশের ভেতর অন্য একটা দেশের গল্প বলেন রবি ঠাকুর।
দেশের ভেতর দেশের আরেক গল্প ফাঁদেন তিনি উপেন কে নিয়ে। হ্যাঁ, উপেনের পিতৃ পুরুষের কিছু দেনা ছিল। তাইতে তার বেশির ভাগ জমি চলে গিয়েছে। সাকুল্যে দুটি বিঘা ভিটে সংলগ্ন জমি নেই নেই করে টিঁকে ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদারকে অপরিমিত ক্ষমতা দিয়ে রেখে ন্যায় নীতির দফা রফা করে রাখা হয়েছিল। দেশীয় লোককে দিয়ে দেশের লোককে শোষণ শাসনের আশ্চর্য উদ্ভাবন এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। অমিত অর্থ জমিদারকে দিয়েছিল অমিত প্রতিপত্তি। জজ ম্যাজিস্ট্রেট হাকিম তাদের হাতের মুঠোয়। কিংবা ট্যাঁকের ভিতরে। কাজেই বিচার “কিনতে” জমিদারদের অসুবিধা কোনোদিন হয় নি। কার স্বাধীনতা চাইছো তুমি ভারতবাসী? নানা ভাবে প্রশ্ন তুলেছেন সারাজীবন ধরে।
মৃত্যু নিয়ে তিনি কি ভাবতেন, সেই সূত্রে পুনশ্চের বিশ্ব শোক কবিতাটি পড়ে নেওয়া যেতে পারে।আর মৃত্যু ব্যথায় আচ্ছন্ন হওয়া নয়, তাকে অতিক্রম করাই রবীন্দ্র দার্শনিকতা। চির রূপের বাণী কবিতা স্মরণ করি।দৌহিত্র, ছোটো মেয়ে অতসী (মীরা) র পুত্র নীতীন্দ্রনাথ মুদ্রণ সৌকর্য শিখতে বিদেশে যান। নিজের উপর নানা অবহেলায় অসুস্থ হন ও অল্প বয়সে মারা যান। ‘বিশ্বশোক’ কবিতা আর সেই কবিতা যাতে ধরা আছে, সেই কাব্যগ্রন্থ ‘পুনশ্চ’ ওই নীতুকেই স্মরণ করে উৎসর্গ করেছেন কবি।নিজের দু দুটি কন্যা, বেলা ও রাণু, ও কনিষ্ঠ পুত্র শমী চলে গিয়েছে। তারা ছিল মা হারা সন্তান। রথীর সন্তান না হলে দত্তক কন্যা নন্দিনী (পুপে) এলেন। আর রইল মীরার বাচ্চারা। নীতু আর নন্দিতা (বুড়ি)। এর উপর মীরার সংসার ছিল কষ্ট কলঙ্কিত। জামাই ছিলেন অমানুষ, মারকুটে গোছের লোক। তাই নীতুর মৃত্যু কি করে কাটিয়ে ওঠেন প্রবীণ মানুষটি, এ এক বড় দার্শনিক পরিচয়।নিজেকে তিনি বারে বারে চিনতে চেয়েছেন। বহু স্তরে বহু মাত্রায়। বলেছেন আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। আবার যেন নিজের অপরিমিত মনুষ্যত্ব কাউকে ঠিক বোঝাতে পারছেন না। বলছেন সে আমারে কে চিনেছ ? তাঁকে তিনি নিজেই চিনতে থাকেন অবাক বিস্ময়ে। তার কিছু কিছু ধরা থাকে সাহিত্যে, অনেকটা থাকে গানে আর সুরে, আরো অনেকটা থাকে ছবিতে। ওঁকে চেনাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।সারাজীবন ধরে তাঁর সাথে নানা রকমে খেলতে থাকেন এক ছলনাময়ী। সোনার এক তরী যেন আছে তার। সে ভরা পালে চলে যায়। তাকে ডাকেন কবি, কূলে তরী ভিড়ানোর জন্য মিনতি করেন। পরিশ্রম করে অর্জিত ফসলটুকু নিঃশেষে তার নৌকায় তুলে দিয়ে করুণা ভিক্ষার স্বরে কবিকেও আশ্রয় দিতে বলেন। সে নৌকায় ফসলটুকু উঠলেও কবির ঠাঁই হয় না। কবির পড়ে থাকা শূন্যতার মাঝে। কবির সাথে সে ছলনাময়ীর খেলা দেখি “নিরুদ্দেশ যাত্রা” কবিতাতেও। এক কঠিন হাসি ছেয়ে থাকে , শুধু হাসি, আরো হাসি। কোনো কথা নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই, কেবল হাসি। সুন্দরী বাতাসে ভাসিয়েছেন তাঁর দেহ সৌরভ, তাঁর কেশদামের স্পর্শটুকু বলে দেয় তিনি বেশি দূরে নেই। কিন্তু কবির দেহ চলে না। “বিকল বিবশ শরীর” মন তাঁর স্পর্শ চেয়ে নিরাশার অন্ধকারে পড়ে থাকে। “সিন্ধুপারে” কবিতাতেও সেই ছলনাময়ীর কথা। কবি বলবেন সব দেখিলাম, তোমারে দেখি নি শুধু। কবিকে হাসিয়ে কাঁদিয়ে চিরদিন “ফাঁকি” দিতে থাকেন এই “নিদয় নীরব ললনা”। অপরূপ তানে ব্যথাটুকু নিয়ে জেগে থাকা কবির। দীঘি কবিতায় বলেন “ওগো বোবা, ওগো কালো, স্তব্ধ সুগম্ভীর , গভীর ভয়ংকর,” আরো বলেন “ছায়া নিচোল দিয়ে ঢাকা মরণ-ভরা তব বুকের আলিঙ্গন’।নিজেকে চেনা হতে থাকে তার নিজের সাথে। বলেন “চিনিলাম আপনারে/ আঘাতে আঘাতে/ বেদনায় বেদনায়”।তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কঠিন কে ভালোবেসেছেন বলেন। সত্য আর কঠিন একই অদ্বয় চেহারায় চেনা দেয় তাঁকে। দারুণ দুঃখের সাথে গোটা জীবনের সম্পর্ক যেন তপস্যা হয়ে উঠেছে। সে দুঃখ তাঁর কাছে কখনো ত্রাসের বিকট মূর্তি নিয়েও এসেছে। অন্ধকারে ছলনার ভূমিকা নিয়েও। ভয় পান নি কোনো দিন
হারাণবাবু ব্রাহ্ম সমাজের এক অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। সভায় বক্তৃতা দেওয়া ও পত্রিকা সম্পাদনার মাধ্যমে ব্রাহ্ম মতাদর্শকে ব্রাহ্ম পরিবারের আওতাধীন ছাত্র ছাত্রী তরুণ তরুণীদের মস্তিষ্কে ঠুসে দেওয়াকে তিনি পরম কর্তব্য বলে জানেন। ঘনিষ্ঠবৃত্তে তিনি পানুবাবু নামে পরিচিত। পরেশবাবুর উদার নৈতিক ভদ্র আচরণকে তিনি একপ্রকার দুর্বলতা বলেই চেনেন। পানুবাবু মনে করেন পরেশের এই ভদ্রতা আসলে ব্রাহ্ম মতাদর্শের প্রতি অবিচল ও সুগভীর আস্থা না থাকারই দ্যোতক । তবু তিনি যে পরেশবাবুর বাড়িতে নিয়মিত আসতে উৎসাহী, তার কারণটি পরেশের স্ত্রী বরদাসুন্দরী বিলক্ষণ জানেন। সুচরিতা নামে পরেশের পালিতা কন্যাটি আচারে আচরণে বড়োই ভদ্র ও নমনীয়। তার উপরে তার মুখশ্রী ও দেহের গঠন বিশেষ আকর্ষণীয়। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ? সে তো বরদাসুন্দরীও শেখেন নি। কিন্তু পরেশের নিয়মিত প্রাণবন্ত তত্ত্বাবধানে সুচরিতা একটি মার্জিত ও আলোকপ্রাপ্ত তরুণী হয়ে উঠেছে। হারাণবাবুর আন্তরিক প্রবল ইচ্ছে যে এই ললনার পাণিগ্রহণ করে তিনি জীবন সার্থক করেন। কিন্তু বাইরের দুটি হিন্দু ছোঁড়ার সংস্পর্শে ইদানিং সুচরিতা কেমন যেন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। আগের মতো আর নতমুখী কিশোরীটি সে আর নয়। গুরুজন যা বলেন তাই যেন আর তার কাছে বেদবাক্য নয়। সাম্প্রতিক অর্জিত অভ্যাসে সুচরিতাও জগৎ সংসারের সাথে নিজের অবস্থানকে নিয়তি নির্দিষ্ট পূর্বঘোষিত বলে মেনে নিতে অস্বীকার করে উঠছে। বাড়া ভাতে ছাই পড়তে যায় দেখে হারাণ ওরফে পানুবাবু ভারি উদ্বিগ্ন। তিনি পরেশের বাড়িতে একমাত্র সমর্থক হিসেবে পান বরদাসুন্দরীকে। সেই মহিলাও সুচরিতাকে পানুর হাতে গছিয়ে দিতে চান। সে এ কারণে নয় যে পানুবাবুকে তিনি বরেণ্য ব্রাহ্ম নেতৃত্ব বলে মনে করেন। বরং বরদাসুন্দরীর চোখে পানু যেন নিছক একটা হেড মাস্টার গোছের জীব। বরদাসুন্দরী আসলে সুচরিতাকে বিশেষ পছন্দ করেন না। লেখাপড়ার ভেতরের মাধুর্য মেয়েটার রুচিতে যতোই ফলে উঠতে দেখেন বরদাসুন্দরী, ততোই বিরক্তি বাসা বাঁধে তাঁর শরীরে। এ মেয়ে যে তাঁর পেটের মেয়েগুলিকে পর্যন্ত বশ করে রেখেছে,এও বরদাসুন্দরীর মহা আক্ষেপের বিষয়। সুচরিতার বিরুদ্ধে পানু আর বরদাসুন্দরীর একটা সুবিধাবাদী অনৈতিক জোট বা ঘোঁট গড়ে উঠতে দেখি রুদ্ধনিঃশ্বাসে।
রাধারাণী জানতো সে আর তার সহোদর ভাই সতীশ পিতৃমাতৃহীন। তার পিতৃবন্ধু ব্রাহ্ম ভদ্রলোক পরেশবাবু অত্যন্ত উদার। তিনি পিতৃস্নেহে নিজের সন্তানদের সাথে সমান মর্যাদায় তাদের দুই ভাই বোনকেও পালন করছেন। নানা কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ রাধারাণীর হয় নি। কিন্তু পরেশবাবু নিজের উদ্যোগে তাকে নানা বিষয়ে পুষ্ট করে থাকেন।ছোট ভাইটি স্কুলে যায়।
পরেশবাবু উদার হলেও তাঁর স্ত্রী বরদাসুন্দরী আদৌ উদার নন। বরং তিনি প্রয়াত বন্ধুর সন্তানদুটির প্রতি পরেশবাবুর এই মায়া মমতাকে নিচু চোখেই দেখেন। বন্ধুর অনাথ সন্তানদের প্রতি এই দায়িত্ব পালনকে তিনি বোকামি বলেই বিবেচনা করেন। বরদাসুন্দরী ব্রাহ্ম ধর্ম বলতে বোঝেন হিন্দুর পৌত্তলিকতাকে প্রাণপণে ঘৃণা করা। কিন্তু এই পৌত্তলিক অভ্যাস ছাড়া হিন্দুয়ানির অন্যান্য বদভ্যাস তিনি নিজের ভিতরে সযত্নে লালন করেন। ধর্মপালন তাঁর মতে কতকগুলি বাঁধা ধরা নিয়ম আর পদ্ধতির অনুবর্তন। নিজের সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো সুসভ্য লোক থাকতে পারে এমন ধারণাকে তিনি আমল দেন না। আর যে কোনো কিছু গ্রহণীয় বা মান্য কি নয়, তা বোঝার জন্য ব্রাহ্ম সম্প্রদায়ের আচার অভ্যাসের পক্ষে তা কতটা অনুকূল, সেটাই তিনি একমাত্র বিবেচ্য মনে করেন। তিনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্ম মহিলা হিসেবে রাধারানীকে যথেষ্ট ব্রাহ্ম করে তোলার তাগিদে তার পিতৃদত্ত নাম ছেঁটে সেটাকে সুচরিতা বানিয়ে দিয়েছেন। বাড়িতে ও সমাজে মেয়েটির রাধারাণী পরিচয় লুপ্ত করেছেন। কিন্তু পরেশবাবুকে তিনি এই জায়গায় এঁটে উঠতে পারেন নি। পরেশবাবুকে দেখে ভদ্রতা নম্রতার বাস্তব উদাহরণ মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তিনি অত্যন্ত ঋজু। তিনি মেয়েটিকে তার পিতৃদত্ত রাধারাণী নামেই ডাকেন। বরদাসুন্দরী তাকে নানাভাবে হেনস্থা করে চললেও পরেশবাবু তাকে স্নেহভরে “রাধে” বলে ডেকে তার সব কষ্ট ঘুচিয়ে দেন।
একটি ব্রাহ্ম পরিবারে সুচরিতা ও রাধারাণী, এই দুই আলাদা পরিচয়ের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে একটি সুশ্রী মার্জিত মনের মেয়ে।
সুন্দরী ঘরণীর প্রতি সেভাবে কখনো চেয়েই দ্যাখে নি শিবতোষ। তাই কি সে মরবার সময় ঘর দুয়োর আসবাব সম্পত্তি মায় স্ত্রীকে পর্যন্ত গুরুদেবের কাছে লিখে দিয়ে যায়! ভাল করে দাম্পত্যের স্বাদই পেলো না মেয়েটা। তার উপর গুমরে গুমরে থাকে – কখন লীলানন্দ স্বামী লোকটা ব্রত আর এটা সেটার ছলে তার যৌবনের মধুকে লুঠ করতে চেষ্টা করে। শিবতোষের বুদ্ধিনাশা ছকে যেভাবে লীলানন্দ স্বামী আর তার ভক্ত সম্প্রদায় জেঁকে বসেছে বাড়িটায় – তাতে তাদের হাত থেকে ছাড় পাওয়া মুশকিল।
এমন সময় লীলানন্দ এর আশ্রমে এসে পৌঁছোয় শচীশ ও ক্রমে তার পরম ঘনিষ্ঠ সুহৃদ শ্রীবিলাস। তারা কলকাতার উচ্চ শিক্ষিত সমাজের মানুষ। ভাল নাম করা স্কলার আর রুচিবান নাগরিক। দামিনীর মনে ধরল যুবক শচীশকে। শিবতোষের সাথে দাম্পত্যের স্বাদ না পাওয়া বিধবাটির মনে শচীশের প্রতি একটা গভীর আকর্ষণ গড়ে উঠেছিল। কিন্তু কোনো ভাবেই শচীশ দামিনীর কাছে সহজ হতে পারত না। হতে যে চাইত না, তা নয়। পুরোনো, অন্যত্র অর্জন করা একটা ব্যথা শচীশকে ভারি আনমনা করে দিত।
একবার দামিনী সকল সংকোচ ঝেড়ে ফেলে রাতের অন্ধকারকে গায়ের পোশাক করে শচীশের কাছে গিয়েছিল। আধো ঘুমে, আধো তন্দ্রায় শচীশ ভেবেছিল কি একটা নরম গা ওয়ালা জন্তু যেন তাকে গ্রাস করতে চাইছে। প্রাণপণে জন্তুটার দিকে ছুঁড়ে ছিল সবল পায়ের সপাট লাথি। সে লাথি লেগেছিল মেয়েটির বুকে।
শচীশকে পাওয়া তার হলো না। শ্রীবিলাসকে নিয়ে থাকত দামিনী। আর শচীশ রইল বুকের সেই ব্যথার মধ্যে। সেই ব্যথা নিয়েই, শ্রীবিলাসের সাথে এক ছাদের নিচে, এক অন্নে দিনযাপন দামিনীর।
এক অসামান্য বন্ধুত্বের গল্প বলতে থাকেন রবীন্দ্র ঠাকুর।
একটা মেয়েকে ঘিরে কতকগুলি তরুণের সে কি পাবার চেষ্টা! মেয়ের মুখে চোখে খেলা করে অসামান্য আনন্দ। তার পরনে ধানী রঙের শাড়ি। তার চলনের ছন্দে, দেহের বিভঙ্গে যৌবনের গান বেজে উঠে পল্লীর সকলের প্রাণের তারে কেমন যেন টান দিয়ে যায়। শেষ অবধি রঞ্জন নন্দিনীকে জিতে নিল তার অসাধারণ পৌরুষের জোরে। যৌবন দেবতা যেন সে। নাগাই নদীকে তোলপাড় করে তার মুক্ত হাসি।
বিশু সরে গেল। সে কাজ নিল সরকারের গুপ্তচর বিভাগে। না, কারোর দয়ায় নয়। চাকরি জোটাবার জন্যে তাকে মোটা মোটা বইয়ের অন্ধি সন্ধি জেনে ফেলতে হয়েছিল।
যক্ষপুরীর সরকার রঞ্জনের সঙ্গে নন্দিনীকে থাকতে দিল না। তারা মেয়েটিকে বিচ্ছিন্ন করে আনলে সর্দারি ব্যবস্থার কেন্দ্রে রাজার জাল ঘেরা ভাঙনতন্ত্রের কাছটায়।
নন্দিনীর কণ্ঠে ছিল গান। তার সেই গানে পাথরও যেন গলে যায়। বিশুর প্রাণের তারে টান পড়তে সে আর গুপ্তচরি ব্যবস্থায় লোক দেখানো আরামে নিশ্চিন্ত থাকতে পারলো না। নন্দিনীর সাথে তার দেখা হতে তার প্রাণের বাঁধন খুলে গেল। মোটা আয় আর আরামের চাকরি ছেড়ে বিশু নামে পথে। নন্দিনী তাকে বলে – তোমায় যেন আমার অনেক কিছু দেবার ছিল, আমি তেমন করে দিতে পারি নি।
মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নিল নেশা ধরা চোখে বিশুর কাছে নন্দিনী হয়ে ওঠে ‘অগম পারের দূতী’ । বিশু ভাবে তোর সেই কিছু না দেওয়া মাথায় নিয়ে আমি অমনি চলে যাব।
পুরুষ ও নারীর সুগভীর এক বন্ধুত্ব অসামান্য কলমে আঁকতে থাকেন কবি।
নিখিলেশ জানতেন সন্দীপকে। কিন্তু ততোটা জানতেন না, যতো টা জানলে তার কাছ থেকে সম্মানজনক দূরত্বে অবস্থান নিশ্চিত করতে হয় সংসারী ও বিবেচক মানুষকে। এই চেনা না চেনার ফাঁকটা ধরেই পুরোনো বন্ধুর জমিদারিতে আসেন, এবং একেবারে রাজার হালে থাকতে শুরু করেন সন্দীপ।
তিনি স্বদেশী কাণ্ডারী। দেশ জোড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জাগিয়ে তুলবেন। নানাবিধ উপচারে দেশমাতৃকার প্রতি নিবেদন করেন হৃদয়ের রক্তরাগ। আর তারই সাথে দেশের এক গৃহবধূ র প্রতিও মন আকর্ষিত হতে থাকে সন্দীপের। গৃহবধূ আর কেউ নন, গৃহকর্তা আশ্রয়দাতা বন্ধু সুজন নিখিলেশের ধর্ম পত্নী বিমলা।বিমলাকে নিখিলেশ মনের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। সেকেলেপনার ঘেরাটোপ থেকে মুক্ত করে, মার্জিত, সুভদ্র পোশাকে, ভাষায়, চলনে, আচারে ব্যবহারে বিমলাকে করে তোলেন চিন্তার জড়ত্ব মুক্তির আলোকে আলোকিত।কিন্তু ঘরোয়া পারিবারিক বৃত্তের বাইরে কোনো পুরুষের সাথে স্বাধীনভাবে মেলামেশা ? না, বিমলা নিজেই ভাবতে পারে নি, আদৌ এর কোনো দরকার আছে কি না। সন্দীপ দেশোদ্ধার করতে বন্ধুর জমিদারিতে এল, লোকের সামনে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দিল, কিন্তু মন রইল বিমলার দিকে।বিমলা, সদ্য অবরোধ থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েটি। তার উপর তার সাথে কথা বলতে কোনো বাধাই নাই। তাই সুযোগ বুঝে নিঃসন্তান বিমলার একেবারে পাঁজর ধরে পুরুষালি টান দেন সন্দীপ।এদিকে নিখিলেশ জানেন মেয়েদের হাতের মুঠোয় বন্দী করে রাখায় কোনো পৌরুষের পরিচয় থাকে না। বিমলা অনুযোগ করেছিল – কেন নিখিলেশ মুঠি শক্ত করেন না। নিখিলেশের মুঠি কাজ করে যুক্তির পথে। জ্ঞানের নিরপেক্ষ ও নির্বাধ উন্মেষের পথে। স্বাদেশিক ব্রতের আড়ালে অযৌক্তিক আস্ফালন আর অন্ধতা, গোঁড়ামির চর্চাকে নিখিলেশ যে দেখতে পান। যুক্তির হীরকতুল্য ছুরিতে সেই সব অযৌক্তিক বিজ্ঞান বিরোধী কার্যক্রমকে স্বদেশী নাম দিয়ে চালানোর বিরুদ্ধে কঠিন আঘাতে ব্রতী হন নিখিলেশ। বিমলাও ভুল বুঝতে পারেন। ফিরে আসেন প্রিয়তমের মনের কাছে।
বন্ধুকে ভালবাসতে গিয়ে কি মারাত্মক বিপর্যয়ই না ঘটাতে যাচ্ছিল একটি উচ্চ শিক্ষিত প্রাণবন্ত যুবক। বন্ধু তার সহপাঠী ও অত্যন্ত অন্তরঙ্গ। এমন কি নিজের মা বাবা নেই বলে সে বন্ধুর মাকে ‘মা’ বলে ডাকে। প্রায় সময় বন্ধুর বাড়ি যায়, থাকে, খায়। কিন্তু কয়েকদিন হয় বন্ধুটি নিজের মত সাংঘাতিক ভাবে তার উপর চাপিয়ে দিতেন। বন্ধুর প্রতি স্নেহে অনুরাগে আর অনেকটা যেন আনুগত্যে সে মেনেও নিত। কিন্তু শিক্ষিত আলোক প্রাপ্ত মনের একটা বৈশিষ্ট্য হল ভেতরে ভেতরে যুক্তি বিচার করা। এটা যেন মগজের ভেতর হয়ে উঠতেই থাকে। ক্রমশঃ সে টের পায়, বন্ধু আর বুঝি বন্ধু নয়, সে প্রভু হয়ে উঠছে।
এই সময়েই একটি শিক্ষিত ব্রাহ্ম পরিবারে সে যাতায়াত করত। অনেকটাই সেই পরিবারের রুচিশীল উদার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে, আর তার চেয়ে বেশ বেশিভাবেই ভদ্র লোকের সুন্দরী ও আকর্ষণীয় মেয়েদের জন্য। এমন মেয়ে সে কখনো দেখেনি। নারীত্বের তনুলতায় কমনীয়তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই, অথচ কি সহজ সাবলীল স্বচ্ছন্দ মেয়েগুলি ! বাঙালি শিক্ষিত যুবা যেন যুগে যুগেই এরকম সহজ সুন্দরীকে পেতে চেয়েছে। মেয়েগুলি যেমন সুন্দর, তাদের নামগুলিও খুব রুচি পূৰ্ণ। আর সেই ব্রাহ্ম পরিবারে শিক্ষিত মার্জিত যুবকের সাথে বেশ আলাপ গল্প করতে দিতে বাবা মায়ের তরফে কোনো সমস্যা নেই।
বন্ধুটির উপর খুব রাগ হচ্ছিল, যখন সে এমন একটি আলোকপ্রাপ্ত সুন্দর পরিবারের মেয়েদের সাথে মেলামেশাকে টিপ্পনী কাটতে শুরু করল। বন্ধুটি বিজ্ঞ, কিন্তু তার বিনয়ের দিকটি বিশেষ কম। বেশ গোঁড়া হয়ে উঠতে চাওয়া মানুষ। বন্ধু হয়ে উঠতে চাচ্ছে প্রভু।
কিন্তু বন্ধুকে কি ছাড়া যায়? তাহলে সে কি করবে? ব্রাহ্ম পরিবারটিতে আর যাবে না ? যে মেয়েগুলির হাসি খুশি বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলি সে শয়নে স্বপনে দেখতে পায়, তাদের অনায়াস সঙ্গ ভুলে যাবে?
সে রাজি হল প্রচণ্ড হিন্দু গোঁড়া হয়ে উঠতে চাওয়া বন্ধুটির ভাইঝি শশিমুখীকে বিয়ে করতে। সে জানে শশিমুখী নেহাত বালিকাটি। এমন কি শৈশবে মেয়েটিকে কোলেও নিয়েছে সে। এমন একটি বালিকা কেও সে বধূ হিসেবে ভাবছিল, শুধু সাংঘাতিক গোঁড়া হয়ে উঠতে থাকা বন্ধুটির সাথে সম্পর্ক রাখবে বলেই।
শশিমুখী নয়। বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব টিঁকিয়ে রাখতে নিজের যৌবনকে জলাঞ্জলি দিতে চায় সে।
বাদ সাধলেন বন্ধুর মা। প্রশ্ন তুললেন যৌন কমপ্যাটিবিলিটির। আলোকপ্রাপ্ত মার্জিত যুবকের পক্ষে একান্ত বালিকাকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করা অন্যায় হবে। বিবাহ হবে সমযোগ্য মানুষের মধ্যে। নইলে সে একটা বিশ্রী ব্যাপার। মনের মধ্যে আলো ধরেন রবীন্দ্রনাথ।
কথায় বলে মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি। কথাটা ব্যঙ্গ করে বলে। ভেতরের কথাটা হচ্ছে মায়ের চাইতে মাসির দরদ বেশি হবার নয়। কিন্তু “দেবতার গ্রাস” কবিতায় যেন অমনই হচ্ছিল। মাসি অন্নদা’র কাছেই মানুষ হচ্ছিল রাখাল। বাপ মরা ছেলেটা। মা তার ছিল। সে অর্থে অনাথ নয়। কিন্তু মোক্ষদা অকালে বিধবা হয়ে শোকে, তাপে, নানা জ্বালায় যেন বুড়িয়ে গিয়েছিল। তার উপর প্রসবকালে নানা জটিলতায় ভুগেছিল মোক্ষদা। তাতেও তার স্বাস্থা ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। নবজাতককে স্তনদুগ্ধ দেবার মতো শারীরিক সামর্থ্য ছিল না তার। সেই সময় তার বোন অন্নদা নিজের শিশুর সাথে রাখালকেও বুকের দুধ দিয়ে বাঁচায়। রাখাল বেঁচেছিল। মোক্ষদাও বেঁচেছিল। বোনের হাতে পেটের ছেলের সব ভার সঁপে দিয়ে রুগ্ন কাতর বিধবা মোক্ষদা বেশ নিশ্চিন্ত ছিল। স্বামী নেই মানে হিন্দু বিধবার জীয়ন্তে মরে থাকা। স্বামী নেই মানে ভালোবাসা পাবার স্বাভাবিক রাস্তা নেই, ভাল খাবার উপায় নেই, ভাল পরার উপায় নেই। আনন্দ অনুষ্ঠানে গিয়ে দাঁড়াবার অধিকারটুকু নেই। তার যৌন খিদের স্বীকৃতির প্রশ্নই ওঠে না। যৌবন যাতে বিধবার ধারে পাশে উঁকি না মারতে পারে তার জন্য কত রকম ব্যবস্থা! হিন্দু শাস্ত্রমতে একটা বিধবা যেন চলমান অশরীরী। তার জন্য রয়েছে নানা কৃচ্ছসাধন আর নানা নামের উপবাস আর তাকে রীতিমতো আত্মনিগ্রহ করতে দেখলে সমাজপতিরা নিশ্চিন্ত হন। গ্রাম্য বিধবার জন্য এই ছিল সনাতনী হিন্দু কোড অফ কন্ডাক্ট।
তো মোক্ষদার পরে সন্তান পালনের ভার না থাকায়, তার মন গিয়ে পড়েছিল ধর্মকর্মের দিকে। আর কিই বা করতে পারতো মোক্ষদা? কিছু তো একটা নিয়ে মগজকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে। মোক্ষদার মতো দীন হীন সাক্ষরতা বঞ্চিত মেয়ে ধর্মের যাঁতাকলে নীরক্ত হতে হতেও সেই ধর্মের আচার অনুষঙ্গেই ডুবে থাকতে নিরাপত্তা বোধ করত।
আপনি একে ধর্মমোহ বলবেন কি না, সে আপনার ব্যাপার। কিন্তু কথা হল এই যে দিনের বেশিরভাগ সময় এই ঠাকুর পুজো বারব্রত মেনে উপবাস অনশনে কাটিয়ে দিয়ে নিজেকে ক্ষইয়ে ফেলার কাজে বিধবাদের পরোক্ষে উৎসাহ দিত সনাতনী হিন্দু সমাজ।
এহেন গ্রামে একবার সাড়া ফেলে দিল জনৈক হিন্দু সমাজপতি মৈত্র মহাশয়ের গঙ্গাসাগর যাত্রা। গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন তখনো সুদূর বিস্মৃত অতীতের ব্যাপার নয়।
‘দেবতার গ্রাস’ তো অনেকেই পড়েছেন। আমায় নাড়া দিয়েছে ” ‘মাসি’ বলি ফুকারিয়া মিলালো বালক” কথাটা।
নাঃ, রাখালের কাছে অন্ততঃ মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি ছিল – চোখের জলে মেনে নিয়েছি।
কে ব্রাহ্মণ ?
রবীন্দ্রনাথ ছান্দোগ্য উপনিষদ থেকে চমৎকার একটা গল্প তুলে এনে দিয়েছিলেন আমার ছোটবেলায় ।
মায়ের নাম জবালা । ছেলের নাম সত্যকাম । জবালা একক মা। সিঙ্গল মাদার । জবালার ভারি শখ তার ছেলে লেখাপড়া শিখুক । উপনিষদের যুগে মুনি ঋষিদের তপোবনে আশ্রমিক পরিবেশে লেখাপড়া হত। কেবল ব্রাহ্মণের ছিল পড়াশোনার অধিকার।
মায়ের আগ্রহে তেমন একটা আশ্রমে গেল বালক সত্যকাম। সেখানকার গুরুর নাম গৌতম । সত্যকাম ভারি মিষ্টি দেখতে । তার দু চোখে আশ্চর্য পবিত্র সরলতা । গুরুর আশ্রমে গিয়ে সে নিজের পড়াশোনার ইচ্ছের কথা জানালো । নিজের নাম বললো । গুরু জানতে চাইলেন তার পিতৃনাম। সত্যকাম সিঙ্গল মায়ের সন্তান। সে পিতার নাম পাবে কোথায় ? জানে না সে নিজ পিতার নাম। সে কথা সহজভবে বললো সে। গুরু তাকে বললেন পিতৃনাম জেনে আসতে। আরো বললেন শুধু ব্রাহ্মণের বেদ পাঠের অধিকার আছে । বালক সত্যকাম মায়ের কাছে ফিরে এসে জানতে চাইলো নিজের পিতৃনাম । এবার জবালা, সিঙ্গল মা টি, একটা অসামান্য কাণ্ড ঘটাবেন । মা হিসেবে নিজের পেশাগত পরিচয় স্পষ্ট করবেন আত্মজের কাছে। বলবেন তিনি সেই আদিম দেহব্যবসার মাধ্যমে অন্ন সংগ্রহ করে থাকেন। প্রতি সন্ধ্যায় নিজের গতর খাটিয়ে তাঁকে উপার্জন করে সংসার চালাতে হয় । আজকের পলিটিক্যালি কারেক্ট ভাষায় যৌনকর্মী।
সত্যকাম তার মাকে জানে । সে সেই কথা অম্লানবদনে গিয়ে গুরু সমীপে বলে। স্কুলে আজকাল যেমন ইঁচড়েপাকা ছোঁড়া দেখা যায়, কোনোকালেই তার অভাব ছিল না বোধ করি। অন্ততঃ গুরু গৌতমের পাঠশালায় তেমন দু চারটি চিজ ছিলই। তারা তো জানে “বহু পরিচর্যা” মানে কি ? গুন গুন করতে লাগলো সমস্ত ঘর। কানে কানে কানাকানি হতে লাগলো “বহু পরিচর্যা” কথাটার ব্যঞ্জনা নিয়ে। যৌনকর্মীর ছেলে , (পড়ুন খানকীর ছেলে ) আবার ইশকুলে পড়বে?
আজকের ভারত বহু ঢোঁক গিলে সিঙ্গল মাদার এর সন্তানের পড়বার অধিকারকে মেনে নিয়েছেন। হ্যাঁ, বহু ঢোঁক গিলে তার পর। তাও এই সেদিন। গুরু গৌতমের অত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল না। তিনি বালক সত্যকামের সত্য কথা বলবার মনের জোর দেখে, বিশেষতঃ তার মধ্য দিয়ে তার জননীর যে সত্যবাদী ছবি ফুটে উঠলো, তাকে সম্ভ্রম জানাতে সত্যকামকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, যে সত্যবাদী সেই ব্রাহ্মণ ।
সে সব দিন কি একেবারেই গিয়েছে?
মেয়েটি চুলের মধ্যে একটি আংটি লুকিয়ে রেখেছিল। কোথায় পেল অমন দামি আংটি?
অপরাধের বিচার করতে বসলেন বিচারক মোহিতচন্দ্র।
কই দেখি কি রকম আংটি?
আংটি দেখে মনে পড়ল যে এ তাঁরই নিজের আংটি।
পাশের বাড়ির নবযৌবনা বিধবাটিকে প্রেম নিবেদনের সময় আংটি দিয়েছিলেন। সে প্রেম অবশ্য ঘর পায় নি। পথে ভেসে গিয়েছিল। ভেসে ভেসে হিন্দুর ঘরের যুবতী বিধবা কোথায় যায়? তার পথ গিয়ে থামে কোন কানাগলিতে?
মোহিতচন্দ্র জবরদস্ত চাকরি বাগিয়ে বিচারকের পদে। বিচারকের আসনে বসে মোহিতচন্দ্র আংটি হাতে নিয়ে নিজের যৌবনের দুষ্কর্ম মনে করতে পারেন।
আমাদের সমাজের উচ্চপদস্থ মানুষদের চেহারাটা ভেতরে ভেতরে কেমন, দেখাতে থাকেন রবীন্দ্রনাথ।
“পুনশ্চ” কাব্যগ্রন্থে সেই কবিতাটা পেয়েছি। মেয়ে মঞ্জুলিকা বিধবা হয়ে বাড়ি ফিরে এল। নিজের বাবা তার উপর চাপিয়ে দিলেন হাজার রকম নিয়ম পালনের দায়। মায়ের প্রতিবাদ খাটে না। মা দুঃখ চেপে চেপে মারা গেলেন। বাবা মেয়ের ভালবাসার পাত্রের সাথে মেলামেশা করতে দেবেন না। অথচ নিজের পুনর্বিবাহের আয়োজনে বাপ উল্লসিত।
# হেলেন কেলার এর কথা বলি। কবিগুরুর লেখা সোনার তরীর “দুই পাখি” কবিতাটি হেলেন অনুবাদে পড়েছিলেন। কবির সাথে সাক্ষাৎ এর সুযোগ হতে কবির মাতৃভাষায় দুই পাখি শোনার ইচ্ছে হল হেলেনের। কবি জানলেন হেলেনের ইচ্ছার কথা। খুব উৎসাহ বোধ করেন নি প্রথমটায়। মেয়েটা সেই ঊনিশ মাস বয়স থেকে লিভারের অসুখে ভুগে চোখে দেখে না, কানে শোনে না, কথা বলতে পারে না। কি করে ওকে কবিতা বোঝানো যাবে ? কবি আড়ষ্ট হয়ে রয়েছেন। হেলেনের জন্যে রথীন্দ্র, কবিপুত্র বাবার উপর চাপ দিলেন। যেতে হল কবিকে। শোনাতেও হল দুই পাখি। হ্যাঁ বাংলায়। হেলেন খুশিতে ফেটে পড়ছেন। শোনা ? হ্যাঁ, আপনি ঠিক দেখছেন। কবিদের ওষ্ঠ স্পর্শ করে তার ভাবতরঙ্গ গ্রহণ করে বোঝার অন্যরকম শক্তি ছিল হেলেনের। আনন্দিত হেলেন কে তার শিক্ষিকা বোঝালেন, তুমি যেমন চোখে দ্যাখো না, কানে শোনো না, কথা বলতে পারো না, তুমি যেন একটা খাঁচায় বন্দিনী। মূহুর্তে আপত্তি জানালেন হেলেন। না না, হেলেনের একটা মন আছে। ওই মনের জোরে সে সব কিছু টের পায়। মনই সব। মনের ভেতর দিয়ে বিশ্বলোকের সাড়া পায় হেলেন। কবিগুরু হতবাক। বন্দিত্ব কে কে কবে এভাবে অতিক্রম করেছেন?
তিনি বলবেন “শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো”। আরো বলবেন – “শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো”। ওইখানে একটুখানি ইঙ্গিত দিয়ে রাখেন কবি – শাস্ত্রে আটকে থাকা নয়, মানুষের ভালোতে পৌঁছাবেন তিনি। তিনি যে নিজের জীবনপণ করে শিক্ষা স্বাস্থ্য স্বনির্ভরতার চর্চায় এগিয়েছিলেন!
আধুনিক যুগে সেকেলে শাস্ত্রের স্থানটা নিয়ে নিল স্বার্থ। আরো ভালো করে বললে ‘রাষ্ট্রিক স্বার্থ’। প্রকৃতির গড়া উদার প্রান্তরকে কেটে ছেঁটে ছোটো করে নাম দিলে রাষ্ট্র। প্রকৃতি তা মানে না। তাই ভাষার বিকাশে, শব্দের শিকড়ে, গানের সুরে, বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব সাধনায় বারে বারেই রাষ্ট্রিক বিভেদের গণ্ডী ডিঙোনোর বার্তা এসেছে। যত রাষ্ট্রিক স্বার্থের নাম জপতে জপতে নেশনের পাণ্ডারা যুদ্ধের তাল ঠুকতে চেয়েছে, আবিশ্ব নাগরিক সমাজ ওই বুদ্ধির আলো জ্বেলে বলতে চেয়েছে হানাহানি বড়ো নয়, বড়ো হল পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, প্রীতিপূৰ্ণ সহাবস্থান। বৃহৎ শক্তি অন্যের উপর দাপট দেখিয়ে অধীনতামূলক মিত্রতা চাপাতে চাইলে কি হবে শুভবুদ্ধি শান্ত, তবু স্পষ্টস্বরে দাবি করেছে সম্মানমূলক মিত্রতা। কোনো কোনো ছোটো দেশ প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের সেনাবাহিনী কামান বিমান দেখে ঘাবড়ে না গিয়ে বৃহতের দেশে নাগরিকের শান্তিবোধের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বড়ো রাষ্ট্র তার বড়ত্ব জাহির করতে প্রাকৃতিক জলধারাকে আটকে দিয়েছে। ছোটকে জল না দিয়ে মারবে, এই তার ইচ্ছে। বড়ত্বের দম্ভে বলে এই হল বিভূতি। ছোটকে ঠুসে না মারতে জানলে বড়োর বড়াই কিসের ? কিন্তু প্রকৃতির কলকাঠি অন্যভাবে কাজ করে। সে রাজার ঘরে রাজপুত্র অভিজিৎ হয়ে সেই বাঁধ খুলে দিয়ে মনুষ্যত্ব মেলে ধরে। প্রাণ দিয়েও মানবতা বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকে মনুষ্যত্বের মুক্তধারা।
দেশে যে বান বন্যা হয় না, তা তো নয়। আবার খরাও অচেনা নয়। আর বান বন্যা খরায় প্রায় কষ্ট পায় প্রান্তিক ও দলিত মানুষেরাই। এদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কথাও ভাবতে হয় হৃদয়বান মানুষকেই। এ যুগেও হয়, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেও হত। এভাবেই অতীতের নামী নগরী শ্রাবস্তী একবার দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ায় ভগবান গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের ডেকে পাঠিয়ে জনে জনে ক্ষুধিতের অন্নদান সেবার অনুরোধ করছেন। সভা ঘরে ধনাঢ্য রত্নাকর শেঠ, সামন্তরাজ জয়সেন এবং বিরাট কৃষিজোতের মালিক ধর্মপাল উপস্থিত রয়েছেন। সবাই তাঁদের আর্থিক সক্ষমতার কথা জানেন। তার উপর ভর করেই ভগবান বুদ্ধ তাঁদের দিকে করুণ মিনতিভরা চোখে চেয়ে আছেন। কিন্তু সেই স্বচ্ছল মানুষগুলিও তাঁদের অপারগতার কথা স্পষ্ট করে বললেন। তাহলে এবার কি হবে? বুদ্ধের মিনতি কি বৃথা যাবে? গোটা সভা চিন্তিত। এমন সময় এক ভিক্ষুণী, নাম তার সুপ্রিয়া, জন্মপরিচয়ে সে অনাথপিণ্ডদের কন্যা, সে উঠে দাঁড়াল। বুদ্ধের সময়ে ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীগণ অত্যন্ত কৃচ্ছসাধন করে জীবনাতিপাত করতেন। এহেন এক সর্বহারা ভিক্ষুণী এমন দায় নিতে সাহস করছেন কোন বলে সে প্রশ্ন উঠে গেল। ভিক্ষুণী কি কোনো গোপন সম্পদের অধিকারিণী? তাঁর পিতা তো অনাথপিণ্ডদ, যাঁর পূর্ব পেশার হীনতা সম্পর্কে সকলে সম্যক অবগত। তো সুপ্রিয়া কোন স্পর্ধায় শ্রেষ্ঠী, সামন্তরাজ, বিশাল কৃষি খামারের মালিককে পিছনে ফেলে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে চাইলেন? সবাই যেন এই ভিক্ষুণীর মাথা তুলে দায়িত্ব নেওয়ার কথা জানানোকে একটা রীতিমত নির্বোধ অহংকার ভাবছেন। এইবার তাঁর সামর্থ্যের ব্যাখ্যা দেবেন ভিক্ষুণী। বলবেন তাঁর ভিক্ষাপাত্রের কথা। বলবেন “আমি দীনহীন মেয়ে, অক্ষম সবার চেয়ে,” তাই সকল স্বচ্ছল গৃহস্থের কাছে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়াতে তাঁর লজ্জা নেই। সবাই কিছু কিছু করে দিলে ত্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী জুটে যাবে। এক নতুন পথ দেখান ভিক্ষুণী সুপ্রিয়া। যে স্পর্ধা বড় বড় ধনী শ্রেষ্ঠীরা সাহস করেন না, সকলের সহযোগিতাকে সম্মিলিত সূচিমুখ করে এক গরিব মেয়ে তা ভাবতে পারেন। সম্মিলিত অংশগ্রহণের পথে দায় বিপদের মোকাবিলার এক অসামান্য পথ দেখান এক কবি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।