মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বেদকে ঋক, যজু, সাম ও অথর্ব- এই চার ভাগ করেন এবং মহাভারত, ভাগবত প্রভৃতি আঠারোটি মহাপুরাণ ও ব্রহ্মসূত্র ( উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন ) রচনা করে অমর হয়ে রয়েছেন। এ’সব গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি শুধু ভারতবর্ষ নয় সারা বিশ্বকে জ্ঞানের আলোকে দীপ্ত করে অজ্ঞান অন্ধকার দূর করে দিয়েছেন। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যেমন মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত, শ্রীশ্রীচণ্ডীও তেমনই অষ্টাদশ মহাপুরাণের অন্যতম মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত ( ৮১ থেকে ৯৩তম অধ্যায় )। গীতায় সাতশত শ্লোক আছে এবং চণ্ডীতে পাঁচ শত আটাত্তর শ্লোক আছে, যা সাতশত মন্ত্রে বিভক্ত। এক একটি মন্ত্রে হোম করার বিধি আছে। কাত্যায়নী তন্ত্রে এই মন্ত্রবিভাগরহস্য বর্ণিত আছে। মন্ত্র সংখ্যার হিসেবে চণ্ডীকেও গীতার ন্যায় সপ্তশতী বলা হয়। প্রশ্ন জাগে, চণ্ডীগ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় দেবী চণ্ডী বা চণ্ডিকা দেবী , কে তিনি?
শ্রীশ্রীচণ্ডী বললে তাঁকেই বুঝায় যিনি বেদের ব্রহ্ম ও পুরাণের মহামায়া। যিনি জ্ঞানীর নিকট ব্রহ্ম, যোগীর নিকট পরমাত্মা ও ভক্তের নিকট ভগবান। যিনি অব্যক্ত অবস্থায় তুরীয় নির্গুণ ব্রহ্ম, আবার ব্যক্ত অবস্থায় ত্রিগুণময়ী প্রকৃতি অর্থাৎ যিনি নিশ্চল অবস্থায় নির্বিকার, নির্বিশেষ ও নিরুপাধি ব্রহ্ম, আবার সচল অবস্থায় সবিকার, সবিশেষ, সৃষ্টি-স্থিতি-ভঙ্গকারিনী ব্রহ্মশক্তি। যিনি জীবদেহে সর্বভাবময়ী, সর্বপ্রবৃত্তিময়ী, সর্ব-ইন্দ্রিয়-স্বরূপিনী, আবার চিৎবস্তু আত্মারূপে অবস্থান করেন। যিনি জীবদেহে ব্যষ্টিভাবে আত্মা, আবার সমষ্টিভাবে বিশ্বাত্মা, হিরণ্যগর্ভ ও বিরাট। যিনি নিজের স্বরূপ অক্ষুন্ন রেখে সমকালে নির্গুণ, সগুণ, অবতার ও আত্মা। যিনি সচ্চিদানন্দবিগ্রহ। যিনি জাগ্রত, স্বপ্ন, সুষুপ্তি- এই তিন অবস্থার সাক্ষী। যিনি অঘটন-ঘটন-পটীয়সী। যিনি অনন্ত নাম ও রূপ ধারণ করে জড় ও চিৎ স্বরূপে প্রকাশিতা। যিনি ভক্তগণকে বর ও অভয়দান এবং অভক্তগণকে মরণ-ভীতি প্রদান করেন। যিনি ভক্তগণকে সমকালে ভোগ ও মোক্ষ প্রদান করেন। যিনি লীলাময়ী।যিনি জগতের কল্যাণের জন্য নিত্য হতে লীলায় অবতরণ করেন। যিনি অবিদ্যা মূর্তিতে জীবকে সংসারে বদ্ধ করেন, ভোগে আসক্ত করেন। আবার বিদ্যামূর্তিতে বদ্ধজীবকে আসক্তির বন্ধন হতে মোচন করেন এবং তাঁর স্বরূপে অবস্থিতি করান। যিনি তাঁর আশ্রিত ভক্তগণকে মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার করে অমরত্ব প্রদান করেন। যিনি ভক্তগণের অভীষ্ট পূরণের জন্য অতি সৌম্যমূর্তি হয়েও প্রয়োজন মত অতি ভীষণমূর্তি ধারণ করেন এবং ভক্তগণকে ভীষণ অসুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা করেন। যিনি “শরণাগত, দীন ও আর্তগণের পরিত্রাণ-পরায়ণা”। যাঁর কৃপায় অযোগ্য, যোগ্য পাত্র হয়, সাধারণ ব্যক্তি, অসাধারণ বলে গণ্য হয় এবং পার্থিব ও অপার্থিব সকল অভাব জীবের পূরণ হয় ও বিদ্যা, যশ, ধন, প্রতিষ্ঠা আবার ভক্তি, বৈরাগ্য, তপস্যার শক্তি ও মুক্তিলাভ- সকলই সুলভ হয়। এই আমাদের মা! এই শ্রীশ্রীচণ্ডী!
ঋষি কণ্ঠে দেবীর একটি ধ্যানে ব্যক্ত হয়েছে-
যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মুলিনী
যা ধুম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।
শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা
সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।।
অর্থাৎ ‘তিনিই সেই চণ্ডিকা দেবী, যিনি ব্রহ্মাকে রক্ষা করার জন্য মধু ও কৈটভ নামে দু’টি অসুরকে দলন করেছিলেন; যিনি আর এক যুগে দেবগণের রক্ষার্থ মহিষাসুরকে বধ করেন; যিনি অপর এক যুগে শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়ের অনুচরগণ ( ধুম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ প্রভৃতি ) বধ করে শেষে শুম্ভ ও নিশুম্ভকেও দমন করেছিলেন; দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করার জন্য বহুবার যিনি এই প্রকারে অবতার গ্রহণ করেছেন; যিনি ভক্তগণের সর্বকার্যের সিদ্ধি-প্রদায়িনী, যিনি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী-স্বরূপিনী, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠা, যিনি অষ্টশক্তি-সমন্বিতা, যিনি বহুরূপী হয়েও নবদুর্গার রূপ ধারণ করে জগতে খ্যাতা হয়েছেন, যিনি বিশ্বের ঈশ্বরী; তিনিই আমায় রক্ষা ও পালন করুন’।
‘চণ্ডী’ কথার অর্থ ‘ক্রুদ্ধা, উগ্রা’। চণ্ড শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ চণ্ডী। দুষ্ট দৈত্যদলন কার্যের জন্য ব্রহ্মস্বরূপা ব্রহ্মশক্তিকে যখন শান্তভাব ত্যাগ করে ক্রোধের পূর্ণ মূর্তি বা চণ্ডভাব ধারণ করতে হয়; যখন অবতার প্রয়োজনে মা ব্রহ্মময়ীকে মধুকৈটভ-অসুরদলনী তামসী যোগনিদ্রারূপে আবির্ভূতা হতে হয়, তখনই তিনি ‘চণ্ডী’ নাম ধারণ করেন। অসুরদলন-কার্য রজোগুণের, সেইজন্য তিনি ‘চণ্ডী’ বা কোপনা সাজেন। ব্রহ্মময়ী অতি স্নিগ্ধ, অতি সৌম্য কিন্তু শরণাগত দেবগণকে বা ভক্তগণকে অসুর-পীড়ন বা সংস্কারের প্রবল অত্যাচার থেকে রক্ষা করার জন্য অর্থাৎ দেবগণের বা সাধকের হিতার্থে তিনি প্রয়োজনমত অতি ভীষণ ভাব ধারণ করেন। পরমাত্মা যখন দেখেন তাঁর সন্তানেরা নানা আসুরিক ভাবের নিকট পরাজিত, লাঞ্ছিত ও পীড়িত হয়ে দুঃখের প্রতিকারের জন্য তাঁর শ্রীচরণে প্রপন্ন হয়েছে, তখনই তিনি আর্ত ও প্রপন্ন সন্তানগণের দুঃখ দূর করার জন্য স্বয়ং যুদ্ধবেশে সজ্জিত হয়ে ‘চণ্ডী’ মূর্তি ধারণ করে তাঁর কুপুত্র অসুরদের নাশ করতে আসেন। করুণায়-ভরা চিত্তে তিনি তাঁর আশ্রিত ভক্তগণকে নির্ভয় করার জন্য নিষ্ঠুর হয়ে তাঁর কুপুত্র অসুরদের বধ করেন এবং অসুরদের জড় দেহের সাথে তাদের দুষ্ট সংস্কার-রাশি ধ্বংস করে তাদের প্রতি কৃপা করে তাদের অমৃতময় জীবন দান করেন।
অসুরদের নিকটে তিনি চণ্ডী—মূর্তিতে ও আচরণে। দেবগণ চণ্ডী স্মরণ করেন, দেবীর বর ও অভয় পাওয়ার জন্য। তিনি চন্ডী-লীলায় এক হস্তে ভক্তগণের জন্য বরাভয় দান করেন এবং অপর হস্তে অভক্তগণের জন্য শাণিত খড়্গ ও রক্ত-প্লুত অসুর মুণ্ড ধারণ করেন। ভক্তগণ মায়ের বরাভয় দেখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাকে বড় সুন্দর, বড় স্নিগ্ধ ও বড় সৌম্য দেখেন। অভক্তগণ মায়ের হাতে ভীষণ অস্ত্র ও কাটা মুণ্ড দেখে মায়ের মুখ পানে তাকিয়ে মাকে ভীষণা, ভয়ঙ্করা ও অতি উগ্রা দেখে। চণ্ডী উপাসকের ভরসা এই যে, মা আমাদের “ভীষণং ভীষণানাম্” অর্থাৎ সমস্ত ভয়ের কারণ সকলও মা-র চণ্ডী-মূর্তির সন্মুখে ভীত হয়। মা এমন ভয়ঙ্করা মূর্তি ধারণ করতে পারেন, যা অপেক্ষা ভীষণা মূর্তি কল্পনাও করা যায় না। ভক্তগণের বিপদের জন্যই মা-র চণ্ডী-লীলা। ভক্তগণের যখন বিপদাপদ থাকে না, তখন মাকে চণ্ডী হতে হয় না। তবে ভক্তগণের সে সুদিন ঘটে না। যতক্ষণ না মাকে দর্শন করা হয় ততক্ষণ আমরা অশান্তির মধ্যে থাকি। ততদিন আমাদের সাধনা থাকে বলে আমরা বিপদের মধ্যে থাকি, কাজেই মাকে আমাদের সকলের জন্য এখনও চণ্ডী সাজতে হয়। জীব সংস্কারের অত্যাচারে সর্বদাই পীড়িত । কারণ, জীব-সংস্কার ভগবৎ বিরোধী—কাজেই জীব সংস্কার অধীন বলে সাধনার পথে স্বয়ং যেতে পারে না। যখন জীব মুক্তিপথে যাবার চেষ্টা করে তখন তার দুষ্ট সংস্কার তাকে বাধা দেয়। সৎসঙ্গ ও সৎশাস্ত্র তাকে ঠিক পথে চলতে প্রবুদ্ধ করলেও তার দুষ্ট সংস্কার তার আত্ম-দর্শনের চেষ্টাকে বারবার ব্যর্থ করে দেয়। তাই জীবকে পুরুষার্থ লাভ করতে হলে আত্মশক্তির উপর নির্ভর না করে পরমাত্মার শরণাগত হতে হবে। বিশ্ব-জননীর শান্তিময় কোলে চির-বিশ্রান্তি লাভ করার জন্য আপনাকে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় মনে করবে এবং আত্মা-রূপিনী মহামায়ার নিকট বরাভয় প্রার্থনা করবে। মহামায়া তখনই ভাগ্যবান সাধকের মনোরথ পূর্ণ করার জন্য স্বয়ং যুদ্ধবেশে চণ্ডীরূপে আবির্ভূতা হন এবং ভক্তের সমস্ত আসুরিক সংস্কার নাশ করে তাঁকে নির্ভয় করেন। সাধকের নিকট সাধনার অন্তরায় যা কিছু সমস্তই বিপদ। কাজেই যতদিন না সাধনায় সিদ্ধি লাভ হচ্ছে, ততদিন সাধক বিঘ্ন-নাশের জন্য শ্রীশ্রীচণ্ডীর উপাসনা করবে। মা-ও আমাদের শরণাগতবৎসলা বলে চণ্ডীমূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে সাধকের কাম-ক্রোধাদি রিপুগণকে চূর্ণ করে তাকে মুক্তিদান করেন।
চণ্ডীতত্ত্ব আলোচনা করলে এই প্রতীতি হয় যে, এই চণ্ডীই জগতের রাষ্ট্রী ও জননী। আমরা তাঁর হাতের পুতুল। তিনিই যন্ত্রী, আমরা যন্ত্র। তিনিই কর্মফলদাতা। তিনিই জীবের অদৃষ্ট। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে একগাছি তৃণও স্থানচ্যুত করার শক্তি আমাদের বা বিশ্বসংসারের কারো নেই। এই সংসার মহামায়ার বিরাট মায়া। তিনিই আসল কর্তা, আমরা নিমিত্ত মাত্র। তিনিই জীবকে সংসারে বন্ধন করেন, আবার তিনিই বদ্ধ জীবকে মুক্তি দেন। তিনি প্রসন্ন হলেই বরদায়িনী হন। কল্পতরু তিনি, সে’জন্য কামনা অনুসারে জীবকে ভোগ ও মোক্ষ প্রদান করেন। তিনি তাঁর নিজের চরিত্র-কথা বা এই দেবী মাহাত্ম্য শুনলে অত্যন্ত প্রসন্ন হন।
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থ বা দেবী মাহাত্ম্য তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ—দেবী মাহাত্ম্যের উপক্রমণিকা। দ্বিতীয় ভাগ—মূলগ্রন্থ। তৃতীয় ভাগ—রহস্যত্রয় । এক্ষেত্রে ভাগসমূহের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
প্রথম ভাগে আবার চারটি বিষয় আছে। যথা- (১) দেবীসূক্ত, (২) অর্গলা-স্তোত্র, (৩) কীলক এবং (৪) চণ্ডীকবচ। এই চারটি স্তোত্র না পড়ে চণ্ডীপাঠ করা নিষেধ। চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ করতে হলে বা চণ্ডীপাঠ সফল ও সার্থক করতে হলে, এই চারটি স্তোত্র আগে পাঠ করে এর মর্ম অনুধাবন করা আবশ্যক।
প্রথম ভাগ—দেবী মাহাত্ম্যের উপক্রমণিকা
দেবীসূক্ত—ঋগ্বেদের অন্তর্গত আটটি মন্ত্র। এর ঋষি ছিলেন মহর্ষি অম্ভৃণ এর কন্যা ব্রহ্মবিদুষী বাক্। বাক্ ব্রহ্মশক্তিকে স্বীয় আত্মারূপে অনুভব করে বলেছিলেন, “আমিই ব্রহ্মময়ী আদ্যাদেবী ও বিশ্বেশ্বরী”। শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থের মূল উপাদান ও ভিত্তি ঋগ্বেদের এই দেবীসূক্ত। দেবীসূক্তের পরমাত্মাই চণ্ডীগ্রন্থে মহামায়ারূপে বর্ণিত হয়েছেন। সুতরাং বেদের ব্রহ্ম বা পরমাত্মা এবং পুরাণের মহামায়া এক ও অভিন্ন সত্ত্বা। দেবীসূক্তে যা আত্মা, চণ্ডীগ্রন্থে তা-ই মহামায়া। দেবীসূক্তে পরমাত্মার মাতৃভাব বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে। পরমাত্মার পিতৃভাব ও মাতৃভাব উভয়ই জীবের উপাসনার বিষয়। দেবীসূক্ত আলোচনা করলে ব্রহ্মাদি দেবগণ ও স্বর্গাদি-লোক-সকল প্রসবিনী ব্রহ্মস্বরূপিনী মায়ের স্বরূপ সম্পর্কে খানিকটা ধারণা হয়।
অর্গলা-স্তোত্র—চণ্ডীপাঠের বিঘ্ন নাশ, অভীষ্ট সিদ্ধির প্রতিবন্ধ দূর ও বহির্মুখ মনকে অন্তর্মুখী বা মাতৃমুখী করার জন্য এই অর্গলা-স্তোত্র পাঠ করতে হয়। অর্গল শব্দের অর্থ খিল বা হুড়কো। যেমন, দ্বারে অর্গল বা খিল দ্বারা বদ্ধ করলে বাইরের কেউ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না, অনুরূপভাবে এই অর্গলা-স্তোত্র পাঠ করলে কোন বিঘ্ন বা বিপদ আসতে পারে না এবং বাহ্য বিষয় চিত্ত-ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পারে না। এই স্তোত্রে মাতৃমহিমার কথা খুব বেশি আছে। সে’জন্য এ-তে সিদ্ধি-প্রতিবন্ধক-রূপ পাপ নাশ হয়।
কীলক—‘কীলক’ অর্থ শাপ। দেবী-মাহাত্ম্য গ্রন্থের উপর মহাদেব-কৃত শাপ আছে। এই কীলক স্তুতি সেই শাপের উদ্ধার মন্ত্র। কীলক পাঠ করে চণ্ডীপাঠ করলে মহাদেব-কৃত শাপের যেমন উদ্ধার করা হয় তেমনই পাঠকের অভীষ্টসিদ্ধি হয়। কীলক পাঠ না করে যিনি চণ্ডীপাঠ করবেন, তিনি চণ্ডীপাঠের ফল পাবেন না, পূর্ণকাম হবেন না। তাই চণ্ডীপাঠের অধিকারী হতে হলে এই কীলক পাঠ করতে হবে।
‘কীলক’ এর আর একটি অর্থ ‘চাবি’। তালাবদ্ধ ঘরে চাবি দিয়ে তালা খুলে যেমন ঘরের ভেতর প্রবেশ করা যায়, সে’রূপ গহন চণ্ডীতত্ত্বে প্রবেশ করতে হলে কীলক পাঠ দ্বারা তালা খুলতে হয়। চণ্ডী-রহস্য সাধারণের নিকট যাতে সহজে প্রকাশিত না হয়, তাই মহাদেব তা তালা দিয়ে অতি সঙ্গোপনে রাখলেন। যে ভক্ত চণ্ডী-রহস্য জানতে চায়, তাকে মহাদেবের এই তালা খুলতে হবে। কীলক-স্তবই এর চাবি। কীলক পাঠ করলেই সেই তালা খুলে যায় আর পাঠকের নিকট চণ্ডী-রহস্য প্রকাশিত হয়।
‘কীলক’ এর আর একটি অর্থ খোঁটা। যেমন, যাঁতার মধ্যস্থানে খোঁটার গোড়ায় যে সকল ছোলা বা মটর থাকে সেগুলো যাঁতার পেষণে চূর্ণ হয় না, সে’রূপ যে সকল ভক্ত ভগবানের পাদপদ্মরূপ ‘কীলক’ অবলম্বন করে থাকে, তারা সংসারের পেষণে, শোকে ও দুঃখে চূর্ণ হয়ে যায় না বরং মহামায়ার আশ্রয় লাভ হয়।
অর্গলায় যেমন বিঘ্ননাশ হয়, তেমনি কীলকে অভীষ্টসিদ্ধি হয়।
কবচ—কবচ অর্থ বর্ম বা অঙ্গত্রাণ; যা পরিধান করে থাকলে শত্রুনিক্ষিপ্ত অস্ত্র-শস্ত্রাদি অঙ্গে লাগে না। কবচ দ্বারা দেহ আবৃত রাখলে শত্রুর আঘাত থেকে দেহ-রক্ষা হয়। চণ্ডী-কবচ পাঠ করলে আত্মরক্ষা করা যায়। এই কবচ পাঠে নিজের স্থূল দেহ দশদিক হতে আগত বিপদসমূহ থেকে রক্ষা পায়। দেবীকে নিজ স্থূলদেহের বিভিন্ন অংশে কী কী ভাবে ন্যাস করতে হয়; কী প্রকারে নিজের সূক্ষ্মদেহকে অর্থাৎ মন, বুদ্ধি, চিত্ত ও অহঙ্কারকে রক্ষা ও চালনা করার ভার মা চণ্ডীকে দিতে হয়; কী প্রকারে নিজের যশ, কীর্তি, সন্তান-সন্ততি, গৃহপালিত পশুপক্ষী, সম্পদ, ধর্ম, কর্ম প্রভৃতি সকল বিষয়ের সম্পূর্ণ ভার দেবী চণ্ডিকাকে দিতে হয়; কী প্রকারে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এই চতুর্বর্গ পুরুষার্থ কেবলমাত্র ব্রহ্মশক্তির শরণাগত হলে লাভ করা যায়—এই চণ্ডীকবচে তা-ই বিশেষভাবে বর্ণিত আছে। তাই চণ্ডীকবচ আশ্রয় করলে জীব ইহলোকে বিবিধ ভোগ-সুখ পায় এবং জীবনান্তে মোক্ষ প্রাপ্ত হয়।
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিভক্ত। মা চণ্ডীর তিনটি চরিত্রের কথা নিয়েই—চণ্ডীগ্রন্থ। এগুলো হচ্ছে–প্রথম চরিত্র, মধ্যম চরিত্র ও উত্তর চরিত্র।
মায়ের প্রথম চরিত্র নিয়ে প্রথম অধ্যায়—মধুকৈটভবধ। মধু ও কৈটভ নামক অসুরদ্বয়ের বিনাশার্থে ব্রহ্মার স্তবে আবির্ভূতা এক তামসী ( তমঃপ্রধানা, যোগনিদ্রারূপা ) দেবীর আবির্ভাবের কথা এক্ষেত্রে বর্ণিত হয়েছে। এই চরিত্রের দেবতা তমোরূপা মহাকালী। মায়ের এই চরিত্রকে ব্রহ্মগ্রন্থি-ভেদ বলে। মধুকৈটভ বধের আধ্যাত্মিক ভাব—লোভ নামক রিপু দমন।
গ্রন্থের দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ অধ্যায় মায়ের মধ্যম চরিত্র। এক্ষেত্রে মায়ের দুর্গামূর্তির আবির্ভাব, সসৈন্য মহিষাসুর বধ ও দেবতাগণের মাতৃস্তুতি বর্ণিত হয়েছে। মায়ের এই চরিত্রকে বিষ্ণুগ্রন্থি-ভেদ বলে। মহিষাসুর বধ বা ক্রোধ নামক রিপু দমন এর কাজ। মধ্যম চরিত্রের দেবতা মহালক্ষ্মী।
উত্তর চরিত্র—গ্রন্থের পঞ্চম হতে ত্রয়োদশ অধ্যায়। শুম্ভ-নিশুম্ভ অসুরদ্বয়ের অত্যাচারে পীড়িত ও লাঞ্ছিত দেবতাদের দ্বারা দেবী চণ্ডিকার স্তব, অম্বিকা দেবীর কৌষিকী মূর্তিতে আবির্ভাব, দেবীদূত-সংবাদ, ধূম্রলোচন, চণ্ডমুণ্ড, রক্তবীজ, নিশুম্ভ ও শুম্ভ প্রভৃতির সঙ্গে দেবীর যুদ্ধ ও তাদের বধ, দেবতাদের কৃতজ্ঞতা-প্রকাশক নারায়ণীস্তুতি, দেবীর প্রসন্নতা ও দেবতাদের বরদান, দেবীর ভবিষ্যৎ বিবিধ অবতার গ্রহণের বিবরণ এবং দেবীমাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণের ফল পঞ্চম হতে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্ত বিশেষ ভাবে বর্ণিত আছে। শেষ বা ত্রয়োদশ অধ্যায়ে মেধা মুনির উপদেশে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের দেবী-আরাধনা ও সিদ্ধিলাভ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। মায়ের এই চরিত্রকে রুদ্রগ্রন্থি-ভেদ বলে। শুম্ভবধ বা কাম রিপু জয় এর কাজ। মায়ের এই চরিত্রের দেবতা মহাসরস্বতী।
তৃতীয় ভাগ—রহস্যত্রয়
শ্রীশ্রীচণ্ডীগ্রন্থের শেষভাগে অপরাধ-ক্ষমাপণ-স্তোত্রম্, সপ্তশতীরহস্যত্রয় ও শ্রীশ্রীচণ্ডীপাঠের ফল আছে। সপ্তশতীরহস্যত্রয় এখানে আলোচ্য বিষয়। (১) প্রাধানিক-রহস্য, (২) বৈকৃতিক-রহস্য ও (৩) মূর্তি-রহস্য—এই তিনটিকে রহস্যত্রয় বলে। এতে যথাক্রমে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী মূর্তির রহস্যের কথা আছে। দেবী চণ্ডিকাই এই তিনটি মূর্তিতে আবির্ভূতা হন। তিনি স্ত্রীও বটে আবার পুরুষও বটে। বলা হয়েছে-
অর্থাৎ ‘হে নৃপ, ইনি হস্তে লেবু ( বা শ্রীফল ), গদা, খেট ( চর্ম ) ও পানপাত্র ধারণ করেন এবং মস্তকে নাগ ( ব্রহ্মার চিহ্ন ), লিঙ্গ ( শিবের চিহ্ন ) ও যোনি ( বিষ্ণুর চিহ্ন ) ধারণ করেন’।
‘পরে যুবতীগণ সদ্য পুরুষত্ব ( মহালক্ষ্মী ব্রহ্মত্ব, মহাকালী রুদ্রত্ব ও মহাসরস্বতী বিষ্ণুত্ব ) প্রাপ্ত হলেন। চক্ষুষ্মান্-( জ্ঞানি- ) গণ এই তত্ত্ব দর্শন করেন (অবগত হন), অপরে ( অজ্ঞানীরা ) নয়। কারণ, উক্ত তত্ত্ব জ্ঞানচক্ষুর দৃশ্য, চর্ম-চক্ষুর অদৃশ্য’।
দেবী চণ্ডিকা সাকারা ও নিরাকারা দুইই, সমকালে। তাঁর অনেক রূপ ও অনেক নাম।
অর্থাৎ ‘হে মহারাজ, সর্বসত্ত্বময়ী, ঈশ্বরী মহালক্ষ্মী নিরাকারা নির্গুণা হয়েও সাকারা ( সগুণা )। সাকার অবস্থায় তিনি বিবিধ নাম ও রূপ ধারণ করেন। নির্গুণরূপে তিনি সত্য, জ্ঞান ও আনন্দ—এই স্বরূপলক্ষণের দ্বারা নিরূপ্যা ( লক্ষণীয়া ), কিন্তু প্রত্যক্ষ্যাদি অন্য কোন প্রমাণ দ্বারা বোধ্য নন’ ।
মধুকৈটভ বধের জন্য বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপিনী দেবী চণ্ডিকার নাম তমগুণময়ী মহাকালী।
সকল দেবতার শরীর হতে যে অমিতপ্রভা দেবী আবির্ভূতা হয়েছিলেন, তিনিই ত্রিগুণময়ী মহিষমর্দিনী সাক্ষাৎ মহালক্ষ্মী। ( চণ্ডী, ২।১০-১৩ দ্রষ্টব্য। ) তিনি ক্রমে ক্রমে অষ্টভুজা, দশভুজা, অষ্টাদশভুজা এবং সহস্রভুজা হয়েছিলেন।
ধূম্রলোচন, চণ্ড, মুণ্ড, রক্তবীজ, নিশুম্ভাদি অসুরদলন করার জন্য যে কালী মূর্তিতে দেবী চণ্ডিকা আবির্ভূতা হয়েছিলেন, সেই চণ্ডিকাদেবীই সত্ত্বগুণময়ী মহাসরস্বতী।