বিষয়টি গুহ্য তন্ত্র সম্বন্ধীয় যেখানে হিন্দু তন্ত্র ও বৌদ্ধ তন্ত্রের সম্পৃক্ততা নিয়ে কিছু তথ্য দেবো যা সংগ্রহ করতে পেরেছি
আজ বাসবদত্তা দিয়ে শুরু করি। বৌদ্ধদের ‘বাসবদত্তা’ বেতালা দেবীর মন্দিরের উল্লেখ করে তার অস্তি। বৌদ্ধ তন্ত্রে বজ্র বেতালীর কথা রয়েছে। মার্কণ্ডেয় ‘চণ্ডী’তে শক্তির মায়ূরী, কৌবেরী, অপরাজিতা, কপালিনী, বারাহী, ভীমা, প্রভৃতি রয়েছে। তেমনি বৌদ্ধ মতেও ভীমা, অপরাজিতা, বজ্রবারাহী, কপালিনী, কৌবেরী, মায়ুরী দেবীর উল্লেখ পাই।
দেবী চন্ডী শিবকে দূতরূপে পাঠিয়েছিলেন বলে দেবীকে ‘শিবদূতী’ বলা হয়। বৌদ্ধ তন্ত্রে দেবীকে ‘কালদূতী’ নামে দেখা যায়। পর্ণশবরী দেবী দুর্গার একটি প্রসিদ্ধ নাম। পর্ণ পরিহিতা পর্ণশবরীর কথা বৌদ্ধ ‘সাধনমালাতেও পাওয়া যায়। কালী ও ছিন্নমস্তা যা দশমহাবিদ্যার অংশ, আমরা বৌদ্ধ ধর্মেও এঁর দেখা পাই। বর্ণনায় দেখা যায়, ইনি ভয়ঙ্করী, দুই হস্ত বিশিষ্টা, অগ্নিকোণস্থিতা, নীলবর্ণা একহাতে কঙ্কাল ও অন্যহাতে অস্ত্র এবং শবের উপর অবস্থিতা।
বুদ্ধতন্ত্রের রচনা হিন্দু ধর্মের তুলনায় প্রাচীন হওয়ায় বৌদ্ধতন্ত্রে যেসব দেবীর নাম পাওয়া যায়, হিন্দুধর্মে তাঁদেরকে দেখে ধারণা হতে পারে যে এই দেবীরা মূলতঃ বৌদ্ধ দেবী এবং বৌদ্ধধর্ম থেকেই হিন্দুধর্মে স্থানান্তরিত হয়েছেন।
কিন্তু আসলে হিন্দু বা বৌদ্ধ তন্ত্র বলে আলাদা কিছু নেই। মূল দর্শন, সাধনা ও বিষয়ের মধ্যে কোন তফাত নেই। তন্ত্র একটি স্বতন্ত্র সাধনা পদ্ধতি এবং এই সাধনা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হিন্দু তত্ত্বের সাথে যুক্ত হয়ে একে হিন্দু তন্ত্রের রূপ দান করেছে। আবার বৌদ্ধ তত্ত্বের সাথে যুক্ত হয়ে এটি বৌদ্ধতন্ত্রের রূপ দান করেছে। উভয়ক্ষেত্রেই দেবদেবী, উপদেবী, ডাকিনী-যোগিনী, যক্ষ-রক্ষ প্রভৃতির বর্ণনা, পূজা-বিধি বা ধ্যান-অর্চনাবিধি সবই প্রায় এক। উভয়ক্ষেত্রেই সমাজের বিভিন্ন স্তর প্রবণতায় পরিকল্পিতভাবে স্থানীয় দেবদেবীর মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। বৌদ্ধ দেবী হিসাবে বজ্র, শূন্যতা, করুণা, বোধিচিত্ত, প্রজ্ঞা প্রভৃতির নামোল্লেখ আছে। সাধনার ক্ষেত্রে সকল মন্ত্র ও তন্ত্রযোগ একই। আসলে হিন্দু ও বৌদ্ধ দেবীর উৎপত্তির ইতিহাসে বিশেষ পার্থক্য নেই।
বৌদ্ধতন্ত্রগ্রন্থ সাধনমালায় উড্ডিয়ান, কামাখ্যা, শ্রীহট্ট ও পূর্ণগিরি এই চারটি তন্ত্র পীঠস্থান বলে উল্লেখ আছে, যা বৌদ্ধদেবী বজ্রযোগিনীর পূজার জন্য বিখ্যাত ছিলো। তাছাড়া নালন্দা,সারনাথ বিক্রমশিলা, ওদন্তপুরী, জগদ্দল ইত্যাদি প্রাচীন বৌদ্ধ বিদ্যাপীঠস্থান বজ্রযান অর্থাৎ বৌদ্ধ তন্ত্র অনুশীলনের জন্য বিখ্যাত। পূর্ববঙ্গ ও আসামই তন্ত্রের আদি স্থান। এই স্থানে তান্ত্রিক বজ্রযানের উৎপত্তি হয় এবং এই স্থান থেকেই নিকটবর্তী প্রদেশগুলিতে ছড়িয়ে পরে। এইসব স্থানে তন্ত্র ও যোগমার্গের উপদেশ দেওয়া হত এবং ছাত্রদের শিক্ষা দেওয়া হত। বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যায় বজ্রযানের প্রভাব অত্যধিক ছিল এবং এইসকল স্থানেই বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি সর্বাপেক্ষা বেশি দেখা যেত।
বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবদেবীর সাধনার কথা গুহ্যসমাজতন্ত্রে উল্লিখিত হয়েছে। লামা তারানাথ নামক এক তিব্বতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিতের মতে তন্ত্রের উৎপত্তি আগেই হয়েছিল, কিন্তু প্রায় তিন শত বৎসর সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং গোপনভাবে গুরুশিষ্য পরম্পরায় ছিল। পাল রাজত্বের সময় সিদ্ধাচার্যদের দ্বারা তা জনপ্রিয় হইয়া ওঠে।
শক্তির ধারণার ফলে আদিম তান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠান মহাযান বৌদ্ধধর্মে সম্পৃক্ত হয়। বৌদ্ধ গুহ্যতন্ত্রে মুদ্রা, মাংস ও মৈথুনকে সাধনার অঙ্গ বলা হয়েছে। নারীপুরুষের সম্মিলিত মিথুনমূর্তির দ্বারা বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও তাঁদের শক্তিসমূহ উপস্থাপিত হতে শুরু করে। এই সব গুহ্য, রহস্যময়, গূঢ়ার্থক মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী বীজ, ম প্রভৃতি সমস্ত আদিম কৌম সমাজের যাদুশক্তিতে বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত।
বৌদ্ধতন্ত্রে আচার্য অসঙ্গ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, পর্বত কান্তারবাসী সুবৃহৎ কৌম-সমাজকে বৌদ্ধধর্মের সীমার মধ্যে আকর্ষণ করার জন্য ভূত, প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী, পিশাচ ও মাতৃকাতন্ত্রের নানা দেবী প্রভৃতিকে অসঙ্গ মহাযান দেবায়তনে স্থান দান করেছিলেন। নানা গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী প্রভৃতিও প্রবেশ করেছিল মহাযান ধ্যান-কল্পনায়, পূজাচারে, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে এবং তাহাও অসঙ্গেরই অনুমোদনে।
এই সব গুহ্য, রহস্যময়, গূঢ়ার্থক মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী বীজ, মণ্ডল প্রভৃতি সমস্তই আদিম কৌম সমাজের যাদুশক্তি থেকে উদ্ভুত। বৌদ্ধ-দোহা ও গীতিগুলির মধ্যে আমরা এক ‘দেবী’র উল্লেখ দেখিতে পাই। এই দেবী নৈরাত্মা, নৈরামণি, ডোম্বী, চণ্ডালী, মাগঙ্গী, শবরী প্রভৃতি নানা নাম
আদিবুদ্ধের পঞ্চ প্রকারের ধ্যান আছে, যার প্রত্যেকটি ধ্যান থেকে এক জন ধ্যানিবুদ্ধর উদ্ভব।এঁরা হলেন বৈরোচন, রত্নসম্ভব, অমিতাভ, অমোঘসিদ্ধি এবং অক্ষোভ্য। এই পঞ্চ ধ্যানিবুদ্ধই যথাক্রমে রূপ-বেদনা-সংজ্ঞা-সংস্কার-বিজ্ঞান এই পঞ্চস্কন্ধের দেবতা। সৃষ্টি এই পঞ্চস্কন্ধাত্মক। এই পঞ্চ ধ্যানিবুদ্ধের পঞ্চশক্তি তারা বা বজ্রধাত্বীশ্বরী, মামকী, পাণ্ডরা, আর্যতারা এবং লোচনা। বহুকাল অবধি তাঁহারা যন্ত্রে থাকতেন। তাঁদের মূর্তি ছিল না।ক্রমে তাঁদেরও মূর্তি হল। পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের পঞ্চ শক্তিতে পাঁচ জন ‘বোধিসত্ত্ব’ হলেন। তাঁহাদের মধ্যে ‘মঞ্জুশ্রী’ ও ‘অবলোকিতেশ্বর’ প্রধান। বর্তমান কল্পে অর্থাৎ ভদ্রকল্পে ‘অমিতাভ’ প্রধান ধ্যানীবুদ্ধ। তাঁর বোধিসত্ত্ব অবলোকিতেশ্বর– প্রধান বোধিসত্ত্ব।পঞ্চ-তথাগত মনুষ্যদেহের মস্তক, মুখ, হৃদয়, নাভী ও পাদদেশ এই পঞ্চস্থানে অধিষ্ঠান করেন।
বৌদ্ধতন্ত্রে বলে সাধনা করলে প্রথমে শূন্যতার বোধ হয়, দ্বিতীয়ে বীজমন্ত্রের দর্শন হয়, তৃতীয়ে বীজমন্ত্র হইতে বিম্ব অর্থাৎ দেবতার অস্পষ্ট আকার দেখা যায় এবং অবশেষে দেবতার সুস্পষ্ট মূর্তি দর্শন হয়। সে মূর্তি অতি রমনীয়, সর্বাঙ্গসুন্দর কল্পনার অতীত, স্বর্গীয় বর্ণে রঞ্জিত এবং নানাপ্রকার দিব্য বস্ত্র অলংকার ও অস্ত্রশস্ত্রে শোভিত। একবার দেখিলে তাহা আর জীবনে বিস্মৃত হওয়া যায় না।’( বৌদ্ধদের দেবদেবী, উপোদ্ঘাত, পৃষ্ঠা ১৮-২১)
অনেক ডাকিনী, যোগিনী, পিশাচী, যক্ষিণী, ভৈরব, বুদ্ধগণের উপাস্য হইয়া দাঁড়ায়। এক ‘অভিধ্যানাত্তরতন্ত্রে’ ‘সম্বরবজ্র’ ‘পীঠপর্ব’ ‘বজ্রসত্ত্ব’ ‘পীঠদেবতা’ ‘ভেরুক’ ‘যোগবীর’ ‘পীঠমালা’ ‘বজ্রবীর-ষড়যোগসম্বর’ ‘অমৃতসঞ্জীবনী’ ‘যোগিনী’ ‘কুলডাক’ ‘যোগিনী যোগ-হৃদয়’ ‘বুদ্ধকাপালিকযোগ’ ‘মঞ্জুবজ্র’ ‘নবাক্ষরালীডাক’ ‘বজ্রডাক’ ‘চোমক’ প্রভৃতি অনেক ভৈরব ও যোগিনীর পূজাপদ্ধতি আছে। বোধিসত্ত্ব ও যোগিনীগণের ধ্যানকে সাধন বলে। যে পুস্তকে অনেক ধ্যান লেখা আছে তাহাকে ‘সাধনমালা’ বলে। একখানি ‘সাধনমালা’য় দুই শত ছাপ্পান্নটি সাধন আছে। ‘বজ্রবারাহী’, ‘বজ্রযোগিনী’, ‘কুরুকুল্লা’, ‘মহাপ্রতিসরা’, ‘মহামায়ূরী’, ‘মহাসাহস্র প্রমর্দ্দিনী’ প্রভৃতি অনেক যোগিনীর ধ্যান এতে আছে।
হিন্দু-তন্ত্রে যেমন শিব ও শক্তিকে অবলম্বন করে মিথুন তন্ত্র সাধনা গড়ে উঠেছে, তেমনই বৌদ্ধ-তন্ত্রেও করুণারূপী ভগবান্ ও প্রজ্ঞারূপিণী দেবী ভগবতীকে নিয়ে তান্ত্রিক মিথুন-সাধনা গড়ে উঠেছে। যোগ-সাধনায় এই ভগবতী এবং ভগবান্ ইড়া-পিঙ্গলা, গঙ্গা-যমুনা, বাম-দক্ষিণের রূপ গ্রহণ করেছেন।
অদ্বয়তত্ত্বই অর্ধনারীশ্বর তত্ত্ব– বামে দেবী ভগবতী, দক্ষিণে ভগবান্, দুই মিলে এক। তন্ত্রসাধনার এই ভগবান্ এবং ভগবতী পূর্বে বর্ণিত আদিবুদ্ধ ও আদিদেবীর সাথে সম্পৃক্ত হবার ফলে বৌদ্ধ তন্ত্রেও আমরা এক সর্বেশ্বর ভগবান্ এবং সর্বেশ্বরী ভগবতীর কথা পাই যিনি সাধারণতঃ শ্রীহেবজ্র, শ্রীহেরুক, শ্রীবজ্রধর, শ্রীবজ্রেশ্বর, শ্রীবজ্রসত্ত্ব, মহাসত্ত্ব, শ্রীমন্মহাসুখ, শ্রীচণ্ডরোষণ প্রভৃতি রূপ ধারণ করেছেন। সর্বেশ্বরী দেবী তাঁর অঙ্কবিহারিণীরূপে অথবা মিথুনাবস্থায় তাঁর সাথে যুক্ত। তিনি কোথাও বজ্রধাত্বীশ্বরী, বজ্রবারাহী, কোথাও ভগবতীপ্রজ্ঞা বা প্রজ্ঞাপারমিতা অথবা দেবী নৈরাত্মা। স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু মহেশ্বর-মহেশ্বরী এবং বৌদ্ধ সর্বেশ্বর-সর্বেশ্বরী বহু স্থানে একাকার হয়ে আছেন।
বৌদ্ধতন্ত্রের পরিণতি সম্পর্কে অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায়ের পর্যবেক্ষণ হলো–
‘বজ্রযান ও কালচক্রযানে ব্যবহারিক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্ষীণ হইলেও শ্রাবকযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের কিছু আভাস তবু বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ক্রমশ এই ধর্মের ব্যবহারিক অনুষ্ঠান কমে আসতে থাকে এবং সাথে সাথে গুহ্য সাধনা বাড়তে আরম্ভ করে অবশেষে গুহ্য সাধনটাই প্রবল ও প্রধান হয়ে দেখা দেয়।
নাথপন্থার চরম আদর্শ হচ্ছে নিজের মধ্যে অদ্বয়ের উপলব্ধি যা সম্ভব অমরত্ব অর্জন ও দিব্য দেহের দ্বারা। কায়সাধনের দ্বারা দিব্যদেহ লাভ করা যায়। চন্দ্র হচ্ছেন সোম বা অমৃতের উৎস যিনি মানবদেহে অবস্থিত সহস্রা অঞ্চলের (মস্তিষ্ক প্রদেশ) নীচে থাকেন। যে নির্যাস পরিদৃশ্যমান মানবদেহকে টিকিয়ে রাখে তা উৎপন্ন হয় ওই সোম বা অমৃত থেকে। একে ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলেই অমরত্ব অর্জন করা যায়। কিন্তু এখানে একটি বিরাট অসুবিধা আছে। দেহের মধ্যে অবস্থিত চন্দ্র বা সোম থেকে ক্ষরিত অমৃতবিন্দু সূর্য শুষে নেন, যে সূর্য বাস করেন মানবদেহের নাভিমূলে। কাজেই এই অমৃতকে সূর্যের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। সেটা একটি উপায়ে করা সম্ভব। দেহের মধ্যে একটি আঁকাবাঁকা সর্পাকার নালী আছে যার দুটি মুখ এবং যা শঙ্খিনী নামেও পরিচিত। এই নালীর মুখটি, যা দিয়ে সোম ক্ষরিত হয়, দশম দ্বার নামে পরিচিত। এই মুখটি বন্ধ করতে পারলেই কাল বা মৃত্যুরূপী সূর্যের গ্রাস থেকে সোম বা অমৃতকে রক্ষা করা সম্ভব। এর জন্য কায়সাধন দরকার। কোন কোন গ্রন্থে তান্ত্রিক কুলকুণ্ডলিনীকে জাগানোর পদ্ধতির দ্বারাই অমৃতক্ষরণ রোধ করা যাবে এমন কথাও বলা হয়েছে।’- (নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস)। বৌদ্ধ-তন্ত্রের চক্রভেদ যোগমার্গে যে তিনটি প্রধান নাড়ীর উপর সিদ্ধাচার্যদের যোগ-সাধন প্রক্রিয়ার নির্ভর, তার প্রধানতমটির নাম অবধূতী। অবধূত-যোগ এই অবধূতী নাড়ীর গতি-প্রকৃতির উপর নির্ভর করতো।