প্রবন্ধে মৃদুল শ্রীমানী

বাংলার ভূমি সংস্কার : ফিরে দেখা
আমি রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি পড়েছিলাম, আর তখন থেকেই জানতাম পরাধীন ভারতে গরিব মানুষের হাতে জমির পরিমাণ কমে আসছিল। যে জমিটুকু হদ্দ গরিবের হাতে থাকত, তার উৎপাদিকা শক্তি ছিল সামান্য। ফসলের ক্ষেতে রোগ পোকার আক্রমণ ছিল, ছিল অনাবৃষ্টি, খরা ও অজন্মা। ছিল পঙ্গপালের আক্রমণ আর অতি বৃষ্টির সমস্যা।
জঙ্গল কেটে হাসিল করা বেশিরভাগ জমির মালিকানা পরিশ্রমী মজুরের হাতে আসে নি। ব্রিটিশ আমলে সমস্ত জমির মালিক ছিল ব্রিটিশ সরকার। আর জমিদারেরা ছিল খাজনা আদায়ের এজেন্সি। জমিদারের তরফে বাৎসরিক নির্দিষ্ট খাজনা ব্রিটিশ সরকারকে গুণে দিতে পারলেই প্রজার গলায় পা দিয়ে তার অনেক বেশি টাকা আদায় হতে পারত।
খাজনা আদায়ের ব্যাপারে অত্যাচার করা ছিল জমিদারের পক্ষে স্বাভাবিক আচরণ। ব্রিটিশ আমলে কোর্ট কাছারিতে জমিদারের বিরুদ্ধে গরিব মানুষের সুবিচার মেলা ছিল ভারি শক্ত ব্যাপার।
জমিদারেরা লেঠেল পুষত, বন্দুক রাখত। গরিব মানুষ মাথা তুলতে চাইলে তার ঘরে দোরে আগুন লাগিয়ে তাকে উচ্ছেদ করা ছিল সামান্য ব্যাপার। আসমানদারিতে অভ্যস্ত এক কবি জমিদার তাঁর অপূর্ব লেখনীতে হালদার গোষ্ঠী গল্পে সে সব লিখেছেন।বেশ মনে করতে পারি জমিদার তার সব কিছু উপযুক্ত পুত্রের হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেলেন। এবার থেকে ছেলেই জমিদারী দেখুন। তিনি থাকবেন বিরলে । কোলাহল থেকে অনেক দূরে ।
কিন্তু একবার তাঁকে আসতে হল। নতুন জমিদার প্রজাদের উপর বড়ো উৎপাত করে চলেছেন। গরিব প্রজার হয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে অছিমদ্দি । মুসলমান তরুণটি । নয়া জমিদার সেই রুখে দাঁড়ানো মুসলমান তরুণকে কেসে কেসে জেরবার করে দিচ্ছেন।
প্রাক্তন জমিদার এসে তার পুত্রকে সংযত হতে অনুরোধ করলেন। বললেন , অছিমদ্দি কে নিজের ছোট ভাই জ্ঞান করতে।
নয়া জমিদার বাবার দিকে বাঁকা চোখে তাকালেন । জানতে চাইলেন ” অছিমদ্দি আপনার সন্তান?”
বৃদ্ধ স্মিত মুখ ।
নয়া জমিদার আরও স্পষ্ট করে জানতে চাইলেন ” যবনী গর্ভে ? ”
বৃদ্ধ বললেন ” হাঁ বাবা।”
রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প । গল্পগুচ্ছে পড়েছি।
হিন্দু জমিদার কি সাঙ্ঘাতিক দাপটে প্রজার উপর অত্যাচার করত, তার বিবরণ শরৎ সাহিত্যেও ছিল। ‘মহেশ’ গল্পে সর্ব সাধারণের গরু মহিষের খাবারের যোগানের জন্য রাখা গোচর জমি হিন্দু জমিদার পয়সার লালচে বন্দোবস্ত দিয়ে দিয়েছিল। গরিব মুসলমান প্রজা গফুর মিঞা পড়ল বিপদে। সে মহেশকে খাবার জোগাতে গিয়ে সমস্যায় পড়ল। শেষ অবধি কন্যা আমিনার হাত ধরে ভিটে মাটি ত্যাগ করে চটকলের মজুর হবার পথে পা বাড়ায় গফুর মিঞা।
হিন্দু ব্রাহ্মণ জমিদার নিজের যৎসামান্য লাভ অক্ষুণ্ন রাখতে গিয়ে বিস্তর প্রজার সংবৎসরের অন্ন কেড়ে নিতে মনের ভিতরে বাধা পেত না। ‘পল্লী সমাজ’ উপন্যাসে ছোট তরফের বেণী ঘোষালের ফন্দিতে বড় তরফ রমা মুখোপাধ্যায়ও সায় দিয়েছিল। ছোট তরফের আরেক শরিক রমেশ ঘোষাল নিজের মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়েছিল। সেই সূত্রে আকবর লাঠিয়ালের কথা শরৎ সাহিত্যে অমর হয়ে আছে।
মনে পড়ে ওই যে হরিহরের সংসার। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পথের পাঁচালির কথা বলছি। পুরোহিতবৃত্তি করে হরিহর সংসার চালান। জমি জমা সে রকম নেই বলেই মনে হয়। জমি বাবদ তাই আয় নেই। গ্রামে বেশিরভাগ লোকে দরিদ্র। বামুন পুরুতকে দেবে কি? হরিহরের না আছে কারিগরি শিক্ষা, না আছে খেটে খাবার মানসিক গঠন। ওই বইপত্র পাঁজি পুঁথি নিয়ে দিন কাটানো লোক।
সর্বজয়া যে কি করে সংসার চালাতেন কে জানে? ইন্দির ঠাকরুণের গায়ের চাদর ছিঁড়ে গেছে। অভাব অনটনের সংসারে তাকেই বা ভাত যোগায় কে? মেয়েটা বড় হচ্ছে। তার পোশাক আশাক তেমন না দিলে চলে কি করে?
আসল দরকার ছিল হরিহরের যথার্থ কর্মসংস্থান। সেটা আমাদের বাংলাদেশে ছিল কি?
রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সাহিত্য চর্চা করার অভ্যাস ছিল। কালান্তর প্রবন্ধ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের হাহুতাশ দেখেছি, বাংলাভূমির নদীর ফাঁকা চরে পশ্চিমা লোকে শসা কাঁকুড় ফলিয়ে বেশ দু পয়সা করে নেয়, তবু বাংলাভূমির আদত চাষি ধানের পরে আর কিছু করতে চাইত না। মনের জোর ছিল না বাংলার সাধারণ চাষির। চাষিকে আধুনিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত করার দায় ব্রিটিশ নেয় নি। মহাজনের কবল থেকে বাঁচানোর উদ্যোগও নেয় নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের খরচে ছেলে রথীন্দ্রনাথ আর জামাই নগেন্দ্রনাথকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন, আধুনিক কৃষিবিদ্যা শিখে আসতে। আর বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্রকে গো পালন বিদ্যা শিখে আসার খরচ জুগিয়েছিলেন। কাজ কিছুই এগোয় নি, কেননা জমিদারের ছেলে ও জামাইয়ের ওসব কাজে ভিতরের আগ্রহ ছিল না। তাঁরা কাজের মানুষও ছিলেন না।
অনেক পরে রবীন্দ্রনাথের জীবনে আসবেন লেনার্ড এলমহার্স্ট। কৃষি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করা একজন ডিসিপ্লিনড মজবুত লোক। এসে শ্রীনিকেতনের হাল ধরবেন।
বাংলার চাষি মহাজনের হাতে নির্মম ভাবে শোষিত হত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চাষিকে বাঁচাতে নোবেল পুরস্কারের টাকায় ব্যাঙ্ক গড়েছিলেন। কার্যকরী শিক্ষার অভাবে ব্যাঙ্ক ব্যবসা নষ্ট হয়।
বাংলার চাষিকে কে না শুষত? সময়ে খাজনার টাকা না জোগাতে পারলে গরিব বাঙালি চাষির উপর বাঙালি জমিদারের অকথ্য অত্যাচারের কথা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখে গিয়েছেন। ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’ বেশ মনে পড়ে। আর ছিল নীলকরের অত্যাচার। চাষির উপর অত্যাচার ঠেকাতে হাকিম উকিল দারোগা পুলিশ কেউ ছিল না। হরিশ মুখোপাধ্যায় এর মত এক আধ জন সাংবাদিক এখানে ওখানে ছিলেন। তাঁরাই গরিবের উপর অত্যাচারের কথা তুলে ধরে সর্ব সমক্ষে আনতেন। এর মধ্যে দিয়ে আসছিল স্বাধীনতা আন্দোলন। কিন্তু স্বাধীনতা এলে ঠিক কি চেহারায় আসবে তাই নিয়ে মহৎ লেখকদের গভীর উদ্বেগ ছিল। যে কায়দায় স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছিল, তাতে বেশ বোঝা যাচ্ছিল শেষ পর্যন্ত সে একটা ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েই থেকে যাবে। রবীন্দ্রনাথ বেশ স্পষ্ট ভাষায় সে কথা লিখেছিলেন। আর নজরুল বলেছিলেন ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।
দেশব্রতের মূল ধ্বজাধারী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা অনেকেই ছিলেন জমির উপস্বত্বভোগী। কিছু ছিলেন কেরানি ও শিক্ষক, সাংবাদিক পেশার লোকজন। একটা মানুষ কি চাইবে, আর কতদূর চাইবে, তা নির্ভর করে মানুষটির শ্রেণীগত অবস্থানের উপর। শ্রেণীস্বার্থরক্ষায় মরিয়া হয়ে একেকবার ব্রিটিশের বিরুদ্ধে কিছুটা লড়াইতে ঝাঁপালেও, শ্রেণীস্বার্থের অমোঘ অঙ্গুলি সঙ্কেতেই সেই আন্দোলন গুটিয়ে যেতে সময় লাগত না।
তরুণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দেশের উন্নতি বলতে একযোগে রামা কৈবর্ত ও হাসিম শেখের উন্নতি চেয়েছিলেন। কিন্তু তথাকথিত স্বাধীনতা আন্দোলনের রকম সকম দেখে হদ্দ গরিব চাষি জোলা ও পথে উৎসাহিত হয় নি। তাদের শ্রেণী স্বার্থ তাদের বেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল ইংরেজ তাড়িয়ে নেতা বাবুরা মন্ত্রী আমলা হবেন। চাষি জোলার লবডঙ্কা।
শ্রেণীস্বার্থের কারণেই স্বাদেশিক আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তির তরফে চাষি মজুরের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাইতে পারা সম্ভব ছিল না। ১৯১৭ সালের সোভিয়েত বিপ্লব সারা দুনিয়ার মেধাবী বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও ভারতীয় নেতৃত্বের একটি গরিষ্ঠ অংশ দক্ষিণপন্থী মতের দ্বারাই পরিচালিত হতেন। সমাজতন্ত্র নিয়ে নেহেরুজির ব্যাপক পড়াশুনা থাকলেও তীব্র ও গভীর সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বদলে ওপর ওপর কিছু স্লোগান রেখেই দায়ভার এড়ানোর চেষ্টা ছিল। দেশের মধ্যে কমিউনিস্ট শিবিরে সোভিয়েত ইউনিয়নের নকল করে চলার প্রবণতা ছিল। যেহেতু বিপ্লবোত্তর
কালে শিশু সোভিয়েত রাষ্ট্রকে জার্মানির আগ্রাসন হতে রক্ষার কৌশল হিসেবে ব্রিটিশ ও মিত্র শক্তির সঙ্গে আঁতাত দরকার ছিল, সেটাই ভারতীয় কমিউনিস্টরা নীতি হিসেবে ধরে নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন তীব্র করে তুলতে চান নি। শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার এল বিয়াল্লিশের বিপ্লবে। আন্দোলনের চাপে ব্রিটিশের ভারত ত্যাগ নিশ্চিত হয়ে গেল। সদ্য জাগ্রত শ্রমিক আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মারতে দেশভাগের বন্দোবস্ত হয়ে গেল।
ভূমি সংস্কারের দাবি গরিব মানুষের পক্ষ থেকে থাকলেও স্বাধীনতার সাথে সাথেই জমিদারি উচ্ছেদ যে কেন হয় নি, ক্ষমতা হস্তান্তরের গল্পে সে খবর রয়েছে। ১৯৫৪ সালে মধ্যস্বত্ব উচ্ছেদ আইন রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাভ করে। জমিদার জোতদারের হাত থেকে চাষির মুক্তি পাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে এই আইন পুরোপুরি কার্যকর ছিল না। তাই আন্দোলনের চাপে পরবৎসর ১৯৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় পাশ হয়েছিল ভূমিসংস্কার আইন।
আমাদের দেশে আইন পাশ হওয়া এক, আর সেই আইন কাজে লাগানো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। এক্ট বা আইন তৈরির পর রুল বা বিধি বানাতে হয়। সেই কাজের রেগুলেশন ও ম্যানুয়াল, অর্ডার, সার্কুলার তৈরি হয়। আর লাগে সেই আইন প্রয়োগে প্রশিক্ষিত দায়বদ্ধ নিয়মনিষ্ঠ কর্মীবাহিনী।
১৯৫৫ সালে ভূমি সংস্কার আইন হিসেবে পাশ হলেও যোগ্য ও শিক্ষিত কর্মী আধিকারিক নিয়োগ করে আইনের সুফল গরিবের হাতে পৌঁছতে গাফিলতি ছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি এক লপ্তে অনেক আধিকারিক নিয়োগ করে ভূমিসংস্কারের কাজ শুরু হল।
চাষির নিজস্ব নামে রায়তি রেকর্ড থাকবে। একটা রায়তের একটাই খতিয়ান হবে, আর জমির খাজনা নেবে সরাসরি সরকার। মাঝখানে জমিদার থাকবে না। এই হল এক রকম ভূমিসংস্কার।
আর এক রকম ভূমি সংস্কার হল যারা জমিতে খাটে, নিয়মিতভাবে চাষ করে, জমির রায়তের হাতে ফসল তুলে দিয়ে নিজে একটা ভাগ পায়, বা নিজের ভাগ কেটে রেখে মালিককে ফসল পৌঁছে দেয়, তার জান মালের সুরক্ষা। অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই যে চাষি, যাকে ভাগচাষি বা বর্গাদার বলতে হবে, তার চাষ করার অধিকার যাতে বহাল থাকে, মালিক যাতে ফসল পাকলে তাকে মেরে তাড়িয়ে সব ফসল নিজের গোলায় তুলে নিতে না পারে তারও ব্যবস্থা করা দরকার হল। এই বর্গাদার বা ভাগচাষির সুরক্ষা হল আরেক কিসিমের ভূমিসংস্কার।
আরো এক ধরণের ভূমি সংস্কার ছিল। সেটা হল একজন মানুষ কতটা জমি রাখতে পারবে, তার উর্দ্ধসীমা স্থির করে বাড়তি জমি সরকারে খাস করার ব্যবস্থা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর লাভ করা মধ্য স্বত্ব উচ্ছেদ আইনে। সে ছিল সর্ব ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইন। বাংলার নিজস্ব ভূমি সংস্কার আইনটি, যা বিধানসভায় ১৯৫৫ সালে পাশ হয়েছিল, তাতে পরিবার পিছু জমির উর্দ্ধ সীমার ধারণা এল। রায়ত তার বউ, আর ছেলে মেয়েরা, এই হল পরিবারের ধারণা। ১৯৭১ সালের পনের ফেব্রুয়ারিতে সেই রায়তের পরিবারের সদস্য কয়জন তার হিসেব করার পর জমি তারা কতটা রাখতে পারবে তার একটা জটিল হিসেব ছিল। এক সদস্য পরিবার হলে এক রকম। দুই থেকে পাঁচজন সদস্য হলে এক রকম। বেশি লোক হলে প্রত্যেকের জন্য একটা সীমা অবধি জমি রাখা যাবে। এমন সদস্য সংখ্যার একটা উর্দ্ধসীমা ধরাবাঁধা ছিল। সেই সংখ্যার বেশি সদস্য হলেও আর জমি রাখা যাবে না। জমি সেচ পায় বা পায় না, সে বাবদেও একটা হিসেব ছিল।
ভূমিসংস্কার নিয়ে এই সব আবছা আবছা ধারণা অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ছিল। গ্রামের স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের রায়ত চাষি তার ভাগচাষি বা বর্গাদারের শ্রমের উপর নির্ভরশীল হলেও সরকারি রেকর্ডে কাগজে কলমে সে ভাগচাষি স্থায়িত্বের অধিকার পাক, এটা চাইত না। সুতরাং গ্রামীণ মধ্যবিত্তের হাত থেকে হদ্দ গরিব ভাগচাষিকে বাঁচানো একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ ছিল।
সত্তর দশকের গ্রামবাংলায় বামপন্থী আন্দোলন গড়ে ওঠার সূত্রে রায়তের জমিতে বর্গাদারের রেকর্ড করানো, বর্গাদার যাতে ফসলের ন্যায্য ভাগ পায় তার ব্যবস্থা করা, আর রায়ত মারামারি করে ফসল কেড়ে নিয়ে গিয়ে থাকলে তার প্রতিবিধান, ভাগচাষিকে অন্যায় অবৈধ পথে চাষের অধিকার হতে উচ্ছেদ করতে চাইলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতে থাকল। বামপন্থী দলগুলির জোট সরকার স্থায়ী হবার সুবাদে বর্গাদার ভাগচাষি নামে এই সব গরিব কৃষিকর্মীর একটা সুরাহার আশ্বাস ছিল।
বাংলার বিধানসভায় পাশ হওয়া ভূমিসংস্কার আইনটিতে বর্গাদার বা ভাগচাষির চাষের ধারাবাহিকতা রক্ষা, বা বাপের মৃত্যুর পর সন্তানদের কারো ওই বর্গা চাষের অধিকার থাকা, আর মালিক ফসল না নিয়ে গরিব ভাগচাষিকে প্যাঁচে ফেলতে চাইলে তার প্রতিকারের ব্যবস্থা ছিল। ক্ষেত থেকেই মালিক ফসল জোর করে কেড়ে নিয়ে গেলে কী কী করণীয় তাও বলা ছিল।
কিন্তু আইন যেটা বলল না, সেটা হল লাঙ্গল যার জমি তার। স্পষ্ট তীব্র কণ্ঠে এই কথাটি বলতে গেলে শ্রেণী সংগ্রামের প্রয়োজন ছিল। দুঃখের কথা, বামফ্রন্ট এই জনপ্রিয় স্লোগানকে বাস্তব রূপ দিতে সাহস করল না। কেননা, ততদিনে যেন তেন প্রকারেণ সরকারি ক্ষমতায় থেকে যাওয়াটাই বামফ্রন্টের অন্তর্ভুক্ত দলগুলির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ভূমিসংস্কারের আরো একটা প্রকরণ ছিল খাস হওয়া জমি গরিব চাষিকে পাট্টা দেওয়া। আগেই বলেছি ১৯৫৩ সালের আইনের বলে মধ্যস্বত্বভোগী জমিদারদের উচ্ছেদ করে জমিদার ব্যক্তির খাসে থাকা জমির উপর উর্দ্ধসীমা চালু করে কিছু জমি সরকারে ভেস্ট হয়েছিল। তখন আর জমিদার কেউ না থেকে সবাই হল সরকারের অধীনে সরাসরি রায়ত। আবার ১৯৫৫ এর রাজ্য আইনের বলে রায়তি জমিতে পরিবার পিছু জমির উর্দ্ধসীমা চালু করে আরো অনেক জমি খাস হল। এই সব খাস জমি সরকার বিনামূল্যে গরিব মানুষকে পাট্টা দেবার উদ্যোগ নিয়েছিল। এই রকম পাট্টার রেজিস্ট্রেশন আইন বলে দলিল না হলেও এক রকম দলিল হল। উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর একসময় দেশভাগজনিত সমস্যায় উচ্ছেদ হওয়া বাঙালিকে জমি বন্দোবস্ত দিয়েছিল। কিন্তু গরিব মানুষের নানা দায়। পিতৃশ্রাদ্ধ, মাতৃশ্রাদ্ধ ও কন্যার বিবাহে গরিব মানুষকেও বিস্তর খরচ করতে হত। প্রায়শঃ তার টাকার যোগান আসত জমির অভাবী বিক্রির মাধ্যমে। উদ্বাস্তু পাট্টার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
উদ্বাস্তু পাট্টার হাতবদলের অভিজ্ঞতা খাস জমির পাট্টায় হাতবদলকে নিষিদ্ধ করল। কিন্তু জমি বেচে ফেলা গরিবের দুর্মর রোগ। নানা ফাঁকতালে জমি বেহাত হয়ে গিয়েছে। পাট্টা দেবার পরেও জমি ধরে রাখতে না পারার কারণে গরিবের অবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটে নি।
এটা নয় যে, আগ্রহী বামপন্থী কর্মী সংগঠক গ্রামে গ্রামে ছিলেন না। এও নয় যে সরকারি দপ্তরে সৎ অফিসারের খুব ঘাটতি ছিল। সবার উপরে বহু ঢক্কা নিনাদ সম্পন্ন পঞ্চায়েতি রাজও ছিল। তথাপি কেন পাট্টা দেওয়া জমি বাংলার চাষির গুণগত পরিবর্তন ঘটাতে পারল না, তার গভীর কারণ রয়েছে।
বাংলার কৃষকের সংগঠন বুদ্ধির অভাব দীর্ঘদিনের। গ্রীষ্মে জলের অভাবে বাংলার চাষি জোলা আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে, তবু সময় থাকতে দশজনে মিলে জমি দিয়ে ক্ষেত পুকুরের কথা ভাবতে পারে নি। আল দিয়ে দিয়ে জমি টুকরো তস্য টুকরো করে লাঙ্গল ঘোরাবার অযোগ্য করে ফেলেছে, তবু সমবায়ের মাধ্যমে একজোট হয়ে একলপ্তে চাষের কথা ভাবে নি। একটা ছোট রায়ত জমির খিদেয় তারই মত ছোটো ছোটো জমির রায়তকে প্যাঁচে ফেলে জমি হাসিল করে বড়ো রায়ত হবার স্বপ্ন দেখেছে। ভায়ে ভায়ে জমি নিয়ে মামলা করে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ভূমিসংস্কার আইন গরিব ও প্রান্তিক চাষির জমির কনসলিডেশনের কথা শুধু শুকনো পাতায় লিখে রেখে দিল। কাজে চালু করল না। গরিব চাষি ও কৃষিকর্মীর জন্যে কৃষি ঋণের ব্যাপারেও আইন প্রয়োগ হল না। রাষ্ট্র ও সরকারের শ্রেণীচরিত্র বুঝতে না চাইলে এর ব্যাখ্যা দেওয়া শক্ত।
তার মানে সব মিলিয়ে কি দাঁড়াল বোঝার চেষ্টা করি। জমিদারি উচ্ছেদ হয়ে যে জমির খাজনা আদায়ের এজেন্সি ছিলেন জমিদার সে বাবদে বেশ কিছু টাকা পেলেন। ব্যক্তি পিছু জমির উর্দ্ধ সীমা ছাড়িয়ে যেটুকু জমি ছিল তা খাস হল। আগের জমিদার হয়ে গেলেন রায়ত। এছাড়া যাঁরা জমিদার নন, রায়তি সম্পত্তিতে পরিবারের লোকজন গুনতি সূত্রে একটা উর্দ্ধ সীমা দিয়ে বাকি জমি খাস করা হল। সেই খাস জমি গরিব চাষিকে বিলানো হল। আর বর্গাদার বা ভাগচাষির উপর রায়তের অত্যাচারের একটা প্রতিবিধান হল। এই টুকুকে বলা হল ভূমি সংস্কার।
কিন্তু, টুকরো টুকরো জমি আল তুলে দিয়ে একলপ্তে করা হল না। কুঁচো চাষিদের জমি একত্র করে সমবায় প্রথায় চাষ করা গেল না।
আজকে আমরা যে দেখছি চাষি ফসলের দাম পাচ্ছে না, কিষাণ মণ্ডি নামে সরকারি দেখনসই সম্পত্তি বানানো হলেও সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চাষি বসছে না। চাষির মাল চলে যাচ্ছে ফড়ে পাইকার আর আড়তদারের হাতে। চাষের যত ঝক্কি চাষির, আর বাজারের লাভের টাকা ফড়ে পাইকার আড়তদারের। এই যে গতরে না খেটে, শুধুমাত্র টাকা বিনিয়োগ করে বাজারটাকে মুঠোয় রাখা, একে যদি নতুন কিসিমের মধ্যস্বত্ব না বলি, তো কাকে বলব?
আপনি ভারতের যে কোনো সমৃদ্ধ শহরে যান, বাঙালি গ্রাম্য শ্রমিক দেখতে পাবেন। মার্বেল বসাচ্ছে, ইট পাথরের দেওয়াল তুলছে। এই যে চাষি ঘরের চাষ না করা শ্রমিকেরা নিজের গ্রাম থেকে বিস্তর দূরে খাটছে, একে কি ভূমিসংস্কারের সাফল্য বলব?
সাম্প্রতিক নোটবন্দির পর্বে ব্যবসাপত্রে বেশ একটু মন্দা এলে বিস্তর বাঙালি শ্রমিক দূর দুরান্তের শহর থেকে নিজের গাঁয়ে ফিরে এসেছিল। তাদের কিছু আর্থিক খয়রাতিও মিলেছিল। এতেই বেশ বোঝা গেল, তথাকথিত ভূমিসংস্কার কিন্তু চাষির ছেলেকে চাষের ক্ষেতে স্বনির্ভর করতে পারে নি।
এর আগে সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা একটু স্মরণ করি। সিঙ্গুরের অত্যন্ত সমৃদ্ধ কৃষিজমি পাবলিক মানি দিয়ে অধিগ্রহণ করে টাটাদের হাতে দেবার সময় বৃহৎ বাম দলের তরফে যুক্তি তোলা হল যে চাষের খেতে আর লাভ হচ্ছে না। কিন্তু চাষের ক্ষেতে যে লাভ হয় না এটা বলার মধ্য দিয়ে কি সরকারি ভূমিসংস্কার এর সারবত্তা নস্যাৎ হয়ে যায় নি?
সিঙ্গুরের পর নন্দীগ্রাম, ভাঙড়, ভাবা দীঘি। এগুলি জমির উপর একের পর এক পুঁজিবাদী আক্রমণের ঘটনা। ভূমিসংস্কার আইন বলেছিল কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তন খামখেয়ালি পদ্ধতিতে করা যাবে না। কিন্তু পুঁজির তর্জনী শাসনে সরকার একের পর এক কৃষিজমি মাটি কারবারীদের হাতে তুলে দিতে লাগল। মাটি মাফিয়া, মাটি হাঙ্গর, এমন সব লব্জ তৈরি হয়ে গেল লোকমুখে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থাকবে, আর এসব হবে না, সেটা কপোল কল্পনা। রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি, এই কথাটা তো আর বানানো কথা নয়। জীবন থেকে উঠে আসা কথা। কিন্তু পুঁজিবাজারের হয়ে বৃহৎ বামদলের কর্মকর্তারা যেভাবে সরকারি চেয়ারে বসে পুঁজির মোসাহেবি শুরু করলেন, তাতে গোটা বিশ্বের লোক অবাক হয়ে গেল।
নগরাঞ্চলে শিল্পাঞ্চলে আরও একটা ঘটনা লক্ষ্য করা গেল। একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে, নানা ছুতোয় সেইসব কারখানার জমি প্রমোটারের খপ্পরে চলে গেল। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, আবাসনের চাহিদা ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের ভাঙন অব্যাহত ছিল। পুরোনো ধাঁচের এজমালি বাড়ি ছেড়ে ছিমছাম ফ্ল্যাটে যাবার তাগিদ ছিল। কিন্তু ভূমিসংস্কার আইনে অত সহজে কারখানার জমিতে ফ্ল্যাট বাড়ি বানানোর সুযোগ ছিল না। বাস্তবে আইনকে চোখ মেরে প্রমোটাররা বন্ধ কারখানার জমি বাগিয়ে নিয়ে ফ্ল্যাট বানিয়ে ফেলল।
ভূমিসংস্কারের আরো এক দুর্বলতা চোখে পড়ে। উত্তরাধিকার আইনের ব্যবস্থা মোতাবেক হিন্দু বা মুসলিম সমাজে পিতা ও পতির সম্পত্তিতে কন্যা ও স্ত্রী হিসেবে মেয়েদের অধিকার থাকার কথা। সেই হিসেবে মেয়েদের নামে পরচা বা খতিয়ান থাকার কথা। রাজস্থান বা হরিয়ানার চাইতে এ রাজ্যে পুরুষ প্রতি মহিলার হার ভাল। কিন্তু খতিয়ানগুলিতে পুরুষ ও নারীর অনুপাত দেখতে গেলে সেটা মনে হবে না। মেয়েদেরকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার ছক বাংলায় আজ নতুন নয়। বহুদিনের ক্লেদাক্ত অভ্যাস। ভূমি সংস্কার আইনে মেয়েদের নাম পর্যাপ্ত পরিমাণে রেকর্ড হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাঙালি পুরুষের লোভ লালসা আর নারী জীবনের প্রতি ঈর্ষা সক্রিয় ছিল। তারাই রেকর্ডের সময় মেয়েদের নামটা সামনে আসতে দেয় নি। রেকর্ড সংশোধনের প্রশাসনিক কার্যক্রম সেই বদভ্যাসের উৎপাটন করতে পারে নি। বাংলার মেয়েরা যদি পায়ের তলায় জমির আশ্বাস পেয়ে যেত, তাহলে ঘরে ঘরে এত বধূ নির্যাতন কন্যা নির্যাতন ভারি সোজা হত না। একটা প্রতিবাদ প্রতিরোধ উঠত। আমরা দেখতে পেয়েছি পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থাপনায় নারীদের আসন সংরক্ষণ করার নামে আসলে স্বামী ভাসুর শ্বশুর বাড়ির মেয়েদের বকলমে গ্রাম শাসনের রাশ হাতে রেখেছে। সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার ও দখল রেকর্ড করা গেলে তাঁদের এভাবে শিখণ্ডি বানিয়ে ক্ষমতা আত্মসাৎ করা সহজ হত না।
বামপন্থী আন্দোলনের চাপে বাংলায় ভূমিসংস্কার শুরু হয় এটা যেমন সত্য, তেমনি বাম আন্দোলনের সুবিধাবাদ, আদর্শহীনতা, ভূমিসংস্কারকে প্রতিমা ও ঢাকিশুদ্ধ বিসর্জন দিয়েছে।