• Uncategorized
  • 0

প্রবন্ধে ডঃ রজতকান্তি সিংহচৌধুরী

অলোক সরকারের ছন্দ নিরীক্ষা

“আমরা কবিতাকে -আবার কবিতার কাছে ফিরিয়ে আনব। “-এই অঙ্গীকার ছিল “শতভিক্ষা” কবিতা পত্রের, পাঁচের দশকের -তরুণ কবি আলোক সরকার (২৩ / ৩ / ১৯৩১ – ১৮ / ১১ / ২০১৬) অন্যতম কর্ণধার।

১৯৫১সালের সেপ্টেম্বরে আলোক সরকার এবং দীপঙ্কর দাশগুপ্তের যৌথ সম্পাদনায় “শতভিক্ষার “প্রথম সংখ্যা শারদীয়া সংকলন ১৩৫৮ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। বাস্তবিক পঞ্চাশের দশকে অব্যবহিত পূর্বে বাংলা কবিতার মৌল লিরিক্যাল সুর কিছুটা হলেও ব্যবহার হয়েছিল।’ জনগণের কবিতা লেখো ‘এবং ‘যৌনতার কবিতা চাই ‘-এই দুই পরস্পর সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী শ্লোগান আবহমান বাংলা কবিতার মুক্তাঙ্গনকে শিবিরিত করে তুলতে চাইছিল। নানা অর্থেই অগ্রজ কবি অরুণকুমার সরকার তাই লিখেছিলেন ‘সভামিছিল এবং শায়াশেমিজের পিছনে ছোটাই সকলকালের সব যুবকের স্বধর্ম হতে পারেনা। ‘এই পরিপ্রেক্ষিতে কবিতার অন্তর্মুখীন ক্ষুব্ধতার কাছে ‘শতভিক্ষা ‘-র এই অঙ্গীকার সেদিন জরুরি হয়ে উঠেছিল।
তাই আধুনিকতার মান্য পুরোহিত বুদ্ধদেব বসু যখন তাঁর কবিতায় যৌবনের উত্তাপ না থাকার অভিযোগ আনেন তরুণ আলোক সরকার তা গায়েই মাখেননি। কেননা কবিতায় ‘যৌবনের -উত্তাপ ‘থাকাটাই যে জরুরি, এমনটা তাঁর মনে হয়নি। বস্তুত সমকালীন কবিতায় তিরিশের যৌনতারই প্রতিধ্বনি তাঁদের ভিন্ন পথ নিতে প্রানিত করেছিল।
আর বুদ্ধদেব যখন তাঁর ছন্দে ভুলের কথা বলেছিলেন, তখন তিনি মনে মনে হেসেছিলেন। ভেবেছিলেন, ছন্দ নিয়ে তিনি যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিলেন তা কেমন করে বুদ্ধদেব বসুর মতো একজন অতোবড়ো কবিতাবোদ্ধা বোঝবারই চেষ্টা করলেন না?
‘শতভিক্ষা ‘ আধুনিকতাকে দেখেছিল ব্যক্তিত্বচিহ্নিত প্রবহমানতার -অর্থে। আর ছন্দের সমস্যা আদতে ব্যক্তিত্বেরই সমস্যা। ব্যক্তির যুক্তির জন্যই যুগে যুগে ছন্দযুক্তির প্রয়োজন ঘটে, দরকার পড়ে প্রথানুগত অনড় চলভশক্তিহীনতায় বাইরে বেরিয়ে আসবার। মধুসূদনকে যেমন ভারতচন্দ্রের ছন্দকাঠামো ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, তেমনি রবীন্দ্রনাথ ক্রমউন্মোচিত করেছিলেন মধুসূদনের ছন্দদিগন্ত। আসলে কবি তাঁর ‘ব্যক্তিগত স্পন্দনকে সঞ্চারিত করতে চান ছন্দশরীরে। এই সঞ্চারের জন্যই কখনো কখনো মুক্তি খোঁজেন কবি’।


বলা বাহুল্য এই মুক্তি যা খুশি করবার অবহেলা নয়, ছন্দকে যিনি গড়তে জানেন, তাঁরই আছে তাকে ভেঙ্গে চুরে নতুন কাঠামো দেবার অধিকার। তাই, ‘আধুনিক ছন্দের ইতিহাস ছন্দশরীরে বাক সম্পদকে আত্মীকরণের ইতিহাস।

ছন্দের মুক্তি তাই বারে বারেই নতুন কবির হাতে ঘটে, ঘটতে থাকে আলোক সরকার তাই বলেছেন, ‘ব্যক্তিত্ববান কবিকে তাঁর ব্যক্তি গত, ব্যক্তিত্বে প্রতিষ্ঠিত মনোভঙ্গির প্রকাশের অনুকূল হয় এবং ছন্দের রূপান্তর ঘটে। পুরাতন কাব্যরীতি, ছন্দগঠনে তৃপ্ত যে কবি, ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর ব্যক্তিত্বের ভিত্তি দৃঢ়মূল নয়, তাঁর দেখার চোখের সেরকম কোনো অভিনিবেশ নেই, যা তাকে পূর্বসূরীদের কর্ষিত মাটির পাশাপাশি অন্য জমিতে দাঁড়াবার প্রয়োজন অনুভব করাতে পারে। ব্যক্তিত্ববান
কবিকে কখনো নিজের ছন্দ খুজে নিতে হয়, তৈরি করে নিতে হয়, কখনো বা সেই ছন্দ তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সঙ্গে হয়ে ওঠে -।


কবিতার শুদ্ধতার অনুসন্ধিৎসা আলোক সরকারকে নতুন দিশা দেখিয়েছিলো। ইয়েটস এর মতো তিনিও বুঝি বলতে চান, ‘যা কিছু কবিতা নয় তাকে কবিতার শরীর থেকে বাদ দিতে হবে। ‘তাঁর কবিতা বিশুদ্ধ মনোনধর্মী এবং এবং অন্তর্মূখী।
এই নতুন দিশার একটা দিক যদি হয় নতুন কাব্য ভাষা, কাব্য দর্শন ও বাকপ্রতিভা অন্য দিকটি হল নতুন ছন্দ নিয়ে তাঁর জীবনভর পরীক্ষা নিরীক্ষা।
তাঁর পঞ্চাশের দশকের উজ্জ্বল সতীর্থদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ছন্দ নিয়ে অনিঃশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা এখনো নিরত। আর শক্তিচট্টোপাধ্যায় তো তাঁর ছন্দে প্রসারিত করেছেন চন্ডীদাসের রামপ্রসাদের বাউলগানের বাংলাকেই। কিন্তু আলোকসরকারের বিশিষ্টতা এখানেই যে তিনি যেমন বাংলা অক্ষরবৃত্ত -মাত্রাবৃত্ত -স্বরবৃত্ত এই ত্রিবিধ ছন্দকে নিজস্ব চালে ব্যবহার করেছেন, তেমনি বাংলা কবিতাকে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব ছন্দ –
‘আলোক সরকারের ছন্দ ‘।
‘আধার আধেয়ের অগ্রগণ্য ‘-অগ্রজ কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের এই কাব্য সিদ্ধান্তকে আলোক সরকার প্রায় বিজমন্ত্রের মতো মান্যতা দিতেন। মুখো মুখি আলাপচারিতায় দেখেছি, তিনি গভীর বিশ্বাসে এই কথাগুলি উচ্চারণ করতেন।
ভাষা আঙ্গিকের মতো ছন্দও তো কবিতার আধার। তাই খুব স্বাবাবিকভাবেই তিনি ছন্দকে প্রাপ্য গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ত্রিবিধ ছন্দ নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশা পাশি গড়ে তুলেছিলেন নিজস্ব এক ছন্দ, প্রচলিত অক্ষরবৃত্ত -মাত্রাবৃত্ত -স্বরবৃত্তের -বাইরে যার অবস্থান।
এই পথে পৌঁছতে অবশ্য তাঁকে পার হতে হয়েছিল দীর্ঘ কাব্য পরিক্রমার সাধনা। বাংলা কবিতার অক্ষরবৃত্ত -মাত্রাবৃত্ত -স্বরবৃত্ত এই ত্রিবিধ ছন্দ
তিনি সতেরো আঠেরো বয়েসেই আয়ত্ত করেছিলেন -প্রথম কবিতার বই ‘উতল নির্জন ‘(১৯৫০)তাঁর এই বয়েসের রচনা। ‘আবেগী একাকিত্ব ‘এই বইকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে, যদিও জীবনানন্দ তাঁকে সতর্ক করেছিলেন আবেগের অমিতাচার বিষয়ে।
পরবর্তী কবিতা বই -‘সূর্যাবর্ত ‘ ‘উতলনির্জন’ এবং ‘সূর্যাবর্তে ‘প্রচলিত অক্ষরবৃত্ত এবং মাত্রাবৃত্ত লিখিত কবিতার সমাবেশ ঘটেছিলো এবং কবিতায় এই প্রচলিত ছন্দের নিপুন প্রয়োগই ঘটেছিলো –
‘আমি তো দেখেছি ঢের বিকেলের আশ্চর্য বর্ণালী
চিরন্তন সন্ধ্যা এসে মুছে দিয়ে যায়।
আমি তো দেখেছি ঢের তরঙ্গিত নীল হাততালি’


স্বতন্ত্র বই হিসেবে ‘সূর্যাবর্ত ‘প্রকাশ পায়নি। (১৯৫১-১৯৫৪)তে রচিত কবিতা গুলি প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা’ ‘সাহিত্য পত্র, পূর্বাশা, শতভিক্ষা, কৃত্তিবাস, উত্তরসুরি -‘ তে।
স্তব্ধতার অশ্রুজল হারায় হারায়।
আমি তো জেনেছি বেলা ক্ষয়ে যায় ছায়ায় ছায়ায়
-স্বজ্ঞা, উতলনির্জন (১৯৫০)
(অক্ষরবৃত্ত )
” তুমি সব জেনে অন্ধকারের -বন্ধ দুয়ার।
হারিয়েছো তাও যা ছিল একদা সুচির সুধার।
যুক্তিবাদীর যে সহ্য তাতে আশ্রয় নেই
এপারে অথবা ওপারে। ”
– হাওয়ার পাখায়,
সূর্যাবর্ত
(ষন্মাত্রপার্বিক মাত্রাবৃত্ত )

(মন্ত্রা চার্জ) কিন্তু কবির মনে হল, ব্যবহার সবই
জীর্ন হয়। মন্ত্রাচার্জ কিট্স্ যেমন
বলেছেন, ‘everything is spoilt by
Use’, কবি দেখলেন প্রচলিত ছন্দে
তাঁর ব্যক্তিত্ব আধারিত হচ্ছে না।
প্রয়োজন ছন্দ মুক্তি। নতুন ছন্দ চাই

(নিরুক্ত) কুড়ি বছর বয়স থেকেই কবির
কাজ শুরু হল। প্রচলিত সব ছন্দই
তাঁর অধিগত ছিল। ওই বয়সেই তাঁর
কবিতা বিষ্ণু দে-র ‘সাহিত্যপত্র’, বুদ্ধ
দেব বসুর ‘কবিতা ‘এবং সঞ্জয়
ভট্টাচার্যের ‘নিরুক্ত’ পত্রিকায়
মনোনীত হত। এমনকি কবি যখন
বিদেশি কবিতার অনুবাদে হাত
দিয়েছেন তাঁর হাতের নিটোল অক্ষর
বৃত্ত বা মাত্র বৃত্ত ঝলসে উঠতে দেখেছি –
১/ ‘ আমার স্মৃতিকে রেখো যত্নে ফুলগাছের মতন
প্রীতি -অর্ঘ। একদিন আমার গ্রামের পথ ধরে
আসবে তরুন এক রাজ সমারোহে দেবে ভরে
আমার নতুন নামে মধুর গন্ধের নিবেদন। ‘
অনুবাদ আলোক সরকার
গ্রন্থ -ভিনদেশি ফুল (১৯৫৬)৫
২/ ‘স্বাগত, নম্র তরুণিমা
প্রকৃতির প্রিয়া তুমি
পূর্ণ -পুনসম্ভারে
স্বাগত জানাই স্বাগত। ‘

বসন্তের প্রতি, যোহান ক্রিস্টক ফ্রিডরিশ ফন শিলার –
(১৭৫৯-১৮০৫)
অনুবাদ -আলোক সরকার ৬
গ্রন্থ :সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত (১৯৬২)

বলা বাহুল্য, প্রথম উদাহরণটিতে ১৮ মাত্রার অক্ষর বৃত্ত দ্বিতীয় টিতে ৬ মাত্রার মাত্রা বৃত্ত। দ্বিতীয় উদাহরণ প্রসঙ্গে আরও বলা যায়, ‘সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্ত ‘সংকলনে অমুসূত একটি শিল্পাচার্য শিলারের একমাত্র কবিতা। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আলোকসরকার বর্তমান প্রতিবেদককে সম্পূর্ণ কবিতাটি স্মৃতি থেকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছিলেন যে, পুরোনো কবিতা বলেই তিনি পুরনো ধাঁচের ছন্দে এর অনুবাদ করেন। এ থেকেও আলোক সরকার ছন্দভবনের একটি দিশা পাওয়া যায়।
৩/

‘মানুষের ভাষাটুকু অর্থ দিয়ে বদ্ধ চারিধারে, /……অবিরত রাত্রিদিন /মানবের প্রয়োজনে
প্রাণ তার হয়ে আসে ক্ষীণ। /……
মানবের জীর্ন বাক্যে মোর ছন্দ দিয়ে নবসুর, /অর্থের
বন্ধন হতে নিয়ে তারে যাবে কিছু দূর /
ভাবের স্বাধীন লোকে….. ‘ভাষা ও ছন্দ ‘,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(বিংশ ) বিংশ শতকের শুরুতেই এই জাদুটা জেনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। মানুষের ভাষা চারদিক থেকেই অর্থ দিয়ে বন্ধ, ব্যবহৃত হতে হতে ক্ষীণপ্রাণ। ছন্দের ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই শব্দের মুক্তি ঘটে। উপলব্ধি আলোকের।
নতুন কবিকে তাই নিজ ব্যক্তিত্বের উপযোগী নতুন ছন্দসন্ধান করতে হয়। তরুণ বয়সেই ত্রিবিধ ছন্দ আয়ত্ত করে এবং কবিখ্যাতির স্বাদপেয়েও আলোকসরকার তাই নতুন ছন্দের সন্ধানে নিমগ্ন হলেন কুড়ি বছর বয়সেই। এমনকি, সেদিনের তরুণ আলোক কবিতা লেখা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করলেন, নতুন ছন্দ পাবার পর তা লেখা যাবে।
কবিতা লেখা ব্ন্ধ করে শুরু হল নতুন ছন্দ পাওয়ার সাধনা -নতুন বিন্যাস, নতুন গ্রহণ পদ্ধতি। একদের বছর পড়ে, যেমন হয়, সহসা একদিন -কবি খুজেপেলেন তাঁর অনিষ্ট ছন্দকে। আধুনিক নাগরিক কবি তাঁর ছন্দকে খুজে পান ‘স্বচ্ছ -শীর্ণ ক্ষিপ্রগতি স্রোতস্বতী তমসার তীরে ‘। নয়, কোনো একদিন গভীর রাত্রে এক বন্ধুর বাড়ির সামনে একটি পেট্রোল পাম্পের চবুতরায়। হঠাৎ ভেসে উঠল তিনটি চরণ। বাড়ি ফিরে শুরু করলেন নতুন পর্যায়ের কবিতা লেখা। উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো ‘আলোকিত সমন্বয়য়ের কবিতা গুলি। সময়টা ছিল ১৯৫৩-৫৪ সাল স্বরবৃত্ত ছন্দে এক মৌল পরিবর্তনই ছিল কবির এই নতুন ছন্দ খুঁজে পাওয়ার চাবিকাঠি।
বস্তুত আরও অনেক আপাতলঘু বিষয়ের মতোই স্বরবৃত্ত ছন্দকেও বাংলা কবিতায় সুচিত করেন রবীন্দ্রনাথ। উপান্ত পর্বের -‘পলাতকা ‘কাব্যগ্রন্থে বই ছন্দের বহুল প্রয়োগ দৃষ্টান্ত স্থল। রবীন্দ্রনাথ স্বরবৃত্ত ছন্দকে সুমিত এবং সংস্কৃত পরিসরে নিয়ে এলেন। যা ছিল ছড়ার ছন্দ, তাই হয়ে উঠল গভীরতর ভাববহনের উপযোগী। /রাবীন্দ্রিক স্বরবৃত্তকে তিন বা পাঁচদলের ব্যতিক্রমী পর্ব নেই। সব পর্ব মূলত চারদলের। প্রবোধচন্দ্রের মতো ছন্দ শাস্ত্রী এতেই তৃপ্তি লাভ করেছেন, যেহেতু তাঁর ছন্দশাস্ত্রের মূলত রবীন্দ্রকবিতার নিরিখে রচিত। (এমনকি প্রবোধচন্দ্র জানাচ্ছেন মধুসূদনের ‘যেমন কর্ম তেমন ফলল ধর্ম বুর শালিকের ঘরে রোঁয়া ‘চরণটির নিম্নরেখাঙ্কিত তৃতীয় পর্ব নিতান্ত ত্রুটি যুক্ত কেননা এর মাত্রাসংখ্যা পাঁচ। জবর জবাব দিয়েছেন কবিছান্দসিক শঙ্খ ঘোষ :’আমার কথাটি ফুরোলো নোট গাছটি মুড়োলো’, বলতে কোনো বাঙালি শিশুর বিপন্ন হয় ‘এ ছড়াটি অনেক পর্বেই তো পাঁচমাত্রা এবং আমরা জানি যে, ওই সন্নিবেশ এ ছন্দের এক নিজস্ব ধর্ম। )

স্বরবৃত্তের পর্বগুলি রবীন্দ্রনাথ শুধু সততাই আনেননি,এই সমতারও কিছু অলিখিত নিয়ম মেনেছিলেন আজীবন। একই পর্বে চার রুদ্ধদল তাঁর কবিতায় নেই, তিনটি রুদ্ধদল এলে চতুর্থ দলের আর কোনো দরকারনেই। অর্থাৎ রবীন্দ্র অনুসৃত স্বরবৃত্তে কোনো পর্বে থাকতে পারে চার মুক্ত দল, একটি রুদ্ধ ও তিনটি মুক্তদল অথবা দুটি রুদ্ধ দল ও দুটি মুক্ত দল। তার উপরেও একটি পৌর্ব পর্যায়ের নির্দেশ তিনি অলঙ্খ ভাবে জানিয়েছেন :-
– – U U অথবা U U- –
তাঁর লেখায় প্রায় অব্যবহৃত।
নিম্নোক্ত চার পরম্পরাতেই তাঁর স্বস্তি :-
Tক ) -U-U
খ )U- -U
গ )U- U-
ঘ )-UU-
(- = রুদ্ধ দল, U= মুক্তদল )
উদাহরণত, রবীন্দ্রনাথের বহু স্বরবৃত্তেই যে ‘ফাল্গুন’ ”ফাগুন ‘ এ পরিণীত তার কারন পর পর দুটি রুদ্ধদল (কাল, গুন )ব্যবহার করতে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি –
‘ফাগুন মাসে পূর্ণিমাতে যে নিয়িম টা চলে
রাগ করেন না চৈত্রমাসে সেটা ভক্ষ হলে। ‘
শ্রুতি টুকুর কারণেই রবীন্দ্রনাথ রুদ্ধ মুক্তদলের কিছু কিছু পৌরবার্জ বর্জন করেন। রবীন্দ্র -পরবর্তী কবিরা
কিন্তু এই সব পৌর্বপর্যকে সকলভাবে ব্যবহার করলেন। শ্রুতিমাধুর্যই তো কথা না। আর বাংলা ছড়ায় বহু কাল ধরেই যে তিন বা পাঁচমাত্রার পর্ব প্রচলিত ছিল আধুনিক কবিরা তার প্রয়োগ ঘটালেন। এতে করে স্বরবৃত্তের দুলুনিকে বাদ দিয়ে কবিতা গদ্যভঙ্গিমার কাছা কাছি আসতে পারল। রবীন্দ্রনাথের হাতে স্বরবৃত্ত পরিশুদ্ধ হয়েও প্রাথমিক
ছড়ার দুলুনিকে ভুলতে পারেনি।

প্রসঙ্গত অন্তপর্বে জীবনানন্দ স্বরবৃত্তে লিখেছিলেন lপ্রায় তিরিশটি কবিতা। ‘বেলা অবেলা কালবেলা ‘য়
এগুলি অনুসূত।
একদম সূচনায় ‘ঝরা পালকে’র তরুণ কবি স্বরবৃত্তে লিখেছিলেন বটে। তবে সত্যেন্দ্রনাথ কাজী নজরুল গন্ধী সেই স্বরবৃত্তে ছন্দের উচ্ছাসেই ছিল তখন তাঁর মন।
তারপর দীর্ঘকাল তাঁর রচনায় স্বরবৃত্ত গরহাজির, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর অক্ষরবৃত্তের মন্থর চলনেই লিখে
চলেছেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি ‘থেকে ‘সাতটি তারার তিমির ‘অবধি।
কিন্তু ‘বেলা অবেলা কালবেলায়- য় যখন অবশেষে স্বরবৃত্ত ফিরল, জীবনানন্দ এই ছন্দের দুলকি চালটা সুকৌশলে সরিয়ে নিলেন। তাঁর এই স্বরবৃত্তের তাঁর অক্ষরবৃত্তের মতোই মন্থরতাময়। বাঁধভাঙা জলোচ্ছাস নয়, বরং স্বচ্ছ জলের নির্ধারিত প্রবাহ, বাংলার ভূকবিতা যা মানানসই। নতুন ছন্দে চাইলেন নতুন এক সংঘাতকে।
১)কুলবধূর বহিরআশ্রইতার মতন অনেক উড়ে (তোমাকে )
২)প্রতিটি প্রাণ অন্ধকারে নিজের আত্মবোধের দ্বীপের মতো -কী এক বিরাট অবক্ষয়ের মানবসাগরে।( ঐ )
৩)সার্থকতা পাওয়া যাবে ভেবে মানুষ সঞ্চারিত হয়ে পথে পথে সবের শুভ নিকেতনের সমাজ বানিয়ে তবুও
কেবল দ্বীপ বানাল যে যার নিজের অবক্ষয়ের জলে।
(যতিহীন )
৪)ভোরের বেলার মাঠপ্রান্তর নীলকণ্ঠ পাখি, দুপুরবেলার আকাশে নীল পাহাড় নীলিমা, সারাটা দিন মৌনরৌদ্রমুখর জলের স্বর -অনবসিত বাহির ঘরের ঘরণীর এই সীমা।
(সময় সেতুর pothe)
স্বরবৃত্তের পর্বে পর্বে জোর বেঁধে,কখনো বা চতুস্বরের সীমানা ডিঙিয়ে এই স্বরবৃত্তে অক্ষরবৃত্তের সম সামঞ্জস্যের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কোথাও কোথাও।
শঙ্খ ঘোষ ভেবেছেন, ‘এই স্বরবৃত্তের মধ্য দিয়ে জীবনানন্দ একই সঙ্গে তৈরি করবে পারেন তাঁর গহন বোধের সারাৎসার, তাঁর চির পদার্থ, আর তাঁর মৌখিক ভাষার দৈনদিনতা ‘। ৮
আলোক সরকারের ছন্দ প্রথমে জীবনানন্দের
স্বরবৃত্ত নিয়ে অত কথা বলবার কারণ জীবনানন্দ ভাবছিলেন স্বরবৃত্তের দিকেই বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কিনা, ‘স্বরবৃত্ত বা প্রাকৃত বাংলার ছন্দে যে বহু পরীক্ষা
সম্ভব হয়, উত্তীর্ণ হওয়া যায় তার উত্তরণলোকে, আধুনিক বাঙালি কবির সেদিকে ততটা মন নেই’। ৯
অব্যবহিত পূর্বে স্বরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে জীবনানন্দ প্রায় অনুরূপ পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিরত ছিলেন।
স্বরবৃত্ত( বা দলবৃত্ত বা শ্বাসাঘাত প্রধান )ছন্দের
দুলুনিকে বাদ দিয়ে জীবনানন্দের অব্যবহিত পরেই তাঁকে এক সমগ্রতর ধরণের গদ্যভঙ্গিমার, কথনভঙ্গির
কাছা কাছি নিয়ে এলেন আলোক সরকার।
দীর্ঘ সাধনা ও ব্যবধানের পড়ে ১৯৫৭সালে প্রকাশিত ‘আলোক সমন্বয় ‘কাব্যগ্রন্থে এই নতুন যুক্ত স্বরবৃত্ত ছন্দের সমুজ্জ্বল সমাবেশ
১)সকালবেলার আলো আকাশ নতুন আকাশ দেশের বাড়ি শান্ত ছবি এঁকেছিল।
দেখেছিলে মাঠে মাঠে সংহতির কুয়াশা যেন রহস্যের
প্রথম ছবি।
যেন একটি উন্মোচন হাজার হাজার সবুজ
পাতায় কিংবা শুভ্রতায় তারই প্রতিশ্রুতি। বড়ো বড়ো
টিলা পাহাড় পরিস্রুত আত্মীয়তায়।
দেখেছিলে সাহসিকা পরিণয়ের উজ্জলতা, প্রেমিক, অভিবাদন।
আলোকিত সমন্বয়
২)বুকের মধ্যে শুনতে পাও আন্তরিক ধ্বনি -হাজার ঝরা পাতার বুকে পায়ের চিহ্ন মর্মরিত আছে।

৩)প্রতিজ্ঞার উজ্জ্বলতা অন্তরালে এখন ম্লান মুখ
হারিয়ে গেল প্রত্যাশিত প্রতিষ্ঠিত নাম।
-বিজিত নায়কের খেদ
৪)অন্ধকার মন্দিরের নিরুদ্দেশ স্বর্ণ সমারোহে
উজ্জ্বলতা করে রাখো।
– সোনার ঘন্টা
৫)তুমি দূরের বাঁকে শীতল মিলিয়ে গেলে।
-ফিরে পাওয়ার পথ
৬)অন্ধকার নিবিড় পটভূমিকায়
তোমার মুখ এঁকেছি।
তুমি সহজ স্তব্ধতায় জ্বলো।
এখানে নেই অপর চাওয়া -বিনীত নির্জন
কিন্তু আমার স্বপ্ন তারা কোথায় ছলো ছলো।
সকালবেলায় প্রথম চোখ মেলে
তোমার কথা যখন মনে পড়বে আমি তখন
তোমার মুখ আঁকবো আবার আলোয় ভরা আকাশে রেখা জ্বেলে।
কিন্তু আলো অন্য রঙ তোমার রঙ, তোমার আয়োজন
ছড়িয়ে দেয় বিশাল আলোয়
তোমার সুখ হারিয়ে যায় ম্লান শীতল রেখার অবশেষ।
-শিলা কল্পনা
পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না যে, উপযুক্ত চরণগুলিতে পাঁচ বা তিন মাত্রার পড়বে দুর্লক্ষ্য নয়। দুলুনিকে বাদ দিয়ে গদ্যভঙ্গিমার দিকে স্বরবৃত্তের সম্ভাবনাকে সঞ্চারিত করলেন আলোকসরকার, যে সম্ভাবনার কথা আগেই ভেবেছিলেন জীবনানন্দ। তাঁরও আগে রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন স্বরবৃত্তের দিকে থেকেই বাংলা কবিতার ভবিষ্যত কি না।
দুলুনিকে বাদ দিয়ে স্বরবৃত্ত ছন্দে এই গদ্যভঙ্গিমার ঝোঁক লক্ষ করেই শঙ্খঘোষ লিখেছিলেন ‘স্বরবৃত্তের সাবেকি চাল সরিয়ে নেবার (দৃশ্টান্তস্থল )ব্যাপারে আলোকের নৈপুণ্যই দৃষ্টান্তস্থল, হয়তো বা তাঁর এই কৌশলটি বুঝতে না পারার জন্যেই অনেকে ধরতে পারেননা তাঁর ছন্দ।’১০
উদাহরণ হিসেবে ১৯৬৬তেই শঙ্খঘোষ আলোক সরকারের চরণ উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন –
‘ভালো বাসি তাঁদের স্থির প্রতিচ্ছবি চিরদিনের শ্যামলিমায় ‘
এর মতো লাইনে স্বরবৃত্তের তার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ধরতে
পাঠকের অসুবিধে হয়না।
কিন্তু আলোক যখন লেখেন –
‘চোখের কোমল যেন নদীর প্রবাহিত সরলতা, স্বাভাবিকতা ‘
তখন শেষ শব্দটি হঠাৎ পাঁচমাত্রায় আলগা করে উন্মচিত করে লাইনটির মুখ। শঙ্খ ঘোষের কথায়,
‘ছান্দসিকের বিপদঘটে। বিপদ বাড়তে থাকে ক্রমশ ‘
‘ অভিমানী স্তব্ধতায় মেঝের ওপর ছড়ানো তীব্র চুল।’
আপাতদৃষ্টিতে ‘স্তব্ধতায়’শব্দের তিনমাত্রা যদি বা প্রথানুগত ছান্দসিকের হজম হয়, ‘ছড়ানো তীব্র’ পর্বটিকে পাঁচমাত্রার অভ্যস্ত শ্রুতিতে যে অসুবিধা
আনে তার মুলে আছে ছন্দ চরিত্রের পরিবর্তন। আসলে এই হল স্বরবৃত্ত ছন্দের যেই মুক্তি, যার বল পাঁচমাত্রার ব্যতিক্রমী পর্বসমাবেশে কবিতার ভাষা ও ছন্দ চলে যাচ্ছে স্বাভাবিক উচ্চারণরীতির দিকে। আর ছন্দশরীরে নিজ কণ্ঠস্বরের অনুগামী কোনো স্রোত সঞ্চারিত করাই তো কবির লক্ষ।
‘কে তবু বলল ট্রামে উধবার আগে :
এবার কিন্তু আঙ্গিক বদলান।” ১১
নিবিড় বন্ধু এবং প্রিয় কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের
এই অমর চরণযুগলকে আলোক সরকার মন্ত্রপ্রতিম মহনীয়তায় উচ্চারণ করে থাকেন। তাঁর কাব্যাদর্শে, বিশেষত ছন্দভাবনায় এই যুগ্মকের গুরুত্ব প্রায় কিটসের ‘everything is spoilt by use’এর সমতুল।
‘আলোকিত সমন্বয় ‘(১৯৫৭)প্রকাশের পর তার অভ্যর্থনাও হয়েছিল যথেষ্ট। আলোক সরকার লিখেছেন “আলোকিত সন্বয় প্রকাশ হওয়ার পর বিষ্ণু দের বাড়ি গিয়ে তাঁর হাতে বইটি দি। বিষ্ণু দে আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি বইটি উল্টে পাল্টে দেখে আমাকে বললেন, আমি কিন্তু গদ্যে লেখা পছন্দ করিনা। শুনে আমার কি আনন্দ। ‘আলোকিত সমন্বয়ের প্রায় সব কবিতাই স্বরবৃত্তে লেখা, অথচ তিনি এটা বুঝতে পারেননি আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। তাঁর মতো অপার ছন্দজ্ঞান সম্পন্ন কবিও এটা বুঝতে পারলেন না, তাহলে আমার প্রয়াস সার্থক হয়েছে। ‘১২
কিন্তু অচিরেই তাঁর মনে হল যে এই ছন্দও বহু ব্যবহারে তার নতুনত্ব হারাচ্ছে। কবি কবি তখন জোর দিলেন ছন্দের বদলে ভাষার বিন্যাসের ওপর। ছন্দের প্রচলিত নিয়মগুলো তিনি দিলেন এল মেলো করে –
‘ঐ যে পাখিটা উড়ে গেল /ওকে আমি /পাখি বলে চিনি /’
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ সাধারণত আট মাত্রার পরে একটা বিরতি চায়। প্রচলিত ব্যবহার -৮ ৪ ৬ কিংবা ৮ ৬ ৪ পর্ববিভাজনের আঠারোমাত্রার অক্ষরবৃত্ত লেখার চল।
কিন্তু ‘ঐ যে পাখিটা উড়ে গেল ‘-আটমাত্রার পরে থামার অবকাশ পাচ্ছে না, ১০ -৪-৬ বিভাজনেই কুড়িমাত্রায় অক্ষরবৃত্তের স্বাচ্ছন্দ্য পাচ্ছে, ‘ঐ ‘অবশ্য দু মাত্রা ধরে। এই লাইনটি উদাহরণ হিসেবে আলোকসরকার নিজেই দিয়েছেন।
এইভাবে পর্ববিন্যাসের যে ছন্দমুক্তির পথে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া যায় তা তিনি তরুণ বয়সেই উপলব্ধি করেছিলেন।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দপ্রসঙ্গে জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘মাত্রাবৃত্ত মুক্তকের উদাহরণ বাংলা কবিতায় বেশি নেই এ যুগের অবাধ উশৃঙ্খলতা দমন করবার জন্যে সর্বব্যাপী নিপীড়ন যে পরিচয় পাওয়া যায় রাষ্ট্রে ও সমাজে -সেইটে কাব্যের ছন্দলোকে নিঃসংশয়রূপে প্রতিফলিত হলে মাত্রাবৃত্ত মুক্তকের জন্ম হয় কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। যদি হয় এবং কবিতার ছন্দ যদি যুগের নারীমূলের নির্দেশ দান করে, তাহলে এরকম মুক্তকে প্রচুর কবিতা আসা করা যায়। কিন্তু কোথায় তা? ‘১৩
এরই নিরিখে বলা যায়, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ তথা মাত্রাবৃত্ত মুক্তকে নিয়েও কবি আলোক সরকার কিছু প্রণিধান যোগ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিলেন। মাত্রাবৃত্ত মুক্তকে কোনো চরণে উপপর্ব রেখে আবার কোনো চরণে উপপর্ব বাদ দিয়ে তিনি একটা নতুন চাল চেষ্টা করেন।
‘হিম প্রহর ‘(রচনা কাল ১৯৬৬-৬৭)কাব্য গ্রন্থ থেকে এই উদাহরণটি দেখা যেতে পারে
‘শিশুদের খেলা /আমগাছটার /তলায়
এলোমেলো /খেলা। /
বিকেল অনেক/হলো।
শিশুদের খেলা/স্বতঃস্ফূর্ত /অরোচিত ঘন/তায়
অদৃশ্য নদী/বনান্তরের/বিশাল/
বিকেল বেলার /মালতি হয়েছে/জাগ্রত অব/হেলা।
সহজ সাজেই /বাগানে দাঁড়াও/আমিও সহজ /
পোশাকে বাগানে /এসেছি।
যে কোনো পথেই /সান্ধ্যভ্রমণ /রাখবে না খোঁজ /
কোনদিকে দিঘি /কোথায় নদীর/সুদূর। ‘…….
– ঈশ্বর –
ষান্মাত্র পার্বিক প্রচলিত মাত্রাবৃত্তে কবিতাটি লেখা হলেও কবিতার চলন ৬, ৬, ৩/৬/৬, ২/৬, ৬, ৬, ২/
৬, ৬, ৩/৬, ৬, ৬, ২/৬, ৬, ৬/৬, ৩/৬, ৬, ৬/৬, ৬, ৩ ধরনে। প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম চরণে উপপর্ব আছে। দ্বিতীয়, সপ্তম, নবম চরণ উপপর্ব হীন। উপপর্ব যেখানে থাকে সেখানেও তা বিষম মাত্রার -কোথাও দুই মাত্রার উপপর্ব কোথাও আবার তিনমাত্রার। প্রবাহবান মাত্রাবৃত্তে একধরণের বন্ধুরতার সঞ্চার ঘটে গেছে এই ভাবে।
এই ‘হিমপ্রহর ‘বইতেই টানা গদ্যে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে
লেখার প্রয়াস পরিলক্ষিত হয় ‘অসমান পথগুলি শেষ হল। এবার আমরা খুব দ্রুত যাব /এমনকি কোনো গোলাপফুলের প্রতিবাদ নেই। ‘হিমোপ্রহরের রচনাকাল ১৯৬৬-৬৭, গ্রন্থকার অপ্রকাশিত।
এইভাবে প্রথাগত ছন্দের লেখার পাশাপাশি ত্রিবিধ ছন্দ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছিল নিরন্তর। প্রথাগত অক্ষরবৃত্তে দুটি স্মৃতিধার্য চরণ উদ্ধৃত করেই আমরা চলেছে যার পরবর্তী পরিচ্ছেদে, ‘আলোক সরকারের ছদ্মনামে অভিহিত ছন্দ যেখানে আলোচিত –
‘কত যে সম্ভব ছিল দিকে দিকে শুধু আমাদের
মুহূর্ত বিলম্ব সব আড়াল করেছে। ‘
‘আদি দিগন্ত, স্তব্ধ লোক ‘
‘একই আলোয় যদি তোমায় দেখি
একই ভাষায় যদি তোমায় বলি
তাহলে আমার ভীষণ যন্ত্রনা……
তোমার জন্য আমি নতুন ভাষার প্রত্যাশী ‘
লিখেছিলেন তরুণ কবি আলোকসরকার। ‘আলোকিত সমন্বয়ের (১৯৪৭)’হিরণ্ময় দুয়ার কবিতায়। ভাষার বিন্যাসের ভেতর দিয়েই ছন্দের মূল তাৎপর্যকে স্পর্শ করেন কবি।
নতুন শব্দের সৃষ্টি ততটা নয়। শব্দের নতুন সৃষ্টিই কবিতার মূল। সেটা হয়ে ওঠে দুই শব্দের সংযোগবিন্দুতে আঘাত করেই। শব্দকে ধরে রাখে তার ছন্দপন্দ। তাই যুগে যুগে নতুন কবিকে খুঁজতে হয় ছন্দমুক্তির পথ।
অভ্যস্থ শ্রুতি প্রায় অনড় ব্যাধির মতো। একে সহজে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়, বরাবরই পাঠকসমাজ এই ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ‘১৪ মনে করতেন আলোক সরকার।
‘ছন্দস্পন্দনই হল কবির ব্যক্তিত্ব ‘বলেছেন মারিয়ান সুর। কবির কণ্ঠস্বরের, ব্যক্তিগত ধ্বনির এই স্পন্দনই ছন্দশরীরে সঞ্চার্য। ‘তাই পুরনো ছন্দের মাপা ব্যবহারে শ্রান্ত কবি যুগে যুগে দেশে দেশে আসতে চান কোনো স্থবির নৈপুণ্যকে ভেঙে দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথকে যে গদ্যকবিতা পর্যন্ত পৌঁছতে হল , তার এক প্রধান কারণ নিজের অভ্যাসের গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসা।
গদ্য ছন্দে লেখা কবিতার হঠাৎ আলোর ঝলকানি কিন্তু প্রথম দেখা যায় বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় -‘চলনামি -আসায় আসিয়াছে -চলনামি। ‘বঙ্কিমচন্দ্র তার ‘কবিতা পুস্তক’- এ এবংবিধ একাধিক টানা গদ্যে লেখা কবিতা

সন্নিবিষ্ট -করেই ক্ষান্ত হলেননা, ঐ বইএর পরিশিষ্টে লিখলেন ‘এক্ষণে যে রীতি প্রচলিত আছেন, কবিতা পদ্যেই লিখিত হইবে তাহা সঙ্গত কিনা আমার সন্দেহ আছে। ‘আলোকসরকারের প্রিয় বঙ্কিমের উপরিউধৃত চরণটি -লক্ষ করলে দেখা যাবে যে এতে পর্ববিভাজন আছে কিন্তু সে বিভাজনে পর্বগুলি সমান মাপের -নয় :
‘চল নামি/ আষাড় আসিয়াছে /চল নামি’
চার -সাত -চার মাত্রার পড়বে বিন্যস্ত।
‘লিপিকা’ থেকে ‘পুনশ্চ’ পর্যন্ত গদ্যছন্দ নিয়ে রবীন্দ্র নিরীক্ষা আলোকের নিত্য অনুধ্যেও ছিল।
আলোকসরকার জানাচ্ছেন, “গদ্যের দিকে আমার বাল্যকাল থেকেই ঝোঁক। কারণ, গদ্যই সংহতি দেয়, যথার্থ সত্য বলে। এই অন্বেষনে ১৯৬৬ সালের এক দুপুরবেলায় আমি হঠাৎ করে কটি লাইন পেলাম –
“পলাশ ফুল গুলো ভেসে চলেছে যায় নদীর ওপারে /
আজ আমার অনেক বেলা হল /বকুল ঝরানো পথে /
শেষ বিকেলের আলো……
পর্ব বিন্যাস করলে লাইনটা দাঁড়াবে “পলাশ ফুলগুলো /ভেসে চলেযায় /নদীর ওপারে। /আজ আমার/অনেক বেলা হল।/বকুল ঝরানো পথে/শেষ বিকেলের আলো ‘(নিরভিমান, তম: শঙ্খ, ১৯৯০)”
পর্ববিন্যাস থাকলেও পর্বে কোনো সমতা নেই, কোথাও সাতমাত্রার পরেই আসছে ছ মাত্রা, কোথাও পাঁচ মাত্রার পরে পর পর দুটি সাতমাত্রা, সবশেষে আটমাত্রা। এই নতুন আবিষ্কারের পর ‘তম: শঙ্খ’বইয়ে
এই ছন্দে আলোক সরকার অনেক কবিতা লেখেন। ‘অমূল্য সম্ভব রাত্রি ‘ই তার নিজের বিবেচনায় এ বিষয়ে তাঁর পরিণততম কাব্যগ্রন্থ। সেখান থেকে দুটি চরণ আমরা দেখে নেব। –
‘তাপস তরুণ অরুন বরুন কিরণে মেঘ পার
‘অরুন বরুন কিরণে ‘
প্রথম চরণে তিনপর্ব। অক্ষরবৃত্তে বা মাত্রাবৃত্তে তা দাঁড়াচ্ছে :’তাপস তরুণ (ছয়)/অরুন বরুন কিরণে (নয়)/মেঘ পার হয়ে এল (আট)। তবে এটা কোন ছন্দ? অক্ষরবৃত্ত বা মাত্রাবৃত্তে এরকম পর্ববিন্যাস মান্য নয়। স্বরবৃত্ত তো এটা নয়ই। তবু এটা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে পর্ববিন্যাসের মহিমায়। কী সেই মহিমা? গদ্যের স্বাভাবিক চলন বলনের মহিমা। যেমন পাওয়া যায় বঙ্কিমচন্দ্র – বিদ্যাসাগর -বিবেকানন্দের গদ্যে।
এই নতুন পাওয়া ছন্দে আলোকসরকার দীর্ঘদিন কবিতা লিখেছেন। এই ছন্দপ্রকরণই সাধারণ্যে ‘আলোকসরকার ছন্দ নামে অভিহিত। দীপঙ্কর দাশগুপ্ত এই অভিধার উদ্ভাবক ‘নিশীথ বৃক্ষ’ ‘রৌদ্রময়
অনুপন্থিত ‘ ‘অমূল্সম্ভব’ রাত্রি কাব্যগ্রন্থে বহুল প্রযুক্ত –
১/’বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেক্ষন বাড়ি ফিরে আসেনি ছেলে। অন্ধকারে দেখা যায়না ভালো উঁচু নিচু খালপথ বাবলা গাছ আকন্দ ফুলের গাছ। ‘
‘বাবা খুঁজতে বেরিয়েছে ছেলেকে ‘
অমূলসম্ভব রাত্রি (১৯৭৮)
২/’সেই লোক যে আজ সন্ধ্যেবেলায় এসেছিলো বর্ষায় কাদা মাড়িয়ে হাটু পর্যন্ত জল ডিঙিয়ে সে আমাকে বলল তার বলার মতো কিছুই নেই
‘নেই ‘অমূলসম্ভভ রাত্রি (১৯৮২)
৩/’ঘন মেঘে সব অস্পষ্ট হয়ে এল। আর দৃষ্টি চলেনা।
বাইরে বোষ্টমী গান গাইতে এসেছে –
চারিদিকে কাদা ও জলের ছিটে ও কথা আর মনে আনবো না।
‘সহজপাঠ আমার বাবার গলা
৪/’অনন্ত কালের শ্রমিক কাজ খুজে খুজে বেড়াচ্ছে ঐ তার হাহাকার। ‘-মেঘমলিন, রৌদ্রময় অনুপস্থিত (১৯৮৬)
৫/’ক্রমঅপসৃয়মান একটি চিত্র আর তার রেখা গুলো। আমরা রেখাগুলোর কথাই আলোচনা করছি ‘
‘উঁচু নিচু ‘, মঙ্গলদ্বীপ
৬/’সারারাত খুব বৃষ্টি হয়েছে।
এত বৃষ্টি
জলে ভিজে ভিজে
গোলাপ আর চোখ মেলতেই পারছে না। ‘
‘উৎসব’খাস রঙের আলো
ইংরেজি ভাষার কবি জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্স এর ব্যবহৃত ‘স্প্রাং রিদম ‘(sprang rhythrm)তর সখ
‘আলোকসরকারের ছন্দে-র কেউ কেউ মিল খুঁজেছেন। অসম মাত্রার পর্ব বিন্যাসেই মূলত উভয় কবির সাযুজ্য। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যে যে গদ্যছন্দ তার সঙ্গেও কেউ কেউ আলোকসরকারের ছন্দের সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন
‘আলোকসরকারের ছন্দ বলে কথিত বই ছন্দটি হাতে পাওয়ার পরেও কবি কিছুদিন অক্ষরবৃত্তে লেখেন। সাবেক স্বরবৃত্তকেও আশ্রয় করেন। তবু দেখা যায় এই নতুন ছন্দ তাঁকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। এই ছন্দের পদধ্বনি শোনা যাবে এই শতকের প্রথম দশকে লেখা ‘নিভৃতলোক'(২০০৬, মহাপৃথিবী )বইতেও –
‘যা চেয়েছিলাম তাই হয়েছে অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে এসেছে তার সাজপোশাক যেমন তার
সাজপোশাক চেনা জানা
‘তিনতারা’
অথবা, ‘আমার পিতামহ /নদীর পাশের পথ ধবর
হেঁটে বেড়াতে /ভালোবাসতেন।/পিতামহকে আমি
কখনো দেখিনি।/তবু/ সামান্য একটু জমা জল চোখে
পড়লেই/পায়ের তলার মাটি/কেমন ভিজে ভিজে চরদিকে/আধো শীত শীত। /খুব দূরের থেকে ভেসে আসা উঁচু নিচু/সজল সুর।’-“নিভৃতলোক”(২০০৬)
শূন্য দশকের শেষদিকে লেখা ‘আশ্রয়ের বহির্গৃহ’ কবিতার ‘কবিতার বইতেও ‘আলোকসরকারের ছন্দ ‘
আভাসিত: ‘সায়াহ্নের প্রথম উক্তি, সে প্রাতঃকাল নয় সে সূর্যোদয় নয় /তার কর্তব্য/বস্তুর চিহ্নিতকরণ নয় /
সে তৃণক্ষেত্র বলবে না/শিশির বলবেনা। ‘
পর্ববিন্যাসের ভেতর দিয়ে গদ্যের দৃঢ়তাকে কবিতায় আনার ব্রতে কবি স্থিরসংকল্প ছিলেন আজীবন। গদ্যের সংযত স্থির সংহত দৃঢ়তা’, তাঁর ভাষায়, তাঁর কবিতায় আজীবন ‘আরাধনা’ পেয়ে এসেছে। তাঁর এই কথা দিয়েই আমাদের এই অকিঞ্চিৎকর মিতালেক্ষ আপাতত সমাপন করি
উল্লেখপঞ্জী :
১/’বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্র ধারা,’অরুণকুমার সরকার, শতভিক্ষা অষ্টাদশ সংকলন -, ১৩৬৩,
মোহাম্মদ মতিউল্লাহ সম্পাদিত, ‘শতভিক্ষা সংকলন বইথেকে গৃহিত
২/ছন্দহীন সাম্প্রতিক, নিঃশব্দের তর্জনী (পৃ. ৪০-৪১)
শঙ্খঘোষ –
৩/তত্রৈব (পৃ ৪২)
৪/যুক্তছন্দ -২ আলোকসরকারের গদ্য সমগ্র, প্রথম খন্ড, আলোক সরকার –
৫/আলোকসরকার অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত অনূদিত ফরাসি কবিতার অনুবাদ সংকলন ‘ভিনদেশী ফুল ‘(১৯৫৬)
৬/শঙ্খ ঘোষ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সম্পাদিত বিদেশি কবিতার অনুবাদ সংকলন ‘সপ্তসিন্ধু দশদিগন্ত'(১৯৬২)
৭/ছন্দের বারান্দা (পৃ ৪৮), শঙ্খঘোষ
৮/তত্রৈব (পৃ ৭৯)
৯/’কবিতায় আত্মা ও শরীর,’কবিতার কথা (পৃ ৪৭)জীবনানন্দ দাশ
১০/’ছন্দহীন সাম্প্রতিক ‘, নিঃশব্দের তর্জনী (পৃ ৪৫)শঙ্খঘোষ
১১/’যে রাখাল দুরদেশী ‘, নিষিদ্ধ কোজাগরী (১৯৬৭)
অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত
১২/’আমার ছন্দ ‘আলোক সরকার, পূজা (চতুর্মাস কবিতা পত্রিকা ), জুন ২০১৩, সম্পাদক:বাপি সমাদ্দার
১৩/’কবিতার আত্মা ও শরীর ‘, কবিতার কথা, জীবনানন্দ দাশ (পৃ ৪৬-৪৭)
১৪/’মুক্তছন্দ -২’আলোক সরকারের গদ্য সমগ্র, প্রথম খন্ড আলোকসরকার
১৫/”আমার ছন্দ “আলোকসরকার, আলোক, চতুর্মাস কবিতা পত্রিকা, জুন ২০১৩,
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *