ডিজিটাল দুনিয়ায় কবিগান ও এক খ্যাতিমান চারণ কবি
চারণকবি গণেশ ভট্টাচার্য বিগত সাতাশ বছর ধরে বাংলার হারানো লোকগান কবিগান কে পুণঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে চলেছেন৷ এ ময়দানে তিনি একা, সহযোগিতার কেউ নেই৷
সেই ১৯৯২ সালে তার দুই শিক্ষাগুরু কবিয়াল শ্যামাপদ ভট্টাচার্য ও স্বর্গীয় মানিক চন্দ্র দাসের শিক্ষায় এবং অনুপ্রেরণায় নিজস্ব কবিগানের দল “গণেশ কবিগান ট্রুপ” গঠন করেন৷ যে দলটি ভারত সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস অনুমোদিত একমাত্র কবিগানের দল৷ পরে ২০১৪ সালে শ্রী ভট্টাচার্য বাঁকুড়ার দুই কৃতী সন্তান যামিনী রায় ও রামকিঙ্কর বেইজের নামানুসারে দলটির নামকরণ করেন যামিনী রামকিঙ্কর কবিগান ট্রুপ৷
কিন্তু কবিগানের মাধ্যমে শুধুমাত্র অর্থোপার্জন তার নেশা নয়৷ অচিরেই তিনি উপলব্ধি করেন যুবসমাজকে কবিগানমুখী না করতে পারলে রুগ্নশিল্প কবিগানের উন্নতিসাধন অসম্ভব৷ কবিগান পঞ্চরসাত্মক— আট থেকে আশি বছর বয়সী আবালবৃদ্ধবণিতার জন্য শিক্ষা ও মনোরঞ্জনের রসদ বিদ্যমান৷ অতএব দীর্ঘ অধ্যবসায় ও নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে কবিগানের গতানুগতিক ভাবধারার পরিবর্তন করে যুবসমাজকে কবিগানমুখী করতে সচেষ্ট হয়েছেন৷ অনেক যুবকযুবতী বর্তমানে কবিগান শিখতে আগ্রহী এবং গণেশবাবুর কল্যাণে ইতিমধ্যে বারোজন কবিগান শিখে দল গঠন করেছেন৷ যাইহোক, শিক্ষার্থীগণের অভূতপূর্ব সাড়া পেয়ে শ্রী ভট্টাচার্য একক প্রচেষ্টায় কবিগান শিক্ষার একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম (সিলেবাস) রচনা করেছেন, যেটি “সর্বভারতীয় সঙ্গীত ও সংস্কৃতি পরিষদ” অনুমোদন করেছেন৷ উক্ত বোর্ডের প্রক্রিয়ানুসারে ছাত্রছাত্রীদের কবিগান শিক্ষা দেওয়া হবে৷
বঙ্গ সংস্কৃতি জগতের অনেক স্বনামধন্য অনুষ্ঠানে গণেশ ভট্টাচার্য কবিগান পরিবেশন করেছেন৷ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান হল— মধ্যপ্রদেশ বঙ্গীয় পরিষদ আয়োজিত ভুপাল ববীন্দ্র ভবনে “বাংলা উৎসব”…. নতুন দিল্লী, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশে “দুর্গোৎসব”…. কলকাতায় ববীন্দ্রনাথ টেগোর সেন্টারে আই সি সি আর…. সায়েন্স সিটিতে “ইণ্ডিয়া ইন্টারন্যাশন্যাল মেগা ট্রেড ফেয়ার”…. যুবভারতী স্টেডিয়ামে “রাজ্য বিজ্ঞান মেলা”…. ঝাড়খণ্ডে টেগোর সোসাইটি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের “লোকসংস্কৃতি মেলা”৷ এছাড়া “বঙ্গ সংস্কৃতি উৎসব”, “বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন”, “বিধাননগর মেলা”, “লোকসংস্কৃতি উৎসব”, “বাঁকুড়া সংহতি মিলনোৎসব”, “বিষ্ণুপুর মেলা”, “মুকুটমণিপুর মেলা” প্রভৃতি আরও বিভিন্ন বইমেলা, স্কুল—কলেজের বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠান ও উৎসবে৷
কবিয়াল গণেশ ভট্টাচার্য প্রতিটি আসরে কবিগানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও বিজ্ঞানচেতনা দান করেন৷ বর্তমানের কিছু সামাজিক ব্যাধি যেমন পিতামাতাকে অবহেলা করা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, বিভিন্ন জলবাহিত রোগ ইত্যাদি বিষয়ে শ্রোতৃবর্গকে বিশেষভাবে অবহিত করেন৷ এক্ষেত্রে তার দীর্ঘ অবদানের জন্য এবিপি গ্রুপের আনন্দলোক ও অফিসার্স চয়েস কোং তাকে “সালাম বেঙ্গল” পুরস্কারে ভূষিত করেছেন৷প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি৷ বিদ্যালয়ে প্রথম হওয়া ছাত্রের অষ্টম শ্রেণী হতে শিক্ষায় কক্ষচ্যুতি ঘটে৷ ১৯৮৯ সালে চৌশাল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ করে কবিগানের তালিম শুরু হয়৷ পরে মালিয়াড়া রাজনারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে দ্বাদশ শ্রেণীতে পুণরায় বিচ্যুতি যটে কবিগানে সম্পূর্ণভাবে মগ্ন হন৷ একদশক পর দুর্গাপুরের ভিড়িঙ্গী টি এন ইনস্টিটিউশন থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে দুবছর কমপিউটর শিক্ষাগ্রহণ করেন৷ পরে ইগনু হতে বি এ (মেজর ইন ইংলিশ) তে ভর্তি হয়ে একসাথে কবিগান ও একাডেমিক শিক্ষা চালানো সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষার পাঠ সম্পূর্ণরূপে চুকিয়ে ফেলেন৷ কিন্তু ঈশ্বর যেন শৈশব থেকেই তাকে কবিগান দিয়েছেন, তাইতো শিক্ষক—শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী, বিদ্যালয়ের কর্মীবৃন্দ তার কবিগানে বুঁদ হয়ে থাকতেন৷
ভজন দত্ত