• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

স্নেহ

একটা একটা করে দিন যাচ্ছে আর একটু একটু করে মিতুলের জন্য চিন্তা বাড়ছে ধূর্জটিবাবুর। বিদেশ-বিভুঁইয়ে একা একা কিভাবে যে নিজের যত্ন নিচ্ছে ছ’মাসের অন্তঃসত্বা মেয়েটা ? ভাবলেই বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যায় ধূর্জটিবাবুর। তবে ধূর্জটিবাবুর মেয়ে-জামাই যেখানে থাকে সেই পুনা শহরকে অবশ্য ঠিক বিদেশ-বিভুঁই বলা চলে না। দুরন্ত গতির ট্রেনে চাপলে, কলকাতা থেকে মহারাষ্ট্রের ওই শহরটাতে পৌঁছাতে বড় জোর দেড় দিন লাগে। আর প্লেনে গেলে তো কথাই নেই, একবেলার ভেতরেই মেয়ে-জামাইয়ের দেখা মিলে যায়। এখন অবশ্য ব্যাপারটা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। লক-ডাউনের জন্য ট্রেন চলাচল বন্ধ, বন্ধ হয়েছে বিমানযাত্রাও। না হলে তো ট্রেনের টিকিট কেটেই রেখেছিলেন ধূর্জটিবাবু। দিন সাতেক পরেই গিন্নীকে নিয়ে রওনা দিতেন মেয়ের বাড়ি। মিতুল প্রেগন্যান্ট হওয়ার পর পরই ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছিল ওর হাই-রিস্ক প্রেগনেন্সির কথা, পরামর্শ দিয়েছিল পুরো সময়টাই খুব সাবধানে থাকতে। তাই ডেলিভারির আগে মিতুলের লং-জার্নি করার কোনো প্রশ্নই ছিল না। সে জন্যই তো ইচ্ছা থাকলেও ধূর্জটিবাবু এই সময়ে মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারলেন না।
লম্বা নিঃশ্বাস নিলেন ধূর্জটিবাবু। এ কি মারণ রোগ এলো পৃথিবীতে ? এতো অল্প দিনের মধ্যেই এতো মানুষের প্রাণ নিয়ে নিল ! ছোটবেলায় বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঠাকুমা মাঝে মাঝে বলতেন, বাঁশ গাছের ফুল বড় অমঙ্গলে জিনিস। কোথাও বাঁশফুল ফুটলে আর নিস্তার নেই। মড়ক লাগবেই। গ্রাম কে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে। মড়কের কথা শুনে বুকের ভেতর হিম হয়ে যেত ছোট্ট ধূর্জটিবাবুর, ঠাকুমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতেন। বড় হয়ে জেনেছিলেন, ফুলের জন্য নয় মহামারী হয় বাঁশফলের জন্য। বাঁশগাছের ফল খুব পুষ্টিকর। তাই সেই ফল খাওয়ার জন্য দলে দলে ইঁদুর ভিড় জমায়, আর এই ইঁদুরেরাই প্লেগের মতো মারণ রোগ ছড়ায়।
আনমনা হয়ে ভাবতে থাকেন ধূর্জটিবাবু। এখন তো আর বাঁশগাছ দেখাই যায় না। উন্নতির জোয়ারে ভেসে গিয়েছে বেশিরভাগ গাছপালা, তাদের জায়গায় গজিয়ে উঠেছে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাটবাড়ি, বড় বড় ঝাঁ-চকচকে শপিং মল। তাহলে কি এবার প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে ? উন্নত দেশগুলোর ওপর ?
“কি গো, দোকানে যাবে না ?”, গিন্নীর প্রশ্নে চিন্তায় ছেদ পড়ল ধূর্জটিবাবুর। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। না, আর দেরি করা যাবে না। পাড়ার দোকানটা ন’টায় বন্ধ হয়ে যায়। থলি হাতে বেরিয়ে পড়লেন ধূর্জটিবাবু।
“কাকু, তুমি আমাদের তাড়িয়ে দেবে না তো ?”
গেট খুলে বের হতে যাবেন এমন সময় একতলার বারান্দা থেকে আসা সুরেলা কন্ঠের আর্ত প্রশ্নে ধূর্জটিবাবু থমকে দাঁড়ালেন। দেখলেন বছর পঁচিশের বৈশাখী জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। মেয়েটি একটি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করে। মিতুলের বিয়ের পর একতলাটা ভাড়া দিয়ে দেন ধূর্জটিবাবু। বৈশাখী ওরই মতো আরো দুটি মেয়ে তাপসী আর সুস্মিতাকে নিয়ে মেস বানিয়ে থাকে সেখানে। কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই ওদের নিয়ে। ওরা সারা সপ্তাহ নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকে আর ছুটির দিনগুলোতে বাড়ি চলে যায়। তবে এই প্যানডেমিকের সময় ছোঁয়াচ লেগে অসুস্থ হওয়ার ভয়ে অনেকেই আর ডাক্তার-নার্সদের নিজেদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না; ভাড়া উঠিয়ে দিচ্ছেন, বারণ করছেন হাউসিং সোসাইটিতে ঢুকতে।
বৈশাখীর করুণ মুখখানা দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল ধূর্জটিবাবুর। মিতুল সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলে বৈশাখীর মতোই একজন নার্স সেবার হাত বাড়িয়ে দেবে; তার পরিচর্যায় সুস্থ হয়ে সন্তান কোলে নিয়ে বাড়ি ফিরবে মিতুল।
“না রে মা, তোরা এই কঠিন সময় নিজেদের জীবন বিপন্ন করে মানুষের সেবা করছিস। এখন তোদের চলে যেতে বললে আমার যে পাপ হবে। তুইও তো আমার মেয়েরই মতন।”, পিতৃস্নেহে বৈশাখীর মাথায় আশ্বস্ততার হাত রেখে বললেন ধূর্জটিবাবু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।