• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় ময়ূরাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়

‘সেই পবিত্র সৌম্য মূর্তি আর দেখিতে পাইব না’

বাবা তখন সিমলায়। সিপাহী বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। অনেক দিন কোনো চিঠি এলো না। উল্টে গুজব ছড়ালো -‘সিপাহীরা তাহাকে হত্যা করিয়াছে’। গুজব আর দূরত্ব দুটোই এত তীব্র ও বিপুল ছিল যে বাড়ির সবাই এই ভয়াবহ অবস্থায় প্রায় দিশেহারা। মায়ের খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ।
এমন একটা দিনরাত্রি ছিল তখন। এমন করে দূরকে ছোঁয়ার অপেক্ষা। নিজের বাবা সম্পর্কে লেখার সময় সৌদামিনী দেবী আমাদের অজানা সেই সব মুহূর্তকে নিপুণতার সঙ্গে সাজিয়েছেন। মেয়ের কলমে যেভাবে ধরা দিয়েছেন মহর্ষি, তাঁকে সেইভাবেই ছুঁয়ে দেখার চেষ্টায় এই লেখা।
সুন্দরের পূজারি, শৌখিন রুচি, নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের এক সৎ সমাবেশ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যে সময় নারীসমাজ অবগুণ্ঠনে, যে সময় কন্যাসন্তানের বিবাহই একমাত্র কাজ হিসাবে স্বীকৃত, সেই সময় তিনি তাঁর কন্যাসন্তানদের লালন করেছিলেন আধুনিকতায়। ‘ছোটো মেয়েরা ভালো করিয়া কাপড় সামলাইতে পাড়িত না তাই তাহাদের শাড়ি পরা তিনি পছন্দ করিতেন না।’ তাই দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নিজ শৈল্পিক ভাবনায় বাড়ির ছোটো মেয়েদের পোশাক তৈরি করাতেন। এই উপলক্ষে কোনোপ্রকার অনুকরণ সমর্থন করেননি তিনি। বাবা হিসাবে ভেবেছেন তাঁর মেয়েদের শিক্ষার কথা। শুধু ভাবনা না, তাদের শিক্ষা নিয়ে রীতিমতো খুঁতখুঁতে ছিলেন তিনি। সৌদামিনী দেবী লিখছেন, ‘অবশেষে একবার পিতৃদেব আমাদের পড়াশুনা কেমনতর চলিতেছে দেখিতে আসিলেন। একখানা শ্লেটে শিক্ষয়িত্রী আমাদের পাঠ লিখিয়া দিয়া গিয়াছিলেন – তাহারই অনুসরণ করিয়া কপি করিবার জন্য আমাদের প্রতি ভার ছিল। শ্লেটে লিখিত সেই পাঠের বানান ও ভাষা দেখিয়া পিতা আমাদের এই নিয়মের শিক্ষা বন্ধ করিয়া দিলেন।’ না, বন্ধ মানেই শেষ নয়। তারপর সৌদামিনী দেবী ও তাঁর খুড়তুতো বোনের পড়াশোনা শুরু হলো বেথুন স্কুলে৷
রন্ধন তো শিল্প! তাই তার শিক্ষাও যাতে যথাযথ হয় তার দিকেও দেবেন্দ্রনাথের যত্ন কম ছিলো না- ‘আমাদের রন্ধন শিক্ষার জন্য তিনি নিয়ম করিয়া দিয়াছিলেন, প্রতিদিন একটা করিয়া তরকারি রাঁধিতে হইবে।’ শুধু রান্নাই নয়, মেয়েদের চুল বাঁধা নিয়েও তাদের বাবার শৌখিনতা কম ছিলোনা। কোথাও নিমন্ত্রণে যাওয়ার সময় সৌদামিনী দেবীর ওপর ভার ছিল তার থেকে বয়সে ছোটোদের চুল বাঁধার। কোনো কোনোদিন তিনি নিজে দেখতেন চুল বাঁধা কেমন হয়েছে। তাঁর পছন্দসই না হলে পুনরায় চুল বাঁধতেও হতো। পিঁড়িতে আলপনা দেওয়া, ফুল দিয়ে ঘর সাজানো এমন সবরকম শিল্পকলায় তিনি তাঁর মেয়েদের পারদর্শিতার প্রতি যত্নদৃষ্টি বজায় রাখতেন।

‘মানসিক বিষয়ে পিতৃদেবের যেমন একটি সূক্ষ্মতা ছিল, ইন্দ্রিয়বোধ সম্বন্ধেও সেইরূপ দেখা যাইত। কোনপ্রকার শ্রীহীনতা তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না। সঙ্গীত বিশেষরূপে ভাল না হইলে তিনি শুনিতে ভালবাসিতেন না। প্রতিভার পিয়ানো বাজানো এবং রবির গান শুনিতে তিনি ভালবাসিতেন। বলিতেন রবি আমাদের বাংলা দেশের বুলবুল। মন্দ গন্ধ তাঁহার কাছে অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল- সুগন্ধ দ্রব্য সর্বদা তাঁহার কাছে থাকিত।’ পিতার সৌন্দর্যচেতনা প্রসঙ্গে সৌদামিনী দেবীর এই মন্তব্যও বুঝিয়ে দেয় বাবা ও মেয়ের গভীর মানসিক সংযোগ।

জীবনের শেষভাগে জোড়াসাঁকো আর পার্ক স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার আগে বেশিরভাগ সময় বিদেশে নির্জনবাসে থাকার জন্য বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ কমই হতো সৌদামিনী দেবীর। তিনি লিখছেন- ‘যখন চিঠিতে তাঁহার বাড়ি আসিবার খবর আসিত তখন আমাদের এত আনন্দ হইত যে, যে লোক সংবাদ দিত তাহাকে পুরস্কার দিতাম।’ এই অকৃত্রিম আনন্দ শুধু হৃদয় দিয়েই অনুভব করা যায়। শব্দে হয়তো তার যথাযথ প্রকাশ সম্ভব নয়।
বাবামশায় তাঁর সন্তানদের চোখের ভাষা বুঝতে পারতেন এমনই যে উপাসনার ক্ষণকালের সাক্ষাতেই বলতে পারতেন, ‘অমুককে আজ ভালো দেখিলাম না কেন, অমুককে যেন বিমর্ষ বোধ হইল।’ সন্তানদের যাতে কোনোপ্রকার সমস্যা না হয় তার জন্য সবরকম চেষ্টা করতেন। এমনকি নিজের অসুস্থতার সময়ও এই বিষয়ে কোনো ত্রুটি রাখেন নি – ‘তাহার কাছে থাকিয়া কেহ কোনো বিষয়ে অসুবিধা ভোগ করিবে ইহা তিনি সহ্য করিতে পারিতেন না- এমনকি ভৃত্যদেরও কোনো অসুবিধা তাঁহার ভাল লাগিত না।’
পিতা দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম্যধর্মচর্চার বহু ঘটনার টুকরো টুকরো স্মৃতি উঠে এসেছে সৌদামিনী দেবীর ‘পিতৃস্মৃতি’তে- ‘রবির জন্মের পর হইতে আমাদের পরিবারে জাতকর্ম হইতে আরম্ভ করিয়া সকল অনুষ্ঠান অপৌত্তলিক প্রণালীতে সম্পন্ন হইয়াছে। পূর্বে যে সকল ভট্টাচার্যেরা পৌরোহিত্য প্রভৃতি কার্যে নিযুক্ত ছিল রবির জাতকর্ম উপলক্ষে তাহাদের সহিত পিতার অনেক তর্কবিতর্ক হইয়াছিল- আমার অল্প অল্প মনে পড়ে।’ সৌদামিনী দেবীর লেখা থেকে একথাও জানা যায় একবার জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনের দিন তিনি বাড়ি ফিরেছিলেন, কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ না করে তিনি ব্রাহ্ম্য সমাজে গিয়ে বসেছিলেন। বাড়িতে প্রাত্যহিক উপাসনার ঘরে তিনি তাঁর সন্তানদের ব্রাহ্ম্যধর্ম পড়াতেন। কিন্তু তাঁর শিক্ষাপদ্ধতিতে কখনোই কোনো বলপ্রয়োগ থাকত না। উপরন্তু যে সব উপদেশ তিনি দিতেন তা ভালোভাবে যে লিখতে পারতো তার পাশে লিখে দিতেন উৎসাহবাক্য। এভাবেই হয়তো পিতা হয়ে ওঠেন আদর্শ শিক্ষক।
একসময় ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেল করায় পরিবারে আর্থিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেই অবস্থাতেও যার যা প্রাপ্য তা দেবেন্দ্রনাথ ঠিকই পূরণ করে গেছেন। বাবার সততা, সত্যবাদিতা এবং পরপোকারের সঙ্গে সৌদামিনী দেবী যেন একাত্মবোধ করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘সামাজিক উন্নতির পথে এখনকার কালের দ্রুতগামীরা পিতৃদেবের মৃদুগতিকে মনে মনে নিন্দা করিয়া থাকেন। তাঁহারা ভুলিয়া যান, তখন যে রাস্তা ছিল তাহা পায়ে হাঁটিবার মত, প্রত্যেক পদক্ষেপেই নিজের শক্তি প্রয়োগ করিতে হইত…’। বাবার জীবনের ওঠাপড়ার, এগিয়ে চলার কঠিন পথে যেন সৌদামিনী দেবীও হেঁটেছিলেন পাশাপাশি, এমনই জীবন্ত এই অনুভূতি।
‘প্রাচীন প্রথার সংস্কার ও আর একদিকে তাহার রক্ষণ’ এই দুইয়ের সামঞ্জস্য তাঁর চরিত্রকে দৃঢ় করেছিল। সামাজিক লৌকিক প্রথার সৌন্দর্যকে তিনি মমতার সঙ্গে লালন করতেন। তাই পরিবারে জামাইষষ্ঠী, ভাই-ফোঁটাতে কোনো বারণ ছিল না। বরং অনেকের আপত্তিও তিনি শোনেননি এই বিষয়ে। ‘তিনি যখন দেখিতেন ছেলেমেয়েরা কোনো মন্দের দিকে যাইতেছে না, তখন কোনো আচারের পরিবর্তন সম্বন্ধে তিনি নিষেধ করিতেন না।’
সৌদামিনী দেবীর ‘পিতৃস্মৃতি’-তে বাবা ও মেয়ের সম্পর্ক-সংলাপ অপেক্ষা মেয়ের উপলব্ধিতে বাবা হিসাবে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সেই সান্নিধ্যের সমস্ত অনুভূতি ধরা পড়েছে প্রতি মুহূর্তের স্মৃতিচারণায়।
ঋণ: পিতৃস্মৃতি, সৌদামিনী দেবী, স্মৃতিকথা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, নং ২৯৭৯৩
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।