• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় সন্দীপা বসু

পুরুষ – অধিকার ও বৈষম্যের লক্ষণরেখা

আজ পুরুষদের নিয়ে কিছু কথা হয়ে যাক। 

সেই কবে কোন যুগে এক রানির রূপের গল্পে মসগুল হয়ে এক ভিনদেশী পুরুষ তাঁকে দেখার জন্য বায়না ধরল। কত না ঝামেলা সেসব নিয়ে! শেষমেশ প্রতিবিম্ব দেখানো হল। ওইটুকু দেখেই সে এমন পাগল হল যে রানিকে শেষে আত্মাহূতি দিয়ে নিজের সম্মান রক্ষা করতে হল। সে সব সেই কোন যুগের কথা। বিগত কত শতাব্দী, অনন্তকাল থেকেই হয়তবা, পুরুষ নারীর ওপর কত রকমেই না নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করে আসছে! দখলে রাখছে। দমিয়ে রাখছে। এত দিন পর, এই অগমেন্টেড রিয়্যালিটির যুগে এসেও কি বদলেছে কিছু? অবশ্যই বদলেছে। আক্রমণের ধরন বদলেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার তীব্রতা, নৃশংসতাও বেড়েছে। আজ অ্যাসিড অ্যাটাক আছে, গণধর্ষণ আছে, তারপর খুন আছে, উঁহু, শুধু খুন নয়, নৃশংসতার চূড়ান্ত উদাহরণ রেখে খুন আছে, আছে নির্ভয়া, হায়দ্রাবাদ এবং আরও এমনই অগণিত কাণ্ড। এমনকি একটি তিন বছরের শিশুও রেহাই পায়না পুরুষের নৃশংসতা থেকে। আছে কর্মক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতার জোরে মহিলা সহকর্মীকে উত্যক্ত করা থেকে শুরু করে, তাকে ভয় দেখিয়ে বা অসহায়তার সুযোগ নিয়ে নিজের যৌন চাহিদা পূরণ করে নেওয়া। ঘরেও সুরক্ষিত নয় নারী। সেখানেও আছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স। পুরুষ কী বাকি রেখেছে বলতে পারেন? তাকে নিয়ে নতুন করে কীই বা বলার আছে?
কিন্তু এখানেই কি শেষ তার পরিচয়? এর পরেও কি বাকি থেকে যায়না কিছু? যদি এদের পাশাপাশি দাঁড় করাই আমার জীবনের বিভিন্ন সময়ে আসা পুরুষদের, তাহলে ছবিটা কেমন হবে? মায়ের কাছে শুনেছি আমার মুঠিতে প্রথম ধরা বস্তুটা ছিল আমার বাবার আঙ্গুল। সেই আমার চলার শুরু। ছোটবেলায় আমার সবথেকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল আমার ঠাকুরদার আশেপাশে। পড়তে বসা, মায়ের শাসন, সব কিছু থেকে বাঁচার ওই একটিই নিশ্চিত ঠিকানা। একবার তাঁর কোলের ভেতরে ঢুকে যেতে পারলে, আমি জানতাম, মা কেন, পৃথিবীর কোন শক্তিই সেখানে পৌঁছোতে পারবে না। যারা আমার দুষ্কর্মে নিজের হাত পেতে স্কেলের মার হজম করেছে, ভর দুপুরে আচার চুরি করে খাওয়া থেকে প্রথম কেনা এক বোতল বিয়ার ভাগাভাগি করে খেয়েছে, আঙ্গুল থেকে আঙ্গুলে ঘুরে বেড়ানো একটা সিগারেট, কাউন্টার নিয়ে টানাটানি করেছে, প্রথমবার প্রেমে পড়ার পর আমার প্রেমিকের গল্প শুনিয়ে যাদের বিরক্ত করেছি দিনরাত আবার সেই প্রেম কেটে গেলে যাদের কাছে গিয়ে মন খুলে কেঁদেছি আমার সেই সব সঙ্গীরা সকলেই পুরুষ। আমার শিক্ষক, যাঁর হাত ধরে আমার নতুন জন্ম ঘটেছে, বিশ্ব সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি ও ইতিহাসের সাথে যিনি প্রথম পরিচয় করিয়েছিলেন, যুক্তি এবং চিন্তা, প্রশ্ন এবং বিশ্লেষণ যিনি গেঁথে দিয়েছিলেন মনে, তিনিও একজন পুরুষ। কলেজে থাকতে সক্রিয় ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। ছাত্র নির্বাচন কেন্দ্র করে যখন গণ্ডগোল চূড়ান্ত, সেই সময় চরম বিপদের মুখ থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিল যে মানুষটি, সে ছিল এক পুরুষ। বাঁচিয়েছিল আরও কিছু হিংস্র পুরুষেরই হাত থেকে। বিশ্বাস ভেঙ্গে, আকণ্ঠ ডিপ্রেশনে ডুবিয়ে দিয়ে যে মানুষটি একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে চলে গিয়েছিল, সে ও পুরুষই ছিল। আবার যার ভালোবাসায় নতুন করে বেঁচে উঠেছি, জীবনের নতুন মানে ফিরে পেয়েছি সেও এক পুরুষ। এগুলি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলেও পুরুষের থেকে এমন ইতিবাচক অভিজ্ঞতা যে প্রায় সকল নারীরই রয়েছে সেকথা বলাই বাহুল্য। 
আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা নারী নির্যাতনের ঘটনার পাশাপাশি এমন ঘটনাও তো বিরল নয় যেখানে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একটি নারী নিজের সমস্ত রকম অস্ত্র প্রয়োগ করে, প্রলোভিত করার চেষ্টা করে পুরুষকে। সেই স্বার্থ অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজের উচ্চাকাঙ্খা বা অন্য যে কোন রকমের অভাব পূরণ অথবা সস্তায় চটজলদি বিখ্যাত হতে চাওয়ার লোভ – হতে পারে আরও অনেক কিছুই। আবার স্বার্থসিদ্ধির পথে বাধা পেলে সেই পুরুষকেই অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড় করান, এমন নারীও বিরল নন। হাতিয়ার সেই পুরনো, বহু ব্যবহৃত অস্ত্র – পুরুষটির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ। যেহেতু অভিযোগটি একটি নারী এনেছে এবং সমাজ আমাদের শিখিয়েছে নারী জন্ম মাত্রেই সে সৎ এবং শালীন, তাই সত্য মিথ্যে জানার প্রয়োজন নেই, প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে যায় যে দোষটি পুরুষটিরই। সকলে নয়, কিন্তু অবশ্যই কিছু নারী এই সুযোগটুকুর পূর্ণ সদ্ব্যবহার সাবলীলভাবেই করে থাকেন।
পুরুষের অশালীনতার বা হেনস্থার প্রতিবাদে একটি নারী পুরুষটিকে এমনকি শারীরিকভাবেও আঘাত করতে পারে। সমাজ সেটা সমর্থনও করে। এমনটাই হওয়া উচিত বলে আমিও দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাস করি। যে কোন রকম অসভ্যতা, অপমানজনক ব্যবহারের প্রতিবাদ হওয়া উচিত। অথচ ঠিক একই কারণে, একই প্রতিক্রিয়া একজন পুরুষের দিক থেকে আসলে আমরা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারি না। কারণ জানার চেষ্টা না করেই সেই মুহূর্তে পুরুষটির ওপরেই মারমুখী হয়ে উঠি একজন মহিলাকে অপমান করার দায়ে। অর্থাৎ একটি নারীর নিজেকে রক্ষা করার অধিকার থাকলেও একটি পুরুষের সে অধিকার কখনই নেই। অর্থাৎ পুরুষকে আমরা শুধু একটি পুরুষ হিসেবেই দেখছি, মানুষ হিসেবে নয়। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে আমরা শুধু নারীদেরই দেখবো, পুরুষদের নয়। অর্থাৎ সংযম, সভ্যতা, সহনশীলতার দায় শুধুমাত্রই পুরুষের। অদ্ভুত আমাদের এই দ্বিচারিতা!
কখনও আমরা ভেবে দেখেছি যে নারীর মতই, পুরুষেরও ইচ্ছে অনিচ্ছে, ভালোলাগা বা মন্দলাগা থাকতে পারে? শুধুমাত্র পুরুষ বলেই কি যে কোন নারীর স্পর্শে তাকে উৎসাহিত বা উত্তেজিত হতেই হবে? 
এখানেই শেষ নয়। সংসারে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার শুধু কি নারীরা? একটু খুঁটিয়ে দেখলে এর অন্য একটি দিক দেখা যাবে। দেখা যাবে এর শিকার পুরুষ নিজেও। একটা বয়সের পর পুরুষকে সংসারের হাল ধরতেই হবে। অথচ পরিবারের নারীদের কাছ থেকে এমন দাবী বা আশা রাখা হয় না। আজও পরিবারের কন্যা সন্তানটি যতই যোগ্য এবং স্বাবলম্বী হোক, বাবামায়ের মনে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তোলার দাবীটি মূলত একটি পুত্র সন্তানের ওপরেই থাকে। ঘর সামলানো নারীকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখে না, কিন্তু ঘর সামলানো পুরুষ আজও আমাদের চোখে পরিহাসের পাত্র – কেন এই বৈষম্য? 
আসলে সমাজ নারীর মতই পুরুষকেও নির্দিষ্ট একটি ছকে বেঁধে ফেলেছে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি পুরুষ কাঁদতে পারে না, যে কোন পরিস্থতিতে তাকে শক্ত থাকতে হয়, সে ভেঙ্গে পড়তে পারে না। কোনরকম আবেগ, অনুভুতির বহিঃপ্রকাশ তার পক্ষে একটি লজ্জাজনক অপরাধ। সেগুলিকে দমিয়ে রাখতে না পারলে সে পুরুষ নয়। সমাজের বেঁধে দেওয়া কিছু ধারনার হাতে শুধু নারী নয়, বন্দী হয় পুরুষও।    সংসারের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে নারীদের পাশাপাশি আমি পুরুষকেও দেখতে পাই। সংসারের দাবী, পরিবারের সকলের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে নিজেরদের স্বপ্ন, ছোটোখাটো সাধ এমনকি ন্যুনতম প্রয়োজনটুকুও অনেক সময় মেটাতে পারেন না, অথচ পরিবারের মুখে হাসি দেখার জন্য এই অবস্থটুকু তাঁরাও হাসিমুখেই মেনে নেন – এমন পুরুষ আমরা সকলেই দেখেছি, সকল পরিবারেই রয়েছেন এঁরা। । কিন্তু আমাদের দৃষ্টি এমনই একপেশে যে চোখে আঙ্গুল দিয়ে না দেখিয়ে দিলে তাঁদের আত্মত্যাগ সচরাচর আমরা খেয়ালও করিনা।  
ব্যতিক্রম কি নেই? অন্যরকমও কি ঘটে না? অবশ্যই ঘটে। ব্যতিক্রম ছিল, আছে। কিন্তু সেটা এখনও পর্যন্ত ব্যতিক্রমই। 
পুরুষের দোষ থাকে না বা নারী মাত্রেই সুযোগসন্ধানী এমন কথা আমি একেবারেই বলছি না। আমি বলছি দৃষ্টির স্বচ্ছতার কথা। বোঝা প্রয়োজন যে অপরাধ্মনস্কতা থেকে শুরু করে মানবিক অনুভূতি – কোন ক্ষেত্রেই প্রকৃতি নারী এবং পুরুষকে আলাদা করে গড়েননি। দুঃখ, বেদনা, আনন্দ, আবেগ, পছন্দ, অপছন্দ ভালোলাগা, মন্দলাগা, মান অপমান – নারী এবং পুরুষ উভয়েরই সমান। আমি মনে করি, শুধুমাত্র নারীর অধিকার নয়, বিশ্বাস থাকা উচিত সমানাধিকারে। নারীর মান রাখতে গিয়ে পুরুষের মান খর্ব করতেই হবে, এমন তত্ত্ব হাস্যকর। প্রকৃতি নারী এবং পুরুষকে পরস্পরের পরিপুরক হিসেবে বানিয়েছেন, প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়। মানুষ ভাল হবে কি মন্দ, সেটা তার মানসিকতার ওপরে নির্ভর করে, লিঙ্গের ওপর নয়। পুরুষ বা নারী মাত্রেই মন্দ বা ভালো হবার জন্মগত তকমা লেগে যায়না। দৃষ্টিভঙ্গির এই স্বচ্ছতাটুকু আজ বড় দরকার। 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *