সেই থেকে একটানা ঘরবার করে চলেছে মন্দিরা । বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরেই চলেছে । মানুষটা কোন সকালে বেরিয়েছে কাজের নাম করে । যাবার আগে বলে গেছে, ‘আজ একটা বড় কাজে যাচ্ছি । কুসুমপুর গ্রামের মোড়োল কুমারেশবাবুর ছেলের মুখেভাত দেওয়া হবে । পাতা ধোয়া, উচ্ছিষ্ট ফেলা, সাফসুতরো করা – কম হ্যাপা নাকি । বলেছে দেবেথোবে ভালোই । দিন কয়েক অন্তত খাওয়াদাওয়ার দুঃখ ঘুচবে আমাদের ।’
বনমালী এসব কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে । বিয়েবাড়ি, শ্রাদ্ধবাড়ি, অন্নপ্রাশন… ডাক পেলেই ছুটে যায় সেখানে । ফিরে আসে দু-চার দিনের রসদ এবং নগদ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে । এদিকে দুপুর থেকে বিকেল । একসময় বিকেলও গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে রাত নেমে এলো অথচ বনমালী যে ফেরার নাম করছে না ! মন্দিরা সেইথেকে চিন্তায় চিন্তায় আধমরা হয়ে আছে । আজকাল অনেক দুঃখের সঙ্গে সহবাস করে ও । দু’বেলা দু’মুঠো খেতে না পাবার দুঃখ । পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফালাফালা হবার দুঃখ । সন্তানহীন হয়ে জীবন কাটানোর দুঃখ । এতোগুলো দুঃখের সঙ্গে আজ এসে জুটেছে ঘরের ফুটো চাল দিয়ে অনর্গল ঝরে পড়া বৃষ্টির জলে বানভাসি হবার দুঃখ । এতোগুলো দুঃখের কোনোটা কি দূর করতে পারবে না বনমালী !
বাইরে অঝোর ধারা বৃষ্টি হয়েই চলেছে । গোটা দিন পেটে দানাপানি না পড়ায় মন্দিরার শরীরেও তেমন সাড় নেই যে লাগাতার ঘরবার করে মেঝেয় জমতে থাকা জল ঠেলেঠুলে বাইরে নিয়ে ফেলে । শরীরে যতটুকু বল ছিলো তার সবটা উজার করে দিয়েও একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে পড়ে চারপাইয়ের ওপর । আধভেজা কাঁথায় শরীর মুড়ে নিয়ে কখন ঘুমে ঢুলে পড়েছে নিজেও জানতে পারেনি ।
*
ওদিকে কুসুমপুর গ্রামে কুমারেশবাবুর ছেলের মুখেভাত অনুষ্ঠানে এঁটোকাঁটা পরিষ্কার করতে করতে বনমালীও একসময় হাঁপিয়ে ওঠে । সেই অবসরে দুপুর গড়িয়ে বিকেল এবং বিকেলও যে সন্ধ্যের হাত ধরে রাতের দিকে গড়িয়ে চলেছে ! বৃষ্টিও ঝরেই চলেছে সমানতালে । গোটা দিনে বার চারেক চায়ের সঙ্গে খান কয়েক বিস্কুট ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি । কুমারেশবাবু একবার বলেছিলেন কাজের ফাঁকেই কিছু খেয়ে নিতে । বনমালী রাজী হয়নি । ও চায় অতিথিদের খাওয়াদাওয়া মিটে যাবার পর নিজের ভাগের খাদ্য ছাঁদা বেঁধে নিয়েই হাঁটা দেবে বড়ির পথে । কুমারেশবাবুও আর একবারও খেতে বলেননি ওকে । ক্লান্ত বনমালী সামান্য জিরিয়ে নেবার জন্য চলে এলো বাইরের দালানে । এসে দেখে একটা কচি ছেলে দাওয়ায় বসে নীরবে চোখের জল ফেলছে । কাছে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই ছেলেটি চমকে গিয়ে বিস্ফোরিত নয়নে তাকায় ওর দিকে । বনমালী দেখে ছেলেটি কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে । ওকে কাঁদতে দেখে নরম গলায় শুধোয়, কাঁদছো কেন সোনা ?
– খুব খিদে পেয়েছে । কেউ যে খেতে দিচ্ছে না আমাকে ।
– খিদে পেয়েছে ? মা’কে বলছো না কেন ?
ছেলেটি জবাবে মুখ তুলে বর্ষাভেজা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, মা-মা-আ-আ-আ-গো-ও-ও-ও…
ছেলেটির কান্না শুনে ছুটে আসেন কুমারেশবাবুর । এসে ছেলেটিকে বলেন, কাঁদিস না মানিক । খিদে পেয়েছে তোর ? ভিতরে গিয়ে বলছিস না কেন জ্যাঠাইমাকে ?
মানিক নামের কচি ছেলেটি চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় ভিতরের দালানে । কুমারেশবাবুই শোনালেন মানিকের দুঃখের কাহিনী । দিন সাতেক আগে এক বর্ষাঘন দুপুরে তাঁরই ধানের জমিতে চারা রোপন করছিলো মানিকের বাবা-মা । কাজের মাঝেই ওরা দু’জনে একসাথে পুড়ে মরেছে বজ্রাঘাতে । ওদের ছেলে মানিক সেই থেকে তাঁরই কাছে আছে । কুমারেশবাবু মনঃস্থ করেছেন, সময় করে শহরে গিয়ে মানিককে রেখে আসবেন কোনো একটা অনাথ আশ্রমে । শুনে বনমালী আবদার ধরে, আমাকে দেবেন ? নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে ।
– নিবি ? নিয়ে যা তাহলে ।
*
রাত্রে খট্ খট্ করে দরজার কড়া নাড়ার শব্দে মন্দিরার তন্দ্রা কেটে যায় । বনমালী ফিরে এলো ! দ্রুত এসে দরজা খুলে চমকে যায় বৃষ্টিভেজা মানিককে দেখে । কেন জানে না মন্দিরার সহসা মনে হয়, স্বয়ং নাড়ুগোপালই যেন এসে দাঁড়িয়েছেন ওর সামনে । চমক ভাঙে বনমালীর কথায়, এর নাম মানিক । আজ থেকে ও আমাদের সন্তান মন্দিরা ।
মানিককে ঘরে ঢুকিয়ে নিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে নিঃসন্তান মন্দিরা কেঁদে ফেলে হাউহাউ করে । বনমালী বুঝেছে বলে চুপ করে থেকে মনে মনে বলে, কাঁদুক, খুব করে কাঁদুক মন্দিরা । এ যে ওর সুখের কান্না । সন্তানের মা হতে পারার সুখে ধরে রাখতে পারছে না চোখের জল ।
মানিক জীবনে আসার পর থেকে বনমালীর জীবনযাত্রাও ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকে । ওর ওই এখানে সেখানে গতরে খেটে আসা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেন স্বয়ং কুমারেশবাবু । অনাথ মানিককে আপন করে বুকে টেনে নেবার পুরস্কারস্বরূপ তিনি বনমালীকে খুলে দিলেন একটা পান-বিড়ির দোকান । সময়ের সাথে সাথে এবং বনমালীর কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসেবে ওই পান বিড়ির দোকান একদিন বদলে যায় বড়সড় একটা ষ্টেশনারী দোকানে । বনমালী তখনই মনঃস্থ করে, এই মানিককে দিয়েই নিজের অপূর্ণ সাধ পূরণ করে নেবে । ওর খুব ইচ্ছে ছিলো অনেক লেখাপড়া করে । কিন্তু সেই সাধ অপূর্ণ থেকে যায় বাপ দাশরথীর অকালমৃত্যুতে ।
বনমালী সেবারই পাঁচ কেলস পাশ দিয়েছিলো । বাপ দাশরথী অবশ্য তেমন রোজগার করতো না । বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে কচুঘেঁচু, কলমি, কুলেখাড়া ইত্যাদি শাকপাতাটাতা তুলে এনে বাজারে বেচতো । দাশরথীর অকালমৃত্যুতে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদেই লেখাপড়ার ইচ্ছেটাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বনমালীকে নামতে হয়েছিলো গতর খাটানোর কাজে । এখন ঈশ্বর যখন সুযোগ দিয়েছেন, মানিককে দিয়েই নিজের অপূর্ণ সাধ পূরণ করিয়ে নেবে । সেইমতো মানিককে ভর্তি করে দেয় স্থানীয় একটা স্কুলে । ছেলেটা প্রথম প্রথম কিছুতেই স্কুলে যেতে চাইতো না । মন্দিরা একপ্রকার জোর করেই ওকে স্কুলে পাঠাতে শুরু করে । ধীরে ধীরে লেখাপড়ায় মন বসতে থাকে মানিকের । বেশ মন দিয়েই লেখাপড়া করতে থাকে ও । এছাড়াও পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে বনমালীকে সাহায্য করে দোকানে বসে । সেই ছেলে এবার স্কুলের শেষ পরীক্ষাটাও উৎরে গেল । বনমালী আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাজারের বন্ধুবান্ধবদের ডেকে ডেকে শোনালো মানিকের পাশ দেবার খবর ।
সেই দুপুরে বাড়িতে এসে স্নানখাওয়া সেরে সবে বারান্দায় এসে বসেছে বনমালী ঠিক তখনই ওর এক দোকানী বন্ধু বিমল এসে হাজির হলো । সে এসেই গলা তুলে বলে, কী কলঙ্ক, কী কলঙ্ক ! যাকে রাস্তা থেকে ঘরে তুলে এনেছিলে শেষমেশ সেই ছেলেই কিনা ছুরি বসালো তোমার বুকে !
শুনে বনমালী দাঁত বার করে হাসে । বিমল তাতে বেজায় খেপে গিয়ে বলে, অমন দাঁত বের করে হেসো না বনমালী । দেখে পিত্তি জ্বলে যায় । লজ্জা করছে না তোমার ? ওই ছেলে যে তোমাকেই হারিয়ে দিলো ! স্কুলের শেষ পরীক্ষাটাও পাশ দিয়ে ফেললো অনায়াসে !
বনমালী এবার প্রাণখুলে হাসতে থাকে । বিমল রাগে পা দাপাতে দাপাতে ফিরে যায় । বনমালীর হাসি তবুও থামে না । হাসতে হাসতেই মনেমনে বলে, বিমল বলে কিনা, ‘ছুরি বসালে তোমার বুকে’ ! আরে ওই ছেলে আমার বুকে ছুরি বসাবে কী ? আমিই বরং ওর কোমর ভেঙে দিয়েছি । চাইলেও আর ফিরে যেতে পারবে না আগের জীবনে । হা-হা-হা ।
যার কোমর ভেঙে দিয়েছে সেই মানিক ধর্মবাপ বলে ডাকে বনমালীকে । বনমালী যখন আপন মনে হাসছে মানিক তখনই এসে দাঁড়ায় ওর সামনে, অমন পাগলের মতো হাসছো কেন ধর্মবাপ ?
বনমালী হাসি থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, কলকাতার নামী একটা কলেজে তোকে ভর্তি করে দেবো মানিক । কলেজের পরীক্ষাগুলোতেও কিন্তু এমনই ফল করে দেখানো চাই । নইলে আমি কিন্তু আস্ত রাখবো না তোকে ।
মানিক মৃদু গলায় জবাব দেয়, না মানে, তোমার তো বয়স হয়েছে ধর্মবাপ । ভেবেছি এখন থেকে তোমার সঙ্গে দোকানে….
বনমালী ওকে থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, থাক্-থাক্ । কোনো ওজরই শুনতে চাই না আমি । আর হ্যাঁ, বাজার থেকে এক হাঁড়ি রসোগোল্লা কিনে এনে বিমলকে এখুনি খাইয়ে আয় । খুব রেগে আছে তোর ওপর । ভেবেছিলো পরীক্ষায় ফেলটেল করে তুই বুঝি আমার মতো আজীবন মুখ্যু থেকে যাবি । ওটি হলো না দেখে মানুষটা… হা-হা-হা ।
বনমালী সেদিন স্বপ্নেও ভাবেনি ভবিষ্যতে কি কি ঘটতে চলেছে ওর এই আপাত সুখী জীবনে ।
*
বৃদ্ধাশ্রমের এক চিলতে কুঠুরিটির ঘুলঘুলি দিয়ে অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মিটুকু অসম্ভব সুন্দর এক সরল রেখার আকার নিয়ে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেছে । সেই আলো এসে আছড়ে পড়েছে ঘুলঘুলির মুখোমুখি দেওয়ালে । ওখানেই ঝোলানো আছে মন্দিরার মালা-চন্দনে শোভিত রঙ্গিন একটি ছবি । আলো এসে পড়েছে ঠিক মন্দিরার মুখের ওপর । স্ত্রীর মুখের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি তাকায় বনমালী । সহসা অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে যায় ওর মেরুদণ্ড বেয়ে । কেন জানে না তারপরই ওর মনে হলো, মন্দিরা যেন অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে । সেই দৃষ্টিতে জমে আছে এক রাশ ভৎসনা । ও যেন এমন কোনো গুরুতর অপরাধ করেছে যার দরুন এই ভৎসনাই ওর প্রাপ্য ।কি দোষ করেছে ভাবতে ভাবতে সহসা মনে পড়ে যায় বনমালীর । কোনোকালেই মন্দিরার কথায় তেমন গুরুত্ব দেয়নি । সেই কারণেই কি আজ ওর এই দুর্দশা ! সংসার ছেড়ে এসে উঠতে হয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে !
মন্দিরার চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই বলে বনমালী ধীরেধীরে আনত মস্তকে স্বীকার করে নেয় স্ত্রীর ভৎসনা । সত্যিই তো, ঘোরতর অন্যায় করেছে ও । ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে বিড়বিড় করে বলে, তোমার এই ভৎসনাটুকুর খুবই প্রয়োজন ছিলো মন্দিরা । কিন্তু বড্ড দেরী করে ফেলেছো তুমি । আজ না করে অনেক আগেই যদি এই ভৎসনা করতে তাহলে আমাদের ছেলেটা হয়তো এমন অমানুষ… কথাটা অসম্পূর্ণ রেখে চোখের জলে ভেসে যায় বনমালী ।
রাত হয়েছে । বৃদ্ধাবাসের এই কুঠুরির আসবাব বলতে একটা সিঙ্গল খাট, বিছানা, ছোট একটা পড়ার টেবিল এবং একটা চেয়ার । বনমালীর ইচ্ছে করলো না আলো জ্বালতে । অন্ধকার ঘরে বিছানায় বসে অতীতের দিনগুলোয় ডুবে গেল । বয়সকালে পান বিড়ির দোকানের পিছনে প্রচুর শ্রম দিয়ে সেটাকেই একদিন গড়ে তুলেছিলো একটা দোকান । সেই দোকান পানবিড়ির বদলে ষ্টেশনারী বস্তু দিয়ে পসরা সাজিয়ে নিয়েছিলো । পরবর্তীকালে ওই ষ্টেশনারী দোকান থেকে উপার্জনও করেছে নেহাত কম নয় । তার সাথে ছিলো মন্দিরা এবং কুড়িয়ে আনা বুকের ধন মানিককে নিয়ে ছোট্ট একটা সোনার সংসার । সেই সংসারে প্রাচুর্যের অভাব তেমন ছিলো না বলে মানিককে লালনপালন করেছিলো নিজের মনের মতো করে । ছেলেটা যখন যা চেয়েছে বলা মাত্র এনে দিয়েছে । যখন যা ইচ্ছে প্রকাশ করেছে সেসবও পূরণ করেছে হাসিমুখে । যেবার কলেজে ঢুকলো মানিককে সেবারই নতুন একটা বাইক উপহার দিয়েছিলো বনমালী । ওর হাত-খরচের জন্য জুগিয়ে গেছে যথেষ্ট অর্থ । এতোকিছু পেয়ে যাওয়ায় কলেজেরই কিছু বড়লোক বাপের বখাটে ছেলের সঙ্গে মিশে মানিকের বিপথগামী হতে দেরী হয়নি । সব জেনেও ছেলেকে কখনো বাধা দেয়নি বনমালী । এই নিয়ে মন্দিরা কম ঝামেলা করেনি ওর সঙ্গে । বনমালী কর্ণপাত করেনি স্ত্রীর কথায় । উপরন্তু মন্দিরাকেই প্রচুর বকাঝকা করেছে মানিকের ব্যাপারে অযথা নাক গলানোর জন্য । এক কথায়, অপত্যস্নেহের বশে বনমালী নিজেই সচেতনভাবে অমানুষ করে তুলেছিলো মানিককে ।
আজ বিকেলে এই বৃদ্ধাশ্রমেরই এক বাসিন্দা মিসেস মাধুরী স্যান্যালের মুখে শুনেছে তাঁর বৃদ্ধাশ্রমে এসে ওঠার করুণ কাহিনী । শুনে বনমালীর মনে হয়েছে, মিসেস স্যান্যাল এবং ওর জীবন যেন একই সূত্রে বাঁধা ! দুঃখ করে মিসেস মাধূরী স্যান্যাল বলেছেন, তাঁর নাকি খুব মনে পড়ে নাতি-নাতনী পাপান এবং রুমকীর কথা । কচি ছেলেমেয়েদুটো স্কুল, কোচিং ইত্যাদির চাপে পড়ে খেলাধূলা কি বস্তু ভুলেছে । দিনরাত এটা শেখো ওটা শেখোর দাবীতে পিষে চলেছে দুটি কচি জীবন । এরসঙ্গে জুটেছে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা-বাবার কড়া অনুশাসন । ছেলের অণুপরিবারে মাধুরীদেবীর আর ঠাই হয়নি । ওরাই উদ্যোগ নিয়ে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এই বৃদ্ধাশ্রমে । নাতি-নাতনি দুটি বঞ্চিত হয়েছে ঠাম্মির কোলে বসে রূপথার গল্প শোনা থেকে । তবে বছরের বিশেষ একটা দিন নাতিনাতনিকে সঙ্গ দিতে পারেন তিনি । যেদিন প্রথম এই বৃদ্ধাবাসে এসে উঠেছিলেন সেই দিনটিকে স্মরণ করে ছেলে বৌমা নাকি ফিবছর বিশেষ একটা উৎসব পালন করে নিজেদের অণুপরিবারে । ওই উৎসবের ভালো একটা নামও দিয়েছে তারা । বিদায়োৎসব । সেই বিশেষ দিনটিতে মাধুরীদেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে । দিনটি পালন করা হয় ফল, মিষ্টি, চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় এবং ফুলের মালা সহযোগে । সেই বিশেষ দিনটিতে মাধুরী স্যান্যাল কিছুটা সময় নাতিনাতনিদের সঙ্গে হেসে খেলে কাটিয়ে আসার সুযোগ পান ।
মহিলাটি কথার মাঝখানেই শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিয়ে মৃদু হেসে আরও বলেছিলেন, আগামীকালই নাকি সেই বিশেষ দিনটি পালিত হবে । তিনিও রুমকী-পাপানের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতে পারবেন । শুনতে শুনতে বনমালীর চোখের কোলে জল জমে উঠেছিলো । সামান্য হিংসেও হচ্ছিলো ওর । মিসেস স্যান্যাল অন্তত একদিন হলেও নিজের নাতি-নাতনিদের সঙ্গে… অথচ বিগত দুই বছর যাবত বনমালী যে সেই সুযোগটুকূও পায়নি । আজ বুঝেছে, এসবই হলো বনমালীর কৃতকর্মের ফল ।
মানিকের ধীরে ধীরে অমানুষ হয়ে যাওয়ার দুঃখ সইতে না পেরে মন্দিরা ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে যাচ্ছিলো । তাই হয়তো অসময়ে চলে গেলো বনমালীকে একেবারে একলা করে দিয়ে । মন্দিরার মৃত্যুর পর মানিক যেন আরও বেশী উদ্ধত হয়ে উঠেছিলো । অনেক ভেবে ছেলেকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার জন্য বনমালীকে তখনই দু’দুটো পদক্ষেপ নিতে হয়েছিলো । প্রথমে মানিককে নিয়োজিত করলো নিজের ব্যবসায় । এরপর মানিকেরই পছন্দের মেয়ে পূর্বালীর সঙ্গে ওর বিয়ে দিলো । ধনী পরিবারের মেয়ে পূর্বালী যেদিন এই বাড়িতে বৌমা হয়ে প্রবেশ করলো সেদিন নিজেই নিজের হাতে কফিনের শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিলো বনমালী ।
মানিককে বিয়ে দিয়ে সংসারে বৌমা আনার পর কিছুকাল নির্ঝঞ্ঝাটে জীবন কাটালেও বেশ বৃদ্ধ এবং অসক্ত হয়ে পড়েছিলো বনমালী । মাঝেমাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়তো । তেমন দিনেই মানিক এবং পূর্বালীর ফিসফিস করে বলা কথা কানে আসায় বুঝতে পারে মানিকের নামে দোকান সমেত সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি লিখে দিয়ে খুব ভুল করেছে বনমালী । এর কিছুকাল পরই বনমালীকে এসে ঠাই নিতে হলো বৃদ্ধাশ্রমের এই ছোট্ট কুঠুরিতে । মন্দিরা জীবিতকালেই বারবার বলেছিলো, ভুলেও যেন নিজের পায়ের তলাকার মাটিতে কোপ না বসায় বনমালী । শোনেনি স্ত্রীর কথা । শোনেনি বলে আজ তার ফল পাচ্ছে হাতে হাতে । তবে সেদিন একটা কাজ করেছিলো বনমালী । বৃদ্ধাশ্রমে পাকাপাকিভাবে ঠাই নেবার সময় স্ত্রী মন্দিরার এই ছবিটি সঙ্গে আনতে ভোলেনি ।
ভাবনায় ডুবে থেকে বনমালীর সহসা মনে হলো, মন্দিরা যেন ওকে ডেকে ফিসফিস করে বলছে, ‘যেমন কর্ম করেছো তার ফলও তুমি হাতে হাতে পেয়েছো বিগত দু’বছর বৃদ্ধাশ্রমের এই ছোট্ট কুঠুরিতে পড়ে থেকে । তবে আর চিন্তা নেই তোমার । তুমি আবার ফিরে পাবে তোমার ওই সাধের সংসার । কেন না তোমাকে আবার ফিরে গিয়ে ওই সংসারের হাল ধরতে হবে ।
বনমালী চমকে উঠে তাকায় স্ত্রীর ছবির দিকে । মন্দিরার উজ্জ্বল চোখদুটো যেন ভেসে যাচ্ছে ভালোবাসার স্রোতে ! তিরস্কারের ছিটেফোঁটাও লেগে নেই স্ত্রীর ওই উজ্জ্বল চোখ দুটিতে ! আনন্দে বনমালীর তোবড়ানো দু’গাল বেয়ে নামে অশ্রুধারা । মন্দিরা বলেছে, ও নাকি আবার ফিরে যাবে নিজের ওই ছোট্ট সোনার সংসারে ! নাতি গুবলাইকে আবার আদর করতে পারবে !
বনমালী গোটা রাত প্রায় নির্ঘুম চোখেই কাটিয়ে দেয় এই আনন্দঘন মুহূর্তটিকে সঙ্গী করে । ভোরের দিকে সামান্য তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো । সহসা কড়া নাড়ার শব্দে তন্দ্রাটা কেটে যাওয়ায় ধীর পায়ে এসে দরজা খোলে অশক্ত কাঁপা কাঁপা হাতে । দরজা খুলতেই মানিক এসে আছড়ে পড়ে ওর পায়ে, আমাদের ক্ষমা করো ধর্মবাপ । জানি তোমাকে এই বৃদ্ধাবাসে নির্বাসন দিয়ে আমরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছি । তবুও ক্ষমা চাইছি শুধুমাত্র সন্তানের দাবী নিয়ে । তোমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি ধর্মবাপ ।
বনমালী কড়া গলায় বলে, আজ হঠাৎ ধর্মবাপের প্রতি এতো দরদ কেন সোনা ? নিজেদের নিয়ে বেশ সুখেই তো ছিলে এতকাল । আজ কী এমন হলো যে আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার কথা মনে এলো তোমাদের ?
– তোমাকে এখানে রেখে যাওয়াটা যে গুবলাই কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি । দিনরাত দাদু-দাদু করে কেঁদেই চলেছে । খাওয়া দাওয়া করতে চায় না । ছেলে যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে ধর্মবাপ । অনেক ডাক্তারবদ্যি করিয়েছি । লাভ হয়নি । নার্সিংহোমেও রেখে আসতে হয়েছিলো বার কয়েক । গত দুপুর থেকে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে । ওকে রেখে এসেছি নার্সিংহোমে । ছেলে শুধু তোমাকেই কাছে পেতে চায় ধর্মবাপ ।
– শুধু এটুকুই ? নাহ্ , আমার ধারণা তোমরা আরও কিছু গোপন করছো আমার কাছে । কি সেই কথা ?
– তুমি ঠিক বলেছো ধর্মবাপ । ব্যবসায় প্রচুর ধারদেনা হয়ে গেছে । তুমি এসে হাল না ধরলে আমরা যে পাথে বসবো । চেষ্টাচরিত্র করে ব্যবসাটা সামলে নিতে পারলেও গুবলাইকে যে কিছুতেই বাঁচাতে পারবো না তুমি ফিরে না গেলে ।
পুত্রবধূ পূর্বালী কান্নাভেজা গলায় বলে, সবই আমার দোষে বাবা । আমার পরামর্শেই মানিক অনেক টাকা ঢেলেছিলো নতুন একটা ব্যবসায়ে । তখন স্বপ্নেও ভাবিনি ওই ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়বে । ওই ব্যবসা বাঁচাতে গিয়ে জলের মতো টাকা… পুরোনো ব্যবসার মূলধনেও টান পড়েছে । এদিকে বাজারেও প্রচুর ধারদেনা… পূর্বালী আর বলতে না পেরে বাকরুদ্ধ হলো ।
– হ্যাঁ, ধর্মবাপ । এখন তুমি যদি ফিরে না যাও তাহলে…
পূর্বালী এবার কান্নাভেজা গলায় শুধোলো, আপনি ফিরে যাবেন না বাবা ? আমাদের সঙ্গে ?
বনমালী কী জবাব দেবে ভেবে না পেয়ে ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকায় দেয়ালে ঝোলানো স্ত্রী মন্দিরার ছবিটির দিকে । মন্দিরা কোন ইঙ্গিত দেয় সেই আশায় ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে নিস্পলক চোখে । সহসা মন্দিরা যেন ওর কানে কানে ফিসফিস করে বলে, ভুলে গেলে কেন, ‘একলা পুরুষ কর্তব্যে, একলা পুরুষ পিতায়’ ? তুমি না সন্তানের পিতা ? তাহলে তোমার মনে এখনো এতো দ্বিধা কেন ?
স্ত্রীর ছবিটির দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে বনমালী ধীরে ধিরে ঘাড় নাড়তে থাকে, ঠিক বলেছো মন্দিরা । ঠিকই বলেছো তুমি । আমি না সন্তানের পিতা ? আদর্শ পিতার কর্তব্য যে পালন করতেই হবে আমাকে ।