• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় পত্রালিকা

ম্যাজিকম্যান

কলি – বাবা, তুমি এখনও না খেয়ে বসে আছো? তোমায় কতবার বলেছিনা আমার দেরি হলে খেয়ে নেবে তুমি। তুমি কি একটা কথাও শুনবেনা আমার।
কটা বাজে দেখেছো?
সৌমেন বাবু – তোর কোন কথাটা শুনিনা রে কলি। এই রাতের বেলাটা দুজনে একটু একসাথে খাই, তুইও অফিসের কথা বলিস, আমিও সারাদিনের কিছু জমা কথা উগরে দি, এই একটা সময়ই তো একটু তোকে কাছে পাই কলি। সে যত রাতই হোক, আর যতই বাজুক আমি বসেই থাকবো তোর জন্য।
কলি – তোমার এই এক কথা রোজ। রোজই তো আমরা একসাথেই খাই, যেদিন দেরি হবে সেদিন না হয় আমি খেয়ে উঠে তোমার সাথে বসে খানিকক্ষণ গল্প করবো। তাহলে হবে তো নাকি? নইলে যে এরকম অনিয়ম করলে তোমার শরীর খারাপ করবে, তোমার তো বয়স বাড়ছে বাবা, এটা তো মানবে।
সৌমেন বাবু – সে তোমার সবকথা শুনি আমি। এই একটা কথা আমি শুনব না।
কলি – তুমি তো যত বড় হচ্ছো তত বাচ্চা হয়ে যাচ্ছ বাবা, তোমায় নিয়ে যে আমি কি করি।
সৌমেন বাবু – কলি, তোকে আমায় নিয়ে কিচ্ছু করতে হবেনা, তুই এবার একটা বিয়ে কর। আমি একা থাকতে পারবো মা, তোর এত চিন্তা করতে হবেনা। তুই নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে নে এবার। তোকে নিয়ে আমারও খুব চিন্তা হয়। আমার অবর্তমানে…
কলি – বাবা তুমি আবার শুরু করলে? তুমি তো জানো আমি কি চাই। আমি তো বলেই দিয়েছি তোমায় ছাড়া আমি কোথাও যাবোনা।
সৌমেন বাবু – এসব আবার হয় নাকি রে। তুই কি উল্টোপাল্টা জেদ ধরে আছিস। আমি কিন্তু এখনও বলবো কলি, সায়কের সাথে তোমার সম্পর্কটা ভেঙে দেওয়া ঠিক হয়নি। এটা কেউই মানবে না কলি, এটা তুমি অন্যায় জেদ করছো।
কলি – বাবা, প্লিজ এই সায়কের প্রসঙ্গটা তুলে তুমি আমার মাথাটা গরম করে দিওনা। যে ছেলে চারবছর ধরে আমার সাথে সম্পর্ক অথচ, তার কাছে আমার ইচ্ছে, আমার ভালোবাসার কোন দাম নেই তাকে নিয়ে আমি কথা বলতে চাইনা।
রাগের মাথায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলেই নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে কলি, আর তার আবার মনে পড়ে যায় সায়কের সাথে সম্পর্কের শেষের দিনগুলো, আর কিছু কথা।
সায়ক – এটা তুমি অন্যায় জেদ করছো কলি। আমি তোমার বাড়িতে ঘরজামাই থাকবো এতে কি আমার সম্মান থাকবে? আর নইলে তুমি বলছো আমার বাড়িতে তোমার বাবাকে নিয়ে যাবে। আচ্ছা কলি সেটা নাহয় আমি মানলাম, কিন্তু আমার বাবা মা? তারা কি এটা মানবে? আর কাকুরও তো অস্বস্তি লাগবে।
কলি – তোমার কেন সম্মান থাকবেনা আমাদের বাড়িতে থাকলে? আমিও তো বিয়ের পর তোমার বাড়িতে থাকবো তাতে কি আমার সম্মান কমে যাবে নাকি? কে কোথায় থাকলো তার ওপর কি সম্মান বাড়া কমা নির্ভর করে নাকি?
আর বাবার আমার সাথে থাকলে কোন অস্বস্তি হবেনা সায়ক, তবে তোমার বাবা মার যদি আপত্তি থাকে সেটা তোমার সমস্যা, তুমি ভেবে দেখো সেক্ষেত্রে কি করবে।
সায়ক – তুমি ছেলেমানুষী করছো কলি? সমাজ সংসারের কিছু নিয়ম কানুন আছে, আমরা চাইলেই সেটা একদিনেই সব ভেঙে দিতে পারিনা।
কলি – তা হয়তো পারিনা, তবে আমি আমার বাবাকে একলা ছেড়ে দিতে পারবনা। আমি খুব সাধারন মানুষ, সমাজ সংসারের এত জটিল তত্ত্বকথা আমার মাথায় ঢোকেনা সায়ক।
সায়ক – একলা ছেড়ে দিতে কে বলছে তোমায়? আমরা ছুটির দিনে কাকুর কাছে চলে যাবো। ওনার সাথে সময় কাটাব, নইলে ওনাকে আমাদের বাড়িতে ডেকে নেবো।
কলি – আচ্ছা আর আমার বাবার যদি ছুটির দিন ছাড়া বাকি দিনগুলোয় কোন শরীর খারাপ থাকে, বা আমায় তার প্রয়োজন হয় তাহলে?
সায়ক – তোমার মাথার ঠিক নেই কলি। তাই যা নয় তাই বলছো।
কলি – আমি সব বুঝতে পারছি সায়ক। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি কোনোদিনই এই ব্যাপারটা বুঝবেনা। শুধু শুধু রোজ এই এক জিনিস নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি চলতে থাকবে। তার চেয়ে বরং…
কথাটা শেষ করতে হয়না কলিকে, তার আগেই বলে সায়ক, শোনো কলি, এমন অন্যায় জেদ কোন ছেলেই কিন্তু মেনে নেবেনা। আমার মনে হয় এই সম্পর্কটা এখানেই শেষ হওয়া উচিৎ। তবে একদিন তোমার ভুল তুমি ঠিক বুঝতে পারবে কলি।
সেদিন কলি আর কোন কথা না বাড়িয়ে ওখান থেকে চলে আসে, আর বাসে উঠে জানলার পাশে বসে ওর গলার কাছটায় কেমন কষ্ট দলা পাকিয়ে আসে, এক কাছের মানুষের জন্য আরেকজনকে বিসর্জন দেওয়া যে কতটা কঠিন সেটা বেশ বুঝতে পারছে কলি, তারপর বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, আচ্ছা কি এমন চেয়েছি আমি? মা ক্যান্সারে মারা গেছে সেই পাঁচ বছর বয়সে, তারপর থেকে তো বাবাই কলির সব। এখনতো মায়ের ছবিটা না দেখলে মায়ের মুখটা ঠিকমত মনেও পড়েনা কলির, অত ছোটবেলায় দেখা, আস্তে আস্তে তলিয়ে গেছে স্মৃতির অতলে। বাবা তো শুধুমাত্র কলির জন্যই বিয়ে থা তো দূরের কথা, সারাটাজীবন শুধু কলির জন্যই মা বাবা দুইই হয়ে রইলো, কোনোদিন কলিকে মায়ের অভাব বুঝতেই দিলনা। ঠামি কত বলতো বাবাকে বিয়ের জন্য, বাবা কিছুতেই রাজি হয়নি, তখন আমার কথা বোঝার বয়স না হলেও কানে আসতো সবই। ঠামি আমায় মজা করে বলতো, বাপসোহাগী মেয়ে। যেদিন বাবাকে ছেড়ে শশুরবাড়ি যাবি, দেখবো সেদিন কেমন করে থাকিস।
অফিসের কাজ সামলেও বাবা ঠিক কেমন সামলে নিত কলিকে, এসব ভাবতে গেলেই কলির মনে পড়ে যায় পুরনো দিনগুলো। রোজ সকালে উঠেই কলি বায়না করতো বাবা আজকে তুমি অফিস যাবেনা, আমিও স্কুল যাবনা, প্রত্যেকদিনই বাবা ঠিক বুঝিয়ে পাঠিয়ে দিত স্কুলে, বাবা অফিস থেকে ফিরে কলির পড়াশুনো, রবিবারে আঁকার ক্লাস, বিকেলে নাচ সবকিছুতেই ছিল বাবা।আর নাচের ক্লাসের অনুষ্ঠানের দিনগুলোয়, বাবা সব ড্রেস আর সাজার জিনিসগুলো ঠিক বুঝে কিনে এনে দিতো, কোনোদিন অন্য বন্ধুদের মায়েদের সাথে বাবার কোন তফাৎ বুঝতেই পারেনি কলি।এতগুলো বছর পার হয়ে গেছে, এখন অফিস থেকে ফেরার পরও বাবা একইরকম বসে থাকে কলির জন্য, আর বাবার বয়স হয়েছে, এখন নিজের জীবনটাকে সাজিয়ে নেওয়ার সময় সেই বাবাকেই বাদ দিয়ে দেবো জীবন থেকে, এও কি সম্ভব। না না এ কিছুতেই হতে পারেনা, তাতে বিয়ে না হয় না হবে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সেদিন বাড়ি ফিরেছিল কলি, কিন্তু সৌমেন বাবু সেদিন বেশ রাগ করেছিলেন এই বিষয় নিয়ে, কয়েকটা কড়া কথাও শুনিয়েছিলেন কলিকে, কিন্তু তাতেও কলি তার সিদ্ধান্তে অনড়।
পরেরদিন সকালে আবার অফিস, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তাই আর দেরি না করে শুয়ে পড়তে হবে, ভাবতে ভাবতেই কলি একবার উঠে যায় সৌমেন বাবুর ঘরে। ঘরের দরজাটা ভেজানো, সৌমেন বাবু বেশ কুঁকরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে, কলি চাদরটা খুলে গায়ে দিয়ে দেয় বাবার, আর চোখের সামনে দেখতে পায়, এমন করে প্রায়দিনই চাদর গায়ে না দিয়েই ঘুমিয়ে পড়ত কলি, সকালে উঠে দেখতো সেই তার ম্যাজিকম্যান ঠিক চাদরটা দিয়ে গেছে তার গায়ে।এবার নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপটা খুলে অফিসে পরের সপ্তাহে একটা সাতদিনের ছুটির মেইল করে, আর অনলাইনে দুটো টিকিট কেটে ফেলে নর্থবেঙ্গল টুরের। বাবা আর মেয়ের এতদিন পড়াশুনো, অফিস সব নিয়ে কোথাও প্রায় ঘুরতেই যাওয়া হয়নি, আর এটাই তো সময় বাবা মেয়ের ঘুরে বেড়ানোর। তারপর বেশ রাত করেই ঘুমায় কলি।
সকালবেলা একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠেন সৌমেন বাবু। আজ কলির মর্নিং শিফট অফিসে তাই আগেই বেড়িয়ে গেছে। সৌমেন বাবু ব্রেকফাস্ট নিতে এসে দেখেন জুসের গ্লাসটার নিচে একটা কাগজ, তাতে কিছু লেখা। চশমাটা পড়ে কাগজটা হাতে নিয়ে দেখেন তাতে লেখা আছে,
বাবা,
নিশ্চয়ই উঠে পড়েছো। মিনতি মাসী সব গুছিয়ে রেখেছে, খেয়ে নিও সময়মত। আর আপাতত বিয়েটা আমার করা হবেনা। ওই বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তা ছাড়ো। তুমি যেমন তোমার মেয়ের জন্য কোনোদিন কাউকে বিয়ের কথা ভাবনি, আমিও তেমন আমার বুড়ো ছেলেটাকে ছেড়ে বিয়ে করে নাচতে নাচতে শশুরবাড়ি যেতে পারবনা। বুড়ো হোক আর কচি, সন্তান তো সন্তানই হয়, কি বলো? কেউ যদি আমার কথা মেনে আমায় বিয়ে করে, সেদিন না হয় এই বুড়ো ছেলেটাকে নিয়েই তার ঘাড়ে চেপে বসবো। এখন আমরা পরের সপ্তাহে বেড়াতে যাচ্ছি পাহাড়ে, তুমি গুছিয়ে নিও একটু একটু করে। বাবা সেই পাহাড়ে যাবো আমরা, তোমার মনে আছে বিকেলে তোমার পিঠে চেপে ছাতে উঠে আমরা আকাশ দেখতাম, আর মেঘগুলোকে দেখে কল্পনা করতাম, ওই মেঘটা একটা নীল পাহাড়, তার পাশেই আমাদের বাড়ি, আমরা বাড়ির বাইরের বাগানে বসে চা খাচ্ছি আর পাহাড় দেখছি।
চিঠিটা হাতের মুঠোয় ধরে চোখে জল এসে যায় সৌমেন বাবুর, ঠিকই তো এমনই কল্পনার জগতে কলিকে নিয়ে ভেসে বেড়াতেন তিনিও, আজ সেই স্বপ্নই সত্যি হতে চলেছে। আবার সৌমেন বাবুর মনের ছবিতে উঁকি দিচ্ছে সেই পাহাড়, সবুজের সমারোহ, পাশে ছোট্ট ঝর্না, আর সেখানেই ভাসছে সাত রঙের রামধনু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *