• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় পার্থ সারথি গোস্বামী

“একলা পুরুষ কর্তব্যে
একলা পুরুষ পিতায়”

“জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায়না” – সাহিত্য, চলচিত্র এমনকি দৈনন্দিন জীবনের অতি সাধারন একটি সংলাপ । আর এই একটি সংলাপই প্রমান করে বাবা হওয়া সহজ কথা না । বর্তমান পৃথিবীতে যখন নারী পুরুষ উভয়েই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উপার্জন করছেন সংসারের জন্য , সেই সময়ে দাঁড়িয়েও খারাপ মা খুঁজে না পাওয়া গেলেও খারাপ বাবা খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই । ‘বাবা’ মানেই এক একক দ্বায়িত্ববান পুরুষ, বাবা মানেই সন্তানের ইচ্ছে পূরণ কল্পতরু , বাবা মানে হাজার ধকল সয়েও হাসিমুখ , বাবা মানে শক্ত করে ধরে থাকা একটা হাত, বাবা মানেই মেলার মাঝে হাজার আবদার, বাবা মানেই জটিল অঙ্কের সহজ সমাধান, বাবা মানেই ডিকশনারি বা এনসাইক্লোপিডিয়া অর্থাৎ বাবা সেই সুপারহিরো যার চওড়া বুক পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান পৃথিবীর সব সন্তানের কাছে ।
সৃষ্টির শুরু থেকে মা তাঁর অবস্থানে অনড় থাকলেও সময়ের সাথে সাথে বাবারা কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছেন প্রতিনিয়ত, সময়ের সাথে সাথে বাবার ভূমিকা হয়ে উঠেছে অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ন । যদিও তার মূলে রয়েছে সমাজের পারিবারিক গঠন ব্যবস্থার পরিবর্তন । সেই সাবেক জমানায় , একান্নবর্তী পরিবারের যুগে দেখা যায় বাবা মানেই এক অনন্য সম্ভ্রম , অসম্ভব দাপুটে একটি মানুষ যাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলা বারন, যাঁর সামনে উঁচু গলায় কথা বলা বারন । সেই সময় বাবা মানেই অগাধ শ্রদ্ধা আর অনেক বারন । তাছাড়া একান্নবর্তী পরিবারে বাবার সাথে সন্তানদের যোগসূত্রও ছিলো অনেক কম , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা দূরত্ব গড়ে উঠতো বাবার সাথে সন্তানদের , বাবার তুলনায় তারা বরং সবার প্রিয় বাড়ির কাজের মানুষটির সান্নিগ্ধ্য লাভ করতো অনেক বেশি । একান্নবর্তী পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী একক উপার্জন সন্তানের চাহিদা, আবদার ও সমৃদ্ধির ওপর তেমন একটা প্রভাব ফেলতো না , এমনকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাবা অপেক্ষা মূল ভূমিকা ছিলো সংসার প্রধানের ।
বাবার ভূমিকা অনেক বেশি কঠিন হোল পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগে । বাবাই সংসারের একমাত্র পুরুষ হওয়ায় সন্তানের সকল প্রয়োজনীয়তার সিংহভাগ দখল করলো বাবাই । বাবাকে একাই হয়ে উঠতে হোল ফ্রেন্ড, ফিলজফার ও গাইড । বাবার আদর্শের ওপর নির্ভর করতে থাকলো সন্তানের চারিত্রিক গঠন ও চারিত্রিক দৃঢ়তা । বাবার দ্বায়িত্ব বেড়ে গেল অনেকখানি । তাই বর্তমান যুগে বাবা মানব থেকে রূপান্তরিত হলেন অতিমানবে । একক পরিবারে সন্তানের কাছে আদর্শ তার বাবাই, তাই একজন আদর্শ বাবাকে হয়ে উঠতে হল অনেক বেশি সংযমী, পরিশ্রমী ও আদর্শবান । ছেলের খেলার সঙ্গী থেকে অবসরের বিনোদন , বাবাই হলেন সন্তানের একমাত্র পছন্দ ও চাহিদা । অর্থাৎ বাবা মানেই সেই কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি যাঁর নিজের সুখ অসুখের আগে সন্তানের সকল চাহিদা মেটানোই একমাত্র অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ।
যদিও বর্তমান সময়ে অনেক পরিবারের ক্ষেত্রেই উপার্জনের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের ভূমিকা প্রায় সমান সমান , তবুও প্রতিটি পরিবারে বাবার দায় ও দ্বায়িত্বের এখনো কোন বিকল্প গড়ে ওঠেনি । সন্তানকে ভালো পরানো, ভালো খাওয়ানো , ভালো ছেলে হিসাবে গড়ে তোলা এমনকি ভালো স্কুলে পড়ানো সব দায়ই বর্তায় সেই বাবার ওপরেই, এগুলির কোন ক্ষেত্রে অপারক হলে অভিযোগের আঙ্গুল কিন্তু কোন ভাবেই মায়ের ওপর ওঠে না , আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় বাবাকেই । তাই বর্তমান যুগে একজন আদর্শ বাবার দ্বায়িত্ব শুধু উপার্জনেই সীমাবদ্ধ নেই, বাবাকে অর্জন করতে হয় অসম্ভব রকমের চারিত্রিক দৃঢ়তা , বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবাই যেহেতু সন্তানের সুপারহিরো তাই বাবাকে হয়ে উঠতে হয় একজন ‘ভালো বাবা’ , আর ভালো বাবার আত্মমর্যাদা বহন করতে গিয়ে মানুষটি বর্জন করেন আত্মসুখ । সন্তানের সকল চাহিদা পূরণে ভেতরে ভেতরে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয় নিজের সাথে নিজেরই , প্রতি পদে পদে কঠিন কঠিনতর হয়ে ওঠে জীবন-সংগ্রাম , কখনো দ্বায়িত্ব কর্তব্যের জাঁতাকলে হাঁপিয়ে ওঠে মানুষটি, আবার কখনোবা সবার মাঝে থেকেও হয়ে পড়ে ভীষন একলা । তবুও যেহেতু সন্তানের চোখে বাবা একজন আদর্শ পুরুষ, আর পুরুষদের কাঁদতে নেই তাই শত কষ্টেও বাবাকে কাঁদতে নেই, হাজার একাকীত্ব এলেও তাঁকে একলা অনুভব করতে নেই, যদিও দ্বায়িত্ব কর্তব্য থেকে পিতৃত্ব সকল বিষয়ে বাবার ভূমিকা ভীষন রকমের একক ।
স্নেহ ভালোবাসা ও দ্বায়িত্ব কর্তব্যের ভান্ডার উজাড় করার পরও একজন বাবা বা একজন পুরুষ জাহির করতে পারেনা নিজের ভালোবাসার কথা, নিজের একাকিকত্বের কথা এমনকি নিজের চাহিদার কথাও , নিজের শত কষ্টেও মুখ ফুটে কষ্টের কথা বলেননা বাবারা । হয়তো অনেকটা সেই কারণেই সন্তানের জন্মদেওয়া ও হাজার কর্তব্যে একক ভূমিকা পালন করা বাবারা দিন দিন আরও বেশি করে একলা হয়ে পড়ছেন । বর্তমান যুগে সকল ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে সবারই সন্তান সংখ্যা এক থেকে দুইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ , নিজের সর্বসুখ বিসর্জন দিয়ে ছেলে বা মেয়েকে মানুষের মত মানুষ করার পর বাবা মায়ের কাছ থেকে সন্তানদের কেড়ে নিচ্ছে দূরের শহর বা অন্য দেশ । সফল সন্তানেরা নিজের সাফল্যকে ( পিতার নয় ) বাস্তবে রূপান্তরিত করতে মোটা মাইনের চাকরির জন্য পাড়ি দিচ্ছে বাবা-মায়ের থেকে দূরে অন্য কোন শহরে বা বিদেশে , সন্তানরাও সংসারজীবনে প্রবেশ করে নিজেরাও নেমে পড়ছে আদর্শ বাবা হবার প্রতিযোগিতায় । সেখান থেকে হাজার মাইল দূরের কোন শহরে বা কোন প্রত্যন্ত গ্রামে আরো একলা হয়ে দিনযাপন করছেন বাবা-মায়েরা । সেই একাকিকত্বের বা অসায়তার কথা মায়েরা অনেক সময় মুখ ফুটে প্রকাশ করলেও বাবারা আজও নির্বিকার । অপ্রকাশিত যন্ত্রনা বুকে চেপেই ভীষন একলা বাবারা আরো একলা হয়ে অটল থাকছেন নিজ কর্তব্যে ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।