• Uncategorized
  • 0

“পুরুষ” নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় অর্ঘ্য দত্ত

না ভোলা কথা

অবাক কাণ্ড! মানুষের জীবনের প্রাচীনতম স্মৃতি নাকি জড়িয়ে থাকে তার ছিন্ন নাড়ির সঙ্গে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে না নাড়ি, না কোনো নারী। বরং গভীর অন্ধকার পাতকুয়ার মধ্যে দ্রুত পতনশীল দড়ি-বালতির মতো নিজের একাগ্রতাকে সূচীমুখ করে অতীতের অতলে বারবার নামিয়ে দিয়ে দেখেছি, গভীরতম যে স্মৃতিকে তা স্পর্শ করে সেখানে তিনটি পুরুষ মূর্তির অধিষ্ঠান। জরি-সলমার মুকুট শোভিত ও কাঠির তীর-ধনুক হাতে ময়ূরাসীন দেব-সেনাপতি কার্তিকের এক জোড়া মৃন্ময় মূর্তি এবং ছফুটের চেয়েও বেশি দীর্ঘ ও ঋজু, শ্যামল ও সুদর্শন এক যুবক। আমার পিতৃদেব। সাত বছরের বড় দিদি শুনেই বলল, “যাঃ! তোর জন্মের দু বছর পরে বাবু জোড়া কার্তিকের পুজো দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তোর সে স্মৃতি থাকার কথা নয় মোটেই।”
তাই? দু বছর বয়সের স্মৃতি বুঝি থাকে না মানুষের? স্মৃতির কোনো নিয়ম আছে? কী জানি!
প্রথম সন্তান দিদির সাত বছর বাদে আমার জন্ম। পুত্র হলে জোড়া কার্তিক পুজো দেবেন আমার কমিউনিস্ট বাবা কি এমন মানত করেছিলেন? তাহলে সে পুজো দিতে আমার জন্মের পরে দু’বছর অপেক্ষা কেন? আমার জন্মের পনেরো মাসের মাথায় যে তৃতীয় সন্তানের জন্ম তার জন্য‌ই কি অপেক্ষা করছিলেন! আবার পুত্রের‌ই আশায়? কিন্তু সেই সন্তানটি কন্যা হ‌ওয়াতে কি নিরাশ হয়েছিলেন? জানি না। আজ কে আর এসবের উত্তর দেবে? কিন্তু আমাদের শরৎ ধর রোডের শরিকি বাড়ির রাস্তার ধারের ঢাকা বারান্দায় সেই জোড়া কার্তিক পুজোই আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি। সে পুজোর আশেপাশে কোথাও কিন্তু মায়ের মুখ দেখতে পাই না। দেখি শুধু বাবার মুখ। অথচ সবাই জানে আমি চিরকাল মা ন্যাওটাই ছিলাম। কিন্তু মায়ের কথা ভাবতে বসলে তার মধ্যবয়সের আগের চেহারাটা কিছুতেই আর মনে করতে পারি না। অথচ বাবাকে কতটুকুই বা কাছে পেয়েছি! তবু তাঁর কত যে বর্ণময় ঝলমলে স্মৃতি! সে কি কম পেয়েছি বলেই?
বাবা বললেই মনে হতো যেন পৃথিবীর সব সমস্যার একমাত্র সমাধান। সবার থেকে লম্বা, সবার থেকে বলবান এক পুরুষ, যাকে ভয় ও ভরসা, দুই করেছি সীমাহীন। ঐ শিশু বয়সেই দেখেছি যে পুরুষটি শাসক দলের বিরুদ্ধে নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে মাত্র আঠাশ ভোটে হেরে যাচ্ছেন কিন্তু ভয় পাচ্ছেন না। সে সময়ের ভোটের পোস্টার, ভোটের দিনে বুথের সামনে পাড়ার কাকুদের ব্যস্ততা, ভোট গণনার সময়ের উত্তেজনা এসবের সিপিয়া রঙা ছবি যেন এখন‌ও অমলিন। দিদির ঠোঁটে যদিও আবার সেই অবিশ্বাসের হাসি, “তোর তো তখন চার বছর বয়স! তোর এত সব মনে আছে?”
আমার পাঁচ বছর বয়সেই শরিকি বাড়ি ছেড়ে বাবা সপরিবারে চলে এসেছিলেন। নবীন চন্দ্র দাস লেনে পাকা দালান বানিয়ে। শরিকি বাড়ির একখানা ঘর থেকে এসে নতুন বাড়ির প্রশস্ত বারান্দা, ঘরে ঘরে টিউব লাইট, বাথরুমে শাওয়ার ও তিনদিকে তিনটি কোলাপসিবল গেট আমাদের প্রভূত আনন্দ ও গর্বের বিষয় হয়েছিল। কিন্তু বাবা নিজে সে বাড়িতে আর বেশিদিন টানা থাকতে পারেননি। আমার শৈশবদশা শেষ হ‌ওয়ার আগেই বাবা চলে গিয়েছিলেন কাষ্টডাঙা। নদীয়া জেলার হরিণঘাটা থানার অন্তর্গত এক প্রত্যন্ত গ্রাম। কলকাতার ভালো চাকরি ছেড়ে সেই গ্রামের এক জনহীন প্রান্তে সামান্য টাকায় কিছু অনুর্বর জমি কিনে বিজ্ঞানসম্মত কৃষিপদ্ধতিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন। খুলনা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কলকাতা শহরে আসা এক সাধারণ পরিবারের ছেলে হয়ে যত‌ই পড়াশুনা করুন, তার অন্তরের মধ্যে বোধহয় বেঁচে ছিল এক গ্রামীণ আত্মা। কৃষিজমির নিজস্ব গন্ধ, খেত জুড়ে পাকা ফসলের রঙ, গাছগাছালির মায়া তাকে বোধহয় নিয়ে যেত রক্তের ভিতরে বহমান ফেলে আসা শিকড়ের সান্নিধ্যে! নাকি ঐ গ্রামের তথাকথিত অশিক্ষিত, দরিদ্র মানুষদের বিনীত মুখে ‘বাবু’ সম্বোধনের লোভ! সেই ডাক শোনার নেশা! বেশির ভাগ বাঙালি কমিউনিস্ট ভদ্রলোকের মধ্যে নিহিত দ্বৈত সত্তার মতোই কি তার ভিতরেও লালিত হচ্ছিল সামন্ততন্ত্রের গুপ্ত বীজ?
বাবা সেই গ্রামেরবাড়ি থেকে মাঝে মাঝে বরাহনগরে তার নিজের করা বাড়িতে আসতেন কিছু দিনের জন্য।
বাবা এলেই সারা বাড়ি যেন ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়ত! আমরা নিচু স্বরে কথা বলতাম। জোরে আওয়াজ করে পড়তাম। মায়ের উৎকন্ঠা ও ব্যস্ততা দুইই বেড়ে যেত। তবু যেন কোন গোপন গর্জন তেলে মার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো! মনে আছে, আমার দায়িত্ব ছিল পাড়ার পড়ুয়া প্রতিবেশীদের বাড়ি থেকে ব‌ই ধার করে আনা। দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে পাড়ার মলয়কাকু, বিনয় জেঠুদের বাড়ি থেকে কত ব‌ই যে এনে দিতাম! ব‌ই ছাড়া বাবার অবসর কাটতো না। আর তখন থেকেই বোধহয় আমার‌ও ব‌ইয়ের প্রতি এক তীব্র আকর্ষণ তৈরী হয়ে গিয়েছিল। যদিও পাঠ্য বইয়ের প্রতি সে আকর্ষণ কখনো অনুভব করিনি। পূবের জানালার ধারে বসে আমার রাশভারী বাবা এক মনে লাল মলাটে বাঁধানো ভবানী সেনের ‘নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’ পড়ছেন এ দৃশ্য যেন স্মৃতিতে গাঁথা হয়ে রয়েছে। আর আমার আকর্ষণ ও কৌতূহল ছিল বাবার স্কুল কলেজের মার্কশীটগুলোর প্রতি। একবার কী সব দলিলের কাগজপত্র নামিয়ে মা যখন দরকারি কিছু খুঁজতে ব্যস্ত, তখন হিন্দু অ্যাকাডেমির একটা মার্কশীট দেখেছিলাম। বুঝেছিলাম তেমন নম্বর পাওয়া আমার কম্ম নয়। হ্যাঁ, ঐ বয়সে মনে হত অংক, ইংরেজি ও সংস্কৃত, এসব বিষয়ে আমার বাবার থেকে বেশি আর কেউ জানে না! তবে নিজে পড়তে ভালোবাসলে কী হবে পড়াতেন না মোটেই। সে সব ছিল মায়ের দায়িত্ব। তাই তিনি শহরের বাড়িতে এলেই সবসময় দূরে দূরে থাকতাম, পাছে জানতে চান অংকে কত পেয়েছি এই ভয়ে! অথবা হঠাৎ কাছে ডেকে যদি বলে বসেন, ইংরাজিতে ট্রানশ্লেসন কর, ‘মামা আসিবেন জানিলে আমি কখনো আজ স্কুলে যাইতাম না।’ শুধু একসঙ্গে খেতে বসে ক‌ইমাছের ডিম বা গলদা চিংড়ির মাথাটা নীরবে আমার পাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে বেজে উঠতো তাঁর বৎসলতার মিড়!
বড়দের মুখে শুনতাম তখন সময়টা আদৌ ভালো ছিল না। ভালো ছিল না আমাদের ঐ নতুন পাড়াটাও। মনে আছে ভাইবোনেরা মিলে বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে খেলতে খেলতে রায়দাদুর বাড়ির গা ঘেঁষে চেনা কাকুদের বন্দুক হাতে হামাগুড়ি দিতে দেখেছি। তাদের চোয়াল শক্ত। দৃষ্টি স্থির। স্কুল থেকে ফেরার পথে সাইকেল রিক্সা থেকে পিঠে গুলি লাগা অচেনা আরোহীকে বিটি রোডে গড়িয়ে পড়ে যেতে দেখেছি। এলাকা দখলের সশস্ত্র লড়াইয়ের পর থমথমে জনহীন পথ দিয়ে কতদিন মাথা নিচু করে দ্রুত হেঁটে একা বাড়ি ফিরেছি। সে সব সময় বাবা বাড়িতে এলে মা ভারি শঙ্কিত হয়ে উঠতেন।
প্রায় সমস্ত বরাহনগর দুর্বৃত্ত শাসিত হয়ে পড়ায় বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে যান কাস্টডাঙার বাড়িতে।
সেই প্রথম আমার কোনো গ্রাম দেখা। ন বছরের বালকের কাছে সে এক বিস্ময়। আটচালা মাটির বাড়ি। ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদলে যাওয়া আদিগন্ত চাষের জমি। জমির আল ধরে সারি সারি খেজুর গাছ। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ভোমরা বিল। ইট-সুরকির কালভার্ট ও তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একলা অশ্বত্থ গাছ। আর এই সবের মধ্যে আমার কর্মব্যস্ত বাবা, যেন আমার মনে আঁকা এক স্থায়ী জলছবি। অনাড়ম্বর এক সহজ জীবনের সঙ্গে বাবা ঐ বয়সেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। মাটির পথে, ধুলো-কাদা পাড়িয়ে চার কিলোমিটার পথ হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে গেছি। মুনিশ দাদার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে নিজেদের গাছের সজনে ফুল, বকফুল, পাটশাক জোগাড় করে মাকে এনে দিয়েছি। খেত থেকে সবজি তুলেছি। দুধ শাদা পাটকাঠির আগুনে মা সেসব রান্না করলে তাই খেয়েছি। খেয়েছি পুকুরের মাছ, পোষা মোষের দুধ। রিফু করা জামা-প্যান্টের পকেটে সাবধানে একটি টাকা নিয়ে পাগলাতলার মেলা গেছি। দেদার অনাবিল আনন্দ কিনে ফিরেছি। মাটির দাওয়ায় খেজুর পাতার চাটাই পেতে একটা হ্যারিকেন ঘিরে সন্ধ্যায় তিন ভাইবোন পড়াশুনা করেছি। আর এসব তখন করেছি বলেই আজ আর কোনোকিছুতেই যেন কষ্ট হয় না। এখন বুঝি যথেষ্ট আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকা সত্ত্বেও বাবা কেন অমন বিলাসিতাহীন জীবনে আমাদের অভ্যস্ত করে গিয়েছিলেন।
কিন্তু ওই সময়ে কাষ্টডাঙাতেও নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ছিল না। ভূস্বামী বা জোতদারদের শ্রেণীশত্রু বলে চিহ্নিত করে তাদের খতম করার যে অভিযান শুরু হয়েছিল তার ঢেউ এসে লেগেছিল এই প্রত্যন্ত গ্রামেও। যেহেতু আমার বাবার‌ও বেশ খানিকটা জমি ছিল তাই তাকেও জোতদার বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। মাঝে মাঝে অন্য কোনো গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষককে হত্যা করে তার মুণ্ডু গাছ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়ার কাহিনি ভেসে আসতো।
আমার অসমসাহসী বাবাকে অবশ্য কোনোদিন ভীত হতে দেখিনি। রাত-বিরেতে সাইকেলে অথবা রাজদুত বাইক চালিয়ে একাই দূরের গ্রাম থেকে মিটিং সেরে ফিরতেন। কিন্তু আমার মা বরাহনগরের বাড়ি ছেড়ে এখানে এসেও আতঙ্কে নিশিযাপন থেকে আর মুক্তি পাননি। ওই আটচালা মাটির বাড়িতে কোলাপসিবল গেটের নিরাপত্তা না থাকাতে মা’য়ের একমাত্র ভরসা ছিল শঙ্কটা স্তব, শঙ্কটা প্রথমং নামং, দ্বিতীয়াং বিজয়া তথা, তৃতীয়াং কামদা প্রক্তা…।
বালক বয়সে ওই দুটি বছরের গ্রামবাস আমাকে যেন শুধু নিজের বাবার‌ই নয়, নিজের দেশের‌ও এমন একটা মুখের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, যে মুখ বরাহনগরে বড় হয়ে উঠলে হয়তো সারাজীবন অপরিচিত‌ই থেকে যেত। কুয়াশা জড়ানো শীতের সকালে খেজুরের রস, সেই রস থেকে বিভিন্ন রকমের গুড় হয়ে ওঠার শিল্প, বর্ষায় পুকুর-নদীর জলে পচিয়ে কাঠি আর পাট আলাদা করা, রাস্তার ধারে ধারে শুকনো করার সময় সেই ভিজে পাটের গন্ধ, আল-পথে কেউটে-গোখরোর শঙ্খলাগা, উঠোনময় সেদ্ধ ধানের সোঁদা গন্ধ, রাতে ভাম ও শিয়ালের ডাক এ সমস্তই যেন এক বালক-কিশোরের কাছে আসলে তার বাবার ছবির অম্লান পটভূমি হয়ে রয়ে গেছে। এ জীবনে তার আর কোনো ক্ষয় নেই।
বরাহনগর একটু শান্ত হয়ে এলে, ১৯৭৩ এর মাঝামাঝি, আমাদের নিয়ে মা আবার শহরে ফিরে এসেছিলেন। আমাদের ভর্তি করা হল বরাহনগরের নামী স্কুলে। বাবা রাজদুত চালিয়ে চলে আসতেন ইচ্ছে হলেই। বাবার ব্যক্তিত্ব‌ এমন‌ই ছিল যে তিনি আমাদের শহরের বাড়িতে উপস্থিত থাকলে সেই লুম্পেন সংস্কৃতির সময়েও পাড়ার উঠতি যুবকেরা যেন সন্ত্রস্ত থাকতো। মনে আছে একবার খোকনদা দুর্গা পুজোর চাঁদা নিয়ে জবরদস্তি করাতে বাবা ঘাড় ধরে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। ক্লাবের ছেলেরা সেদিন তবু কেউ কোনো কথা বলেনি।
কিন্তু মায়ের শঙ্কটা-স্তব বাবাকে বিপদমুক্ত রাখতে পারেনি বেশীদিন। যুবক বয়সেই শহর থেকে, শখ করে বানানো বাড়ি থেকে, পরিবার থেকে স্বেচ্ছায় দূরে গিয়ে একটা আদর্শকে বুকে বেঁধে গ্রামীণ সমাজে নিজের শিকড় বিস্তৃত করেছিলেন। যে সমাজ বিনিময়ে তাকে দিয়েছিল মান্যতা ও প্রতিপত্তি, স্থানীয় যে সমাজের কূট গ্রাম্যতাকে পাল্টে দেবার কথা বাবা বলতেন, সেই সমাজের শিকড়েই বোধহয় ধরে গিয়েছিল কোনো গোপন পচন! বহিরাগত আমার বাবা যেমন সে গ্রামের অগুনতি সাধারণ কৃষকের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, তেমনি তৈরি হয়েছিল তার মুখোশধারী শত্রুও। তার সে সময়ের রাজনৈতিক জীবন ও কর্ম কাস্টডাঙা থেকে অনেক দূরে বরাহনগরের পারিবারিক নিয়ন্ত্রণে সদ্য বড় হওয়া এক উদাসীন তরুণের কাছে ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। এক অভিশপ্ত শীতের রাতে ভাড়া করা এক আততায়ী অতর্কিত আক্রমণে আমার খেতে বসা বাবার কানে পিস্তল ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দিয়েছিল। সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে মাটির দাওয়ায় পাতা আসনে বাবু হয়ে নিজের জমির চালের দুটো ভাত খেতে বসা আমার ছফুট-দুই ইঞ্চির বাবা একটি বারের জন্যও আততায়ীর কাছে প্রাণ ভিক্ষা করেননি।
তখন তার বয়স মাত্র একান্ন। আর তাঁর যে প্রথম পুত্রের জন্মের পরে জোড়া-কার্তিক পুজো দিয়েছিলেন, তার সবে উনিশ।
কল্যানীর জহরলাল নেহেরু হাসপাতালে বাবার মৃতদেহকেই শৈশবের পরে প্রথম নির্ভয়ে আলিঙ্গন করেছিলাম। অত নিবিড় করে তাকে আগে কোনোদিন স্পর্শ করিনি। জীবিত বাবাকে বড় সম্ভ্রমে, বড় ভয়ে, বড় দূরত্বে রেখেছিলাম। সে দূরত্ব যেন সেদিন রাতে একদম ঘুচে গিয়েছিল!
শুধু অনেক বছর পরে আমার বড় হয়ে ওঠার শহর বরাহনগর এবং বাল্যকালের সেই কাষ্টডাঙা গ্রাম এই দুইয়ের থেকেই প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার দূরের এক অচেনা শহর মুম্বাইয়ে বসে, নিজের শিকড় ছড়াতে ছড়াতে, কখনো ভুলতে না পারা সেই রাত্রির স্মৃতি উসকিয়ে লিখে ফেলেছিলাম একটা কবিতা। সে কবিতার শেষ কটি পংক্তি ছিল —
“… মানুষের শিকড়েও ঘুণ ধরে; গলন পচন?
নাকি লোভী আর হিংস্র কিছু পোকাদের সাথে
রসগ্রাহী শেকড়ের ঘটে যায়– আঁতাত গোপন!”
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।