‘কালপেঁচার নকসা’ বইতে ‘কলকাতার বিয়ে’ নামক একটি নকসা আছে। তাতে সেকালের বিয়ে সংক্রান্ত নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। সেই নকসাটি থেকেই কিছু কথা শোনা যাক।
১. লখিন্দরের বিয়ে:
চাঁদ বেনের পুত্র লখিন্দরের বিয়ে হয়েছিল বেহুলার সাথে। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেন। জানেন কি লখিন্দরের বিয়ে কেমন হয়েছিল? একটি ছড়ায় শোনা যাক—-
ডিম্-ডিমা-ডিম্
ডিম্-ডিমা-ডিম্
কিসের বাদ্যি বাজে?
চাঁদের বেটা লখিন্দর
বিয়ে করতে সাজে!
আগে যায় গাড়ি ঘোড়া
পিছে যায় হাতি,
সঙ্গে সঙ্গে চলে ব্যাঙ,
কাঁধে ধরে ছাতি।
২. স্টেটবাসে বিয়ে:
”সেদিন দেখলাম এক ভদ্রলোক একেবারে বরবেশে সদলবলে স্টেটবাসে চড়ে বিয়ে করতে যাচ্ছেন-ট্যাক্সি পর্যন্ত নয়, কল্পনা করুন বাসসুদ্ধু প্যাসেঞ্জার উলুধ্বনি দিচ্ছে, তাতেও ভদ্রলোকের হুঁশ নেই, তিনি দিব্যি হাসছেন এবং বলছেন- ‘যতই উলু দাও, আর শাঁক বাজাও বাবা, ছ-পয়সায় যায় হয় তার জন্যে ছ-টাকা খরচ করতে রাজি নই। বিয়ে তো আজ হলেই কাল পুরনো হয়ে যাবে, তখন এই টাকা কটা অনেক কাজে লাগবে মশাই।”
ঘটনাটি উল্লেখ করে কালপেঁচার সরস মন্তব্য- ”ভদ্রলোক ‘ম্যাস্-লীডার হবার উপযুক্ত, এমন নির্ভীক ম্যাসমাইণ্ডেড্ লোক কদাচিৎ আমার নজরে পড়েছে।”
কালপেঁচার ‘কলকাতার বিয়ে’ নকসা থেকে সেকালের আরও কয়েকটি বিয়ের কথা শোনাই–
৩. ” যে বন্ধুর বিয়ের কথা বলছি সে রীতিমত অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে। একদিন ভর দুপুরবেলা, স্টেট ডবলডেকারে করে যাচ্ছে এমন সময় দ্যাখে, তার সামনের সীটে তার প্রেমিকাটি বসে আছে চুপ করে। পিছন থেকে বিনুনি ধরে টান দিয়ে সে জিগ্যেস করল ‘ কোথায় যাচ্ছ?’ মেয়েটি বললেঃ ‘ ইউনিভার্সিটিতে -ক্লাশ আছে।’ বন্ধুটি বললেঃ ‘ ভাবছিলাম কি, তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলব বিয়ের ব্যাপারটা মিথ্যে পোস্টপোন্ করে রেখে লাভ কি? ওটা সেরে ফেললে হয় না? কোথা থেকে আবার কি হয়ে যায় কবে- লাইফ্ ইজ্ আফটার অল–।’ মেয়েটি বললঃ ‘ আশ্চর্য, আমিও ঠিক তাই ভাবছিলাম।’ তাহলে ‘নেমে পড়ো’ বলে দুজনেই ওয়েলিঙটন্ স্কোয়ারের কাছে নেমে পড়ল। জানাশুনো চমৎকার ভদ্রলোক রেজিস্ট্রার, ব্যাপারটা সেরে নিতে যথেষ্ট সাহায্য করলেন। খরচ হল দু-জনের কাছে যা ছিল তাই, অর্থাৎ ৬_+ ৪_= ১০_ টাকা। রাত দশটার সময় নববিবাহিত বধূকে নিয়ে বাড়ি ফিরে, বাবা মাকে প্রণাম করে, বন্ধুটি জানিয়ে দিলে যে, সে আজই বিয়েটা সেরে ফেলেছে। বাবা মা অদ্ভুত উদার চরিত্রের মানুষ, তাঁরা বললেনঃ ‘ বেশ করেছ, এখন দু-জনে খেয়েদেয়ে ঘুমোও গে যাও, অনেক রাত হয়েছে।”
এবার সেকালের বাবুদের বিয়ের দু-একটা নমুনা শোনাই।
৪. এ হল কলকাতার বিখ্যাততম বাবু ছাতুবাবু আর লাটুবাবুর বিয়ের কাহিনী। ছাতুবাবু অর্থাৎ সতুবাবু, যাঁর আসল নাম হল আশুতোষ দে। আর লাটুবাবু হলেন তাঁর ছোটভাই প্রমথনাথ দে। এঁরা দুইভাই বাবুয়ানিতে সেযুগে সবাইকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে গেছেন। রূপচাঁদ পক্ষীর গানের ভাষায়–‘বাবুর বাবু সেরা বাবু / বাবুয়ানির জুড়ি নাই।’ এই ছাতুবাবু লাটুবাবুর বৈঠকখানার এমনই নামডাক ছিল যে ছেলেরা ছড়া কাটতো–
ছাতুবাবুর বৈঠকখানা-
আজ বলেছে যেতে
পানসুপারি খেতে—।
এই দুই বাবুর বিয়ে একসাথে হয়েছিলো, এবং রীতিমতো ইশতেহার ছাপিয়ে। শুনুন সে কাহিনী।–
‘ রামদুলাল দে সরকার কলকাতার একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ী ও ধনী লোক ছিলেন। তাঁর নামে আজও কলকাতার একটি রাস্তা আছে, সকলেই জানেন। কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে তিনি তাঁর দুই পুত্রের বিবাহ দিয়েছিলেন। বিবাহের আগে তিনি রীতিমত ‘ইশতেহার’ ছেপে দিয়েছিলেন। কোথায় জানেন? কোন খবরের কাগজে নয়, একেবারে ‘গবর্নমেন্ট গেজেটে’। ইশতেহার এই মর্মে ছাপা হয়ঃ ‘ শ্রীযুক্ত বাবু রামদুলাল দে সরকার ৭ ও ১১ ফাল্গুন (১২২৬ সন) তারিখে দুই পুত্রের বিবাহ দিবেন- তাহাতে ইংলন্ডীয় সাহেবদের কারণ ১/২ ফাল্গুন এই দুই দিন নিরূপণ করিয়াছেন যে তাঁহারা ঐ দুই দিনে তাঁহার শিমলের বাটীতে গিয়া নাচ প্রভৃতি দেখেন ও খানা করেন। এবং আরব ও মোগল ও হিন্দু লোকেরদের কারণ ১৩/১৪/১৫/১৬ তারিখ নিরূপিত হইয়াছে তাঁহারাও উপযুক্ত মতো আমোদ প্রমোদ ও খানা করিবেন।’ গেজেটে নোটিশ দিয়ে ছেলের বিয়ের নেমতন্ন করা, ইংরেজ, মুসলমান ও হিন্দু নিমন্ত্রিতদের জন্য বিশেষ দিন ধার্য করা, বিলেতী আরবী মোগলাই ও হিন্দু খানা এবং নাচগানের ব্যবস্থা করার কথা আজকালকার ধনীরা নিশ্চয় কল্পনাও করতে পারেন না। গেজেটে নোটিশ দিয়ে নিমন্ত্রণ মানে ঢালাই নিমন্ত্রণ, সুতরাং খরচের বহরটাও অনুমানসাপেক্ষ।”
পাঠক আপনি বিস্ফারিত নেত্রে, কালপেঁচার সাথে খরচের হিসাব করতে থাকুন। সেই খরচ আজকের দিনের টাকায় কত, সেই হিসেবটা করতে ভুলবেন না যেন।