২০০৪ থেকে ২০০৬ এই দুই/তিন বছর কোনো বিশেষ কারণে সাহিত্য থেকে একটু দূরে ছিলাম । আধ্যাত্মিক পড়াশুনো ,ধ্যান এসবে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল । নিয়মিত পড়ছিলাম ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা । আমি বহু বছর উদ্বোধনের গ্রাহক ছিলাম ।তখন খুব ইচ্ছে করত উদ্বোধনে লিখতে । লেখা পাঠাতাম । কখনোই ছাপা হত না । অবিশ্যি অনেক পরে একবার মেলে একটা কবিতা পাঠিয়েছিলাম । ছাপা হয়েছিল । ওরা জানায়নি ও পত্রিকাও পাঠায়নি । অন্য এক কবি ফোনে জানালে পর আমি সংখ্যাটি শিয়ালদা থেকে কিনেছিলাম । ওই একবার-ই । আনন্দ হয়েছিল । তবে লেখাটি বিনা অনুমতিতে এডিট করে ছেপেছিল কয়েক পংক্তি বাদ দিয়ে । বিষয়টা মোটেও ভালো লাগেনি আমার ।
সে সময় স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর অনেকগুলো বই পড়েছিলাম । যেমন ,ভারতীয়দের আধ্যাত্ম জীবন ,মানবীয় উৎকর্ষ ,ভগবান বুদ্ধ এবং আমাদের ঐতিহ্য ,ভারতীয় সংস্কৃতি ,ভারতীয় দৃষ্টিতে ঈশ্বরের মাতৃরূপ ,ধর্ম-দর্শন:তত্ত্বে ও জীবনে ,নতুন ভারত গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা এমন আরো কিছু বই ।
তবে নতুন ভারত গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা আমার জীবনে প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিল । আজো মাঝে মাঝে পড়ি ,পড়তে হয় । অনেক বন্ধুকে এই বইটা উপহার দিয়েছি ।যাঁরা শিক্ষক তাঁদের অবশ্যই পড়া উচিৎ আত্ম -উন্নতি আর চরিত্র গঠনের জন্য ।
তিনি লিখেছেন ,”সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে উঠতে গেলে দুটি জিনিসের কোনো বিকল্প নেই–এক ,জ্ঞানের জন্য তীব্র অনুরাগ আর দুই ,রাষ্ট্রের সেবার জন্য আকাঙ্ক্ষা ।শুধু সেবার মনোভাবই যথেষ্ট নয় ,জ্ঞানের জন্য প্রগাঢ় ভালোবাসার মনোভাব অত্যাবশ্যক ।যে শিক্ষকের নিজেরই জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা নেই , তিনি তাঁর শিক্ষার্থীদের কীভাবে জ্ঞানের জন্য উদ্বুদ্ধ করবেন ?”
আমার সাহিত্যচর্চার কথা এলে অবগুন্ঠনের কথা চলে আসবে । ‘৯৬ থেকে সম্পাদনা করে আসছি । বহু কবি , বহু কবিতার ইতিহাস । যে কাজটা করতে চেয়েছি তা অনালোচিত কবি-লেখকদের পাঠকের সামনে আনা । তরুণদের কবিতা ছাপানো । কী পেরেছি ,কতটা পেরেছি তা সময় বলবে ।
লিটিল ম্যাগাজিনের লিটিল চরিত্রটা রাখতে চেয়েছি । কখনোই ইটের মতো মোটা পত্রিকা করায় আস্থা ছিল না , আজো নেই । অবগুণ্ঠন এক-দু ফর্মাতেই আগুন জ্বালাতে সক্ষম ।
‘৯৯ তে কবিতা আলোচনা সংখ্যা ।জীবনানন্দ থেকে আবীর সিংহ প্রত্যেক দশকের একজন কবির কবিতা ধরে ধরে আলোচনা । সে সময় এই রকম কাজ করেছিল কবিতা পাক্ষিক । যা থেকে অনুপ্রেরণা পাওয়া । ২০০৬এ ‘স্বপ্ন সংখ্যা ।’ সুব্রত রুদ্র ,নারায়ণ মুখোপাধ্যায় ,সুরঞ্জন প্রামাণিক ,তপন ভট্টাচার্যের মত কবি-লেখকরা লিখেছিলেন । ছাপা হয়েছে কালীকুমার চক্রবর্তী ,ঋতুপর্ণ বিশ্বাস ,দীপক রায় ,জহর সেনগুপ্ত ,বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায় , সুব্রত বসুর প্রথম সাক্ষাৎকার । সেজন্য আজ সত্যি গর্ব হয় ।সুভাষ মুখোপাধ্যায় ,প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ,যামিনী রায় ,নির্মলকুমারী মহালানবিশের অপ্রকাশিত চিঠি । বিনয় মজুমদারের অপ্রকাশিত কবিতা । মঞ্জুষ দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে একালের সঞ্জয় ঋষি , প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথের কবিতা ছাপা হয়েছে । অবগুণ্ঠনে প্রকাশিত প্রিয়াঞ্জলির এই কবিতাটি আমার বড় প্রিয় ।
এসো প্রেম / প্রিয়াঞ্জলি দেবনাথ
——————————————–
” এসো প্রেম
পথ হয়ে দাঁড়াও
লিখুক আমার কলম
বিষাদের নীল রঙ
গাছ হবো
পাখি হবো
শিকড়ে গজাব ফুল,
মাটি হয়ে লিখে যাব
নিরাকার আদিমূল
তবু প্রেম দিয়ে যাও
প্রেমহীন অভিসার …
আলো হাওয়া মেঠোজল
ভেসে যাক অভিমান
আসুক হলুদপাতা
বিষাদের সাতরঙ । “
অবগুণ্ঠন কেবল কবিতায় সীমায়িত থাকেনি । অনুবাদ ,প্রবন্ধ ,ছোটগল্প ,অণুগল্প ,পত্রিকা ও গ্রন্থ আলোচনাও করছে । ‘রামমোহনের সংগীত স্বরূপ ‘ নিয়ে ধারাবাহিক লিখেছেন অরবিন্দ দাস । গত কয়েক সংখ্যা ধরে নিয়মিত চর্চা হচ্ছে অণুগল্পের । ২০১৯ এর শারদ সংখ্যাটি ছিল বিশেষ অণুগল্প সংখ্যা । যা দারুণ ভাবে পাঠক সমাজে আদৃত । ফেসবুকে অবগুণ্ঠন অণুগল্প চর্চার গ্রুপে নিত্য-নতুন গল্প লেখা হচ্ছে । নানা ইভেন্ট চলছে । এমনি বারোয়ারি উপন্যাস লেখা চলছে হৈ হৈ করে লেখার আনন্দে , পাঠের উন্মাদনায় । ২০১২ তে রবীন্দ্রসংখ্যাটি ছিল অভিনব । আমার ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ–এ বিষয়ে লিখেছেন বিপ্লব চন্দ ,দীপক রায় ,ঋতুপর্ণ বিশ্বাসের মত লেখকরা । এটাই প্রাপ্তি ,এটাই আনন্দ । লিখেছেন কালীকৃষ্ণ গুহ । তাঁর কবিতা নিয়ে চমত্কার আলোচনা পেয়েছি দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছ থেকে । হিমুকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমি একটি সংখ্যায় । লিটল ম্যাগাজিন ও তার সমস্যা নিয়ে উৎপল মন্ডলের গদ্যটি অসাধারণ ।লিখেছেন সংযম পাল ,কবি গৌতম বসুর ‘রসাতল’ নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ ।বিজয় সিংহ এবং আবীর সিংহ একটা সময় নিয়মিত লিখতেন । জহর সেনগুপ্তের বিনয়দার কবিতার আলোচনা আছো মনে আছে । তপন ভট্টাচার্য ও সৌরভ চট্টোপাধ্যায় অনেকগুলি গদ্য লিখেছেন ।শঙ্খ ঘোষের পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ –নিয়ে সেই সময়ের প্রগলভ আবেগে লিগেছিলাম এক গদ্য । পেয়েছিলাম সাত্যকি হালদারের গল্প । সুনীল দাসের আলোচনা । অরুণ ,ঋপন ,সঞ্জয় ,অন্তরা,গৌরাঙ্গ দাস এদের কবিতা । পেয়েছি তাপস রায় ,তপোমন ঘোষ , বাপ্পাদিত্য রায় বিশ্বাসের অনুবাদ । সম্প্রতি সন্মাত্রানন্দ , গৌর বৈরাগী, বিনোদ ঘোষাল , তৃষ্ণা বসাক , নলিনী বেরা থেকে শুরু করে যুগান্তর মিত্র , শ্যামলী আচার্য , রাজীবকুমার ঘোষ , কৃষ্ণেন্দু পালিত প্রমুখ লিখেছেন অবগুণ্ঠনের পাতায় নানা সংখ্যায় । আমরা ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছি । সম্প্রতি অবগুণ্ঠন থেকে বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে । অবগুণ্ঠন গল্পকার সুধাংশু চক্রবর্তীর ” সাঁঝতারা” বইটি একটি পুরস্কারও পেয়েছে । এও অবগুণ্ঠনের মুকুটে একটি পালক । অবগুণ্ঠনের সম্পাদক হিসেবে কাজের স্বীকৃতি দিয়েছে “চাতক ” পত্রিকা । তারা ‘ টেগোর ভিলেজ সাহিত্য পুরস্কার -২০১৯ দিয়েছে সম্পাদক অমিতাভ দাসকে । এসব তো কাজের মাঝে প্রাপ্তি । চলার পথে আরেকটু হেঁটে যাওয়ার তৃষ্ণার জল ।
সবটাই স্মৃতি থেকে লেখা । দুইবার বাড়ি বদলের কারণে অনেক চিঠি , বই ,পত্রিকা নষ্ট হয়েছে । হারিয়ে গেছে । যাই হোক ,স্মৃতি এখনো তেমন প্রতারণা করছে না ।নয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের হাবড়া থেকে অনেক লিটল ম্যাগ প্রকাশিত হয়ে আসছে । যেগুলোতে আমি লিখেছি । যারা আমাকে একটু জমি দিয়েছে লেখার ।লাবু ঘোষের ‘সাহিত্য অববাহিকা’ সৌরভের ‘কবিজন্ম ‘ছাড়াও প্রকাশিত হত চিত্তরঞ্জন সরকারের ‘উত্তর ২৪ পরগনা বার্তা’,তাপস রায়ের ‘ত্বষ্টা ।’ মাটির কাছাকাছি করতেন তপন অঞ্জয় ,আপাতত বন্ধ । ভালো কাগজ ছিল । গোপাল মল্লিকের ‘কবিকল্প ।’সুন্দর কবিতার কাগজ ।
এখন প্রকাশিত হয় সঞ্জয় ঋষি সম্পাদিত’সুতরাং’ ও’ধ্রুবতারা ।’ অণুকবিতা নিয়ে চমত্কার কাজ করছে ধ্রুবতারা ।প্রচুর নতুন ছেলেমেয়েরা লিখছে । গৌরাঙ্গ দাসের ‘ক্র্যাকার’–দারুণ কাজ করছে ।সত্যগুহ ,সুরঞ্জন প্রমাণিক ,বিপ্লব চন্দকে নিয়ে অসাধারণ সংখ্যা করেছে । মনে পড়ে গেল সাগর সেনের কথা । ও ‘ভালোবাসা ‘বলে নয়ের দশকের শেষ দিকে একটা ফোল্ডার কাগজ করতো ।
আবার মনে পড়ছে সৃজনের কথাও–বিষ্ণু ও দীপংকর দুই সরকার ভ্রাতার সম্পাদনায় প্রকাশিত হত ।মাঝে অবিশ্যি বন্ধ ছিল । আবার প্রকাশিত হচ্ছে , এইটে আশার কথা । ঋপন আর্য করতো ‘চর্যাপদের পরে ।’ এই নামকরণটা আমার করা । দু-তিনটি সংখ্যার পর আর বেরোয়নি ।ভালো হয়েছিল কাগজটা । বিশ্বজিৎ ঘোষ,আমার সাংবাদিক বন্ধু , চমৎকার একটা কাগজ করেছিল ‘শেষ রাতের আকাশ ।’ একটি মাত্র সংখ্যা । কেন আর করল না জানি না ।এটাই হয়তো ছোট কাগজের নিয়তি । কিন্তু সবকটি কাগজ ছিল সত্যিকারের লিটিল ম্যাগাজিন । আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় পূর্ণ । আর ‘ পাথেয় ‘ পত্রিকার কথা আগেই তো লিখেছি । এই সব ছোট কাগজগুলোর কাছে আমি ঋণী । কত কিছু পড়েছি ,জেনেছি , শিখেছি—নিজেকে তৈরি করেছি । একজন লেখক, পাঠকের কাছে এ যে অনেকটাই পাওয়া ।