ইউএসের একটা ব্যাপার আমার দিব্য লাগে। অনেক শহরেই পার্কিং নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় না তেমন। অন্ততঃ শহরতলীতে তো নয়ই। সব দোকানের সামনেই দোকানের দেড়া সাইজ পার্কিং লট। দিব্যি গিয়ে নিজের পছন্দমত গাড়ি পার্ক করে দোকানে ঢুকে পড়লেই হল।
এক উইকেন্ডে আমি নেটফ্লিক্সে বোর, ফেসবুকে বোর, নস্টালজিয়ায় বোর।
শেষে দুক্কুরবেলায় কী করি কী খাই কী দেখি কী ভাবি করতে করতে বেরিয়েছি।
একখানা তেপান্তর পার্কিং লটে গিয়ে গাড়ি পার্ক করে নামতেই মুখোমুখি এক দম্পতি। দেখেই বোঝা যায় আইটিওয়ালার মা-বাবা। আমোদের ছোটবেলায় ফেরিওয়ালারা যেমন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত বড়বেলায় তেমনি আইটিওয়ালারা দেশে দেশে ঘোরে । তার মধ্যে সিংহভাগই দক্ষিনী। এই দম্পতিরও কপালে চন্দন তিলক এবং বাকি পোশাক দেখেই বোঝা গেল পূবের দেশের দক্ষিণপ্রান্তে বাস।
ভদ্রমহিলা একটু পিছিয়ে ছিলেন। ভদ্রলোকই এগিয়ে এলেন হাসিমুখে
তুমি কি এখানেই থাক?
হ্যাঁ, মাঝে সাঝে থাকি … আমি পালটা হাসি
আচ্ছা। বাজার করতে এসেছ?
হুঁ… কাইন্ড অফ… … এর পর আর কি বলব বুঝে পাই না।
খুব তাড়া আছে তোমার?
না না, কেন বলুন তো? কিছু বলবেন?
ভদ্রমহিলা এবার এগিয়ে এলেন… ভাঙ্গা ইংরাজিতে বললেন “আমাদের বাড়িতে কফি ফুরিয়ে গেছে। ছেলে গেছে ডেট্রয়েটে। আমরা এই ছোট্ট মলটুকুই চিনি। এই পিছনেই থাকি’ … হাত দিয়ে একটুঁ দূরের সারি সারি সাজানো কাষ্ঠকুটির দেখালেন।
ও হরি। কফির খোঁজে বেরিয়েছেন এঁরা ! এখানে তো কলকাতার মত যত্র যত্র সিসিডি নেই। তবে স্টারবাক্স তো আছে! জিজ্ঞেস করি ‘কফি খাবেন? কফি খেতে ইচ্ছে করছে? ‘
ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন, না না, কফি তো কিনেছি।
তাহলে? বাড়ি অব্ধি রাইড চাইছেন?
মহিলা স্পষ্টই বিব্রত … না না, আমরা হেঁটেই যেতে পারব, কাছেই তো।
তাহলে? অন্য কোন সমস্যা?
ও নো নো… নো প্রবলেম।
দেন? আর কিছু বলবেন?
মহিলা হেসে বললেন, তোমার নাম কি?
নাম শোনা হল তো ঠিকানা। কোথায় থাক?
কলকাতা
ওহ , উই নো! কলকাথা!
নো নো, ক্যালকাটা
ইজন্ট ইট কলকাথা!
ইয়া,ইটস কলড কলকাতা নাও
ইয়েস কলকাথা
আমি আর কথা বাড়াই না। দক্ষিনীদের দিয়ে ‘ত’ কেই বা কবে বলাতে পেরেছে…
ভদ্রমহিলা আর একটু হেসে ভেঙ্গে ভেঙ্গে বললেন, “উই নিড লিটল হেল্প।”
“কী হেল্প? বলুন, পারলে নিশ্চই করব”
“মাই সান ইজ ডেটিং , আমেরিকান… ”
“বাহ। ভাল তো … আরন্ট ইউ হ্যাপি?”
“নো নো, হ্যাপি… আ লট।”
“তবে?”
“আমার ছেলে মেয়েটির সঙ্গে আমাদের দেখা করাতে চায়। তুমি কি বলতে পারবে ওর জন্য আমাদের কি গিফট কেনা উচিত?”
আহা, এমন আনন্দ এ বিভুঁইয়ে! শপিং সাজেশন দিতে হবে ! “পার্স দিতে পারেন, কিম্বা একটা সুন্দর পেন্ডেন্ট, অথবা পারফিউম কিংবা ইয়ারিং, জুয়েলারি বক্সও দারুন হয়… ” আমি আপনবেগে পাগলপারা
ভদ্রমহিলা থামিয়ে দিলেন “কী রকম দাম পড়বে”?
“আপনাদের বাজেট কেমন?”
বাজেট? কর্তা গিন্নি ডট ম্যাট্রিক্স প্রিন্টারের স্পিডে কিছুক্ষন নিজেদের ভাষায় কথা ডিসাইড করলেন খুব বেশি দামের দেওয়া উচিত না … “মানে, আমরা তো ঠিক জানিনা কতদিন থাকবে এই সম্পর্ক তাই বেশি দামী দেওয়া ঠিক হবে কিনা… “খুবই যুক্তিযুক্ত কথা ।
ভাবলাম বলি একজোড়া জুতো দিয়ে দিন সুন্দর দেখে। সম্পর্ক টিকলে ভাল না টিকলেও জুতো সেক্ষেত্রে পারফেক্ট। তবে সেটা বোধহয় এঁদের মনে ধরবে না ।
“পার্স বা জুয়েলারি বক্স খুব সুইট গিফট, কম বাজেটেও পাবেন ওসব”
‘ওয়েল, তোমার কি মনে হয় কিরকম দামের মধ্যে দেওয়া উচিত’
‘আহা রে দক্ষিণদেশি ভাইটি, তোর প্রেমের এক্সপায়ারি ডেটখান দিদিকে জানিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না ! এখন এই বিপদে কেমন করে এনাদের উদ্ধার করে! ‘
একটু ভেবে নিয়ে মুখ খুলি …’আমার আসলে প্রেমিকাকে গিফট দেওয়ার কোন আইডিয়া নেই কিনা… আপনারা ছেলেকেই একটু জিজ্ঞেস করে নিন না বরং। সে বলতেও পারবে বান্ধবীর পছন্দ কী ধরনের জিনিস… অবশ্য আপনারা মাঝারি দামের মধ্যে একটা ভালো ফুলের তোড়াও দিতে পারেন… ”
“নো নো। নো ফ্লাওয়ার উই ডিড দ্যাট। আগের তিন বার আমরা কার্ণেশন আর লিলির খুব ভালো বোকে দিয়েছিলাম। বাট নান লাস্টেড।”
“ন্যাচারালি! ন্যাচারাল ফ্লাওয়ার লাস্ট করবে না তো জানাই কথা! আর্টিফিশিয়াল ফুল বা গাছ দিতে হত তাহলে”
“ওহ, নো! রিলেশনশিপ লাস্ট করেনি …ইউ নো, মাই সান, হি ওয়ান্টস বেটার গার্ল অলওয়েজ …”
কাঠফাটা রোদ্দুরে চাঁদিটি তন্দুরি তালু হয়ে উঠছে বুঝেও আমি কৌতূহল সামলাতে পারি না।
“থ্রি টাইমস? বার বার আগের জনের থেকে বেটার কাউকে পেয়ে ব্রেকআপ হয়ে যায়!”
“ইয়েস। বালাজী নোজ হোয়াট উইল হ্যাপেন। হি ইজ ভেরি হ্যান্ডসাম এন্ড ব্রিলিয়ান্ট। বাট ইউ নো! গার্লস দিজ ডেজ! (আন্টি আমার বুকের কাছে ঘেঁষে এসে ফিসফিস করে বলেন) দে ওয়ান্ট হিম টু ডু এভরিতিং বিফোর ম্যারেজ । এভ্রিইতিং । (বোঝ! এখন থ-এর জায়গায় ত!)
“হি টোল্ড ইউ দ্যাট ?” (আমার মুখখানা কেমন শোভা দে-র মত দেখাচ্ছে না সামনের গাড়ির কাঁচটায়!)
“নো নো, নট মি! টু হিজ নিস। মাই গ্র্যান্ড ডটার। শি ইজ ইন দ্যা ভিলেজ না!! উই থট দে উইল বি অ্যা গুড ম্যাচ। শি ইজ সাচ্চচ্চচ আ গুড গার্ল। লার্ণড কর্ণাটিক মিউজিক, মেকস এক্সেলেন্ট ফুড… কিন্তু আমার ছেলে ! সে তো ফরসা মেয়ে চায়! আমরা সেই মেয়েকেও অনেক জুয়েলারি দিয়েছি মাঝে মাঝে। বাট সে নিয়ে আমার দুঃখ নেই। সে তো আমারও নাতনী…”
আমি তালে গোলে এক্কেবারে ভুলেই যাই যে কী নিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। ভদ্রলোক স্ত্রীকে দুর্গ সামলাতে দিয়ে একটু ঘুরে ঘুরে গাড়ি দেখছিলেন…
পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে আবার সেই ডট প্রিন্টার চালিয়ে কিছু বললেন ঘড়ি দেখতে দেখতে।
ভদ্রমহিলা কাঁচুমাচু মুখে আমার দিকে ফিরলেন “আমরা বরং ছেলের ওপরেই গিফট দেওয়াটা ছেড়ে দিই, বল!”
“একদম! বরং টাকাটা থাক। ওটা ফাইন্যাল ব্রাইডের জন্য ইউজ করাই ভালো” বলতে বলতে দোকানের দিকে হাঁটা লাগালাম আমি ।
সেদিন গেল, পরদিন গেল, সে মাস গেল, সে বছর গেল… আমার এখনও মনে পড়ে সেই প্রৌঢ় মা বাবাকে, মনে পড়ে ভদ্রমহিলার সুর টেনে বলা ভাঙা ইংরিজিতে “এভ্রিইতিং”।
আর মনে ভাসে একটি মেয়ে, নারকোলতেল ছোপানো কালো একঢাল চুলের শ্যামলা এক মেয়ে। তার মোটা বেণীর গোড়ায় সাদা ফুলের মালা বা লাল একখান পঞ্চমুখী জবার সাজ। কর্ণাটকি সংগীতের রেওয়াজের ফাঁকে তার মামার ফোন এলে সে গান বন্ধ করে। সাদা রঙের মেয়েদের সঙ্গে তার মামার কী কথা হয় সে জানতে না চাইলেও হয়ত তাকে শুনতে হয়। তার মামাটি তাকে বিয়ে না করে যাদের বিয়ে করতে চায় তাদেরকেও ঠিকঠাক পছন্দ করে উঠতে পারে না কেন, কোনো না কোনো বাহানায় তাদের বাতিল করে আবার কেনই বা ফিরে আসে ভাগ্নীর কাছে নিজের জীবনের গল্প করতে কে জানে! মেয়েটি কি মামাকে ভালোবেসেছিল কখনও? আজও কি সে অপেক্ষা করে তার মামা ‘এভরিতিং’ সেরে তার কাছে ফিরে আসবে আবার?
এমনও তো হতে পারে যে সেই এক্সেলেন্ট ফুড রাঁধিয়ে মেয়েটিও আর কাউকে চেয়েছিল মনে! গ্রামের কোন ঘামতেলে নেয়ে ওঠা ছেলে যে জবাফুলের ঘেরের মুখটিকেই বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমোয়!
আবার এমনও তো হতে পারে যে অমন কেউই নেই। সে মেয়ে আজও আছে ছোট্টবেলা থেকে শোনা এক সম্পর্কের অপেক্ষায়!
এক তারিখভোলা দুপুরে শোনা এক অস্থিরমতি বিবাহযোগ্য যুবকের গল্প আমাকে কোন এক নাম না জানা গ্রামের অনামিকা এক কালো মেয়ের ভাবনায় ডুবিয়ে রাখে আজও… আমিও তাকে কখনো ভুলতে চাই না…