• Uncategorized
  • 0

পথপাথালি – সঙ্গীতা দাশগুপ্ত

পেশা - সফট স্কিল ট্রেনার শখ - স্বপ্ন পূরণ শক্তি - ভালবাসা দুর্বলতা - ভালবাসা
মাঝরাতে গভীর ঘুমের ঘোরে মনে হয় কেউ কাঁদছে…নাঃ কঁকিয়ে উঠছে কি? কেমন ছটফট শব্দ…খাটের গায়ে ধাক্কা লাগছে যেন… হোটেলের ঘরটায় দুটো বেড। একটায় নিজে হাত পা ছড়িয়ে ঘুম মধ্যে অন্যটায় দেশের ফোন, বিদেশের ফোন, ল্যাপি সব্বাই শুয়েশুয়ে চার্জ খাচ্ছে…
আবছা অন্ধকারে চোখ খুলতে গিয়ে একটু ভয় লাগে। আওয়াজটা পাশের খাট থেকেই আসছে না! কিন্তু ঘরে তো আমি একাই! চশমা সাইড টেবলে… অন্ধকারে চোখ সইয়ে টেবল ল্যাম্পটা জ্বালতে গিয়ে খেয়াল হয়, হ্যাঁ, কঁকিয়েই উঠছে কেউ তবে কান্নায় না। সুখে… তুমুল আদরের শীৎকার আর বেচারা খাটের আর্তনাদ পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছে। মেয়েটির সুখের তীব্রতার সঙ্গে পুরুষ কন্ঠের তুমুল মুর্ছনা মিলে মিশে জাগিয়ে দেয় আমায় । ঘড়িতে রাত দুটো। অন্ধকারে আদিম এক সুখানুভূতির সাক্ষী হয়ে বসে থাকতে থাকতে ভাবি ঘুম কি আজকের মত শেষ তবে? নাঃ, একবার চেষ্টা করতে ক্ষতি কি… লেপটায় কান মাথা ঢেকে ঘুমকে শিকে থেকে টেনে নামানোর চেষ্টা চলে।
কিছুক্ষন যুদ্ধের পর হার মানতে হয়। পড়শির তীব্র আশ্লেষের ঢেউ সত্যিই ঘুম উড়িয়ে নিয়ে যায়। গরম জলে একটা আর্ল গ্রের ব্যাগ ফেলে জানলার পর্দা টেনে দাঁড়াই। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। ওই অন্ধকারের মধ্যে সারি সারি বরফ ঢাকা গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভোরের আলোয় নিষিক্ত হবে বলে।
জীবনে আস্বাদিত ও অনাস্বাদিত প্রতিটি মিলন সম্ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ওই মুহুর্তে। ঘরে রাখা সুগন্ধি মোমবাতিটা জ্বেলে দিই। কার্পেটের ওপর নিঃশব্দে হাঁটি । অন্ধকার কোনে কলকাতার বাড়ি, ঠাকুর ঘর স্পষ্ট হয়ে ওঠে ..
এই শাড়ির ফালিটা যত্ন করে রেখো … শঙ্খ লাগা কাপড় … সংসারের ভাল হবে… দিদু বলছিলেন মা-কে ..
শঙ্খ যেখানে লাগে সেখানে ধূপ ধুনো দিতে হয় .মনসা দেবীর শাপ লাগে না তবে…
কিন্তু পোদ্দার মামাদের অতবড় তিনতিন খানা ধান ভরা মড়াই একরাতে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল যে! ওদের বাস্তুপূজোর আশীব্বাদ, শঙ্খ লাগার কপাল কিচ্ছু তো আগুনকে বাঁচালো না!
বাংলা মাধ্যমের জীবন বিজ্ঞানের পরাগ মিলন শেখার পর জুঁই বলেছিল “এর পর মিলনদার দোকানে কিছু কিনতে গেলেই এটা মনে পড়বে তো রে!”
‘একটা হুইস্পার দিন তো’ শচী মেডিক্যালে এটা হুইস্পার করে বলতে হত বলেই ফিস্ফিসের ইংরাজী হুইস্পার এটা ভুলতাম না কখনও.. অ্যাসপিরিন আর হুইস্পার দুটোই একভাবে বলা যায় এও তো জানা ছিল না সেদিন। জেঠু একদিন বলল বড় মাথা ধরেছে। বাড়িতে অ্যাস্পিরিন আছে নাকি তোদের, সেদিন প্রথম শুনেছিলাম নামটা তারপর বেশকিছুদিন অ্যাস্পিরিন আর হুইস্পারিং এই দুটো কথা মাথায় পাশাপাশি বসত করত।
তারপর বড় হতে হতে জানলাম ওষুধের দোকানের লোকজন অ্যাস্পিরিন চাই বললে তাড়াতাড়ি পাত্তা দেয় না কিন্তু হুইস্পার চাই বললেই তীব্র ক্ষিপ্রতায় খবরের কাগজ কালো প্যাকেট সব যোগাড় করে জিনিসটা হাতে ধরিয়ে দোকান থেকে বার করে দিয়ে হাঁফ ছাড়ে।
মাঝরাত কত কী যে মনে পড়ায় ! বুল ছিল আমাদের পাড়ার পাহারাদার। খুব সুন্দর ছিল বুল, রাজকীয় ছিল তার চলন। সন্দেহজনক কাউকে দেখলেই গলার ভেতর থেকে একটা আওয়াজ তুলত গরর্‌র্‌র্‌ করে। লোকে সজাগ হত কিন্তু নিশ্চিন্ত হয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ত আবার। বুল আছে যে। বুল ছিল মনোগ্যামাস। বুলি ছাড়া আর কোনো ছেলেপুলের মা তৈরি করেনি সে আমাদের পাড়ায়। বুলি যখন পাড়ার কোনো বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষে নতুন ছানাপোনাদের নিয়ে শুয়ে থাকত তখন বুল সবার বাড়ি থেকে রুটি পাঁউরুটি মুখে করে এনে সামনে রেখে দিত বুলির। তারপর ওর খাওয়া শেষ হলে নিজে গিয়ে বাকিটা খেয়ে আসত। সেই বুল…কোন একটা গাড়ি কবে যেন চলে যায় ওর ওপর দিয়ে। পাড়ার ছেলেরা গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়েছিল শুনেছিলাম। মাঝরাতে আমি মাথার মধ্যে তন্নতন্ন হাতড়াই বুল চলে যাওয়ার পরে বুলি কেমন ছিল সেটা মনে করতে। মনে পড়ে না আমার … বুলি তবে এতই অকিঞ্চিৎকর ছিল? কিন্তু সেও তো বুলের পাশে রাত জাগত! বুলের সঙ্গিনী ছাড়া কি কিছুই ছিল না সে? নিজেকে বুলির কাছে অপরাধী লাগতে থাকে।
… বাইরে বৃষ্টি ঝরছে । বড্ড অন্ধকার চারদিক…আলতো ঠোঁট রাখি কাপের গায়ে যাতে চুমুকের শব্দে যেন আঁধারের ঘোর না ভাঙ্গে।তবু ঘোর ভাঙ্গে আঁধারের। গোপনীয়তার আবরণ ছিঁড়ে অচেনা দুই মানুষ মানুষীর বারংবার সুখশীৎকার শুনতে শুনতে আমি টের পাই শঙ্খ লাগছে… মুখোমুখি দুই সরীসৃপ একে অন্যের ওপর আছড়ে পড়তে পড়তে আমায় জাগিয়ে রাখে এক বৃষ্টিভেজা বরফঢালা প্রবাসে । অন্ধকারে জানলার পর্দায় হাত রেখে খুব গোপন সুরে কে যেন বলে ‘চা-টা একটু কড়া হয়ে গেল’ …
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।