• Uncategorized
  • 0

“নারী-দি-বস” উদযাপনে সঞ্চালিকা আচার্য 

ফেরোশাস / ফ্যাবুলাস ফোর  

কিছু রাত চুপিচুপি এসে পায়ের কাছে দাঁড়ায়, হাতে নিয়ে আমাদের জীবনের খাতা। কোথা থেকে বেপরোয়া বাতাস এসে পাতা উল্টিয়ে-পালটিয়ে বোল্ড অক্ষরে লেখা কিছু শব্দ, কিছু বাক্য দেখায়। আতসকাচের নিচে আরেকবার জীবনকে পড়ি। তার ভালো মন্দ সব মিলিয়ে। 
   
“কল্পনার হাঁস সব – পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে ‘পর 
 উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর”
মিটিং-এর পরে সব ফাইলপত্র ঠিকঠাক রেখে নীহারিকা যখন অফিসের পার্কিং-লট থেকে গাড়ি বের করে সারজাপুর মেইন রোডে উঠলো, ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে গেছে। ব্যাঙ্গালোরের এই দিকটা এখনও ডেভেলপিং, তবে আইটি হাব হওয়াতে এত রাতেও বেশ কিছু গাড়ি আছে রাস্তায়। বাড়ি পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগবে। সারাদিন খুব ব্যস্ততায় কাটলেও মেজাজ বেশ পাখির মতো ফুরফুরে এখন। নীহারিকা দত্ত, একটি বহুজাতিক বিনিয়োগ সংস্থার চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার। ওর নেতৃত্বে আটজনের দল যে প্রজেকশন ও অ্যাডভাইস দিয়েছিল, সেগুলো ফলো করে আজকে কোম্পানি জাপানিজ ক্লায়েন্টের সাথে একটা ভালো বিজনেস ডিল ফাইনাল করেছে। গত পাঁচবছরে ওর যা পারফরমেন্স, আগামী বছর সিইও রিটায়ার করছেন, বোর্ড অফ ডিরেক্টরস এর কেউ বিশেষ বাগড়া না দিলে, হয়ত ওই… 
 
উত্তেজিত নীহারিকা ভাবে কখন গিয়ে সায়ন্তনকে সব বলবে। তবে এতক্ষণে বোধহয় ও ঘুমিয়েই পড়েছে। একটু নিভে আসে যেন। খেয়াল হয় কতদিন দুজনে বসে একসাথে ডিনার করে না ওরা। সিনেমা দেখতে যায় না। কতদিন শরীরও মেশায় না। দুজনেই কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সায়ন্তন একটা জাতীয় সংবাদপত্রের সিনিয়র এডিটর। এই অবধি পৌঁছাতে দুজনকেই ছাড়তে হয়েছে অনেক কিছু। ছেড়েছে ছোটবেলার উৎসব, নিকট আত্মীয়দের অনুষ্ঠান, ইচ্ছে করে সন্তানও নেয়নি। আজকাল এই উচ্চতায় নীহারিকার খুব একা লাগে। খুব অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছিল কি!  নাহলে পারতো মফস্বলের এক সাধারণ পরিবারের মেয়ে এতো দূর আসতে! তার ওপর বাংলা মিডিয়াম বলে কম উপহাসের শিকার হয়নি। প্রতিটা ধাপ পেরনোর পর নিজের জেঠু, মামীরাই বিদ্রুপভরা গলায় বলেছে “দেখতে সুন্দর, ও সফল হবে না কেন!” ভালো দেখতে, তাই? এ’রকম কদর্য বাইরের জগৎটার সাথে লড়তে গিয়ে কখন যেন গোলাপের পাপড়িগুলো একে একে ঝরে গেছে, এসেছে তীব্র কাঠিন্য। ভেবেছে সবসময় সবার ওপরে থাকতে হবে। খুব সামান্য ব্যাপারেও কড়া ভাষায় কথা বলেছে সকলের সঙ্গে, তাদের মধ্যে অনেকেই ওর প্রিয়জন। আগে যখন কলকাতায় অফিস ছিল দুজনের, সায়ন্তনদের পুরোনো বাড়িতে থাকতে ওর যে অস্বস্তি, চাকরি করে বলে কখনো রান্নাঘরের পথ ও মাড়াবে না, উচ্চশিক্ষিত হয়েও ওর জায়ের চাকরি না করে হোমমেকার থাকার ডিসিশন, এসব নিয়ে বারবার শ্লেষ মেশানো তির্যক কথা বলেছে সকলের সামনে। অনেক সময় অকারণে জুনিয়রদের ওপরেও নিজের ফ্রাস্ট্রেশন উগরেছে, খুব সামান্য ভুলে তাদের ভীষণ বকাবকি করেছে। এমনকি সায়ন্তনের সাথেও বহুবার ঝগড়া অশান্তি, পরে বুঝেছে অনায্য দাবিটা আসলে ওরই ছিল। এমন চলতে চলতে সায়ন্তনও যেন দূরের দ্বীপ হয়ে গেছে। এখন ওর নিজের সেইসব উৎকট ব্যবহার নিজের কাছে আধাসেদ্ধ নারীবাদ গেলার ফল বলেও মনে হয়। এতদিন পরে ভাবে জীবনকে যদি আরেকটু স্লো নিতো! ও মেধাবী, পরিশ্রমী, এবং সপ্রতিভ। এখানে হয়তো পৌঁছাতোই, শুধু একটু দেরি হত হয়ত বা। খুব কি খারাপ হত তবে? নদীর তীব্র বেগের মতো বয়ে চলতে গিয়ে দু’পার ক্রমশ ভেঙে পড়ল কি? এই প্রবল স্রোত নিয়ে ও একাই বহমান যেন।      
এসব ভাবে আজকাল; ভাবতে ভাবতে চোখে জল আসে নীহারিকা দত্তর। গল্পের ভেতর গাড়ি চলতে থাকে, প্রায় বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে। হঠাৎ মনে পড়ে কাল ছুটি, হোলি, বাঙালির দোল-উৎসব। ঠিক করে রাখে সকালে উঠেই আবির মাখিয়ে সায়ন্তনের ঘুম ভাঙাবে। তারপর বাজার যাবে, মাছ কিনবে। সায়ন্তনের রুই পোস্ত প্রিয়, দেখবে একবার চেষ্টা করে পারে কিনা ঠিকঠাক নামাতে। হঠাৎ আবার ভালো লাগতে শুরু করে। মনে পড়ে যায় ওর বন্ধুদের কথা, ‘ফেরোশাস/ফ্যাবুলাস ফোর’। জলপাইগুড়ি গভর্নমেন্ট গার্লস এর চার বান্ধবীর ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, চারজনেরই ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন। বেশ কিছুদিন হলো ওদের সাথেও কথা হয় না; এই স্পেশাল প্রজেক্টটা নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিল! ট্র্যাফিক সিগনালে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নীহারিকা ফোন নিয়ে গ্রুপ খোলে, টাইপ করে “কী ব্যাপার ডার্লোস, কাল দোল-স্পেশাল কী প্ল্যান সবার বল…”, ঠোঁটে ফুটে ওঠে একটা মায়াবী হাসি। গাড়ির মুনরুফ দিয়ে তখন জ্যোৎস্না চুঁইয়ে নামছে, যে আলো অনেক গভীরের জমাটকালো অন্ধকারও মুছে দেয় নিমেষে।   
“দূর সাগরের শব্দ – শতাব্দীর তীরে এসে ঝরে 
 কাল কিছু হয়েছিল; হবে কি শাশ্বতকাল পরে।”
সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে প্রায় নিভে আসা সিগারেটে অন্তিম টান দিতে দিতে যেই মুহূর্তে নয়না ভাবছে ওর কাঁধের পাশ দিয়ে দুটো ডানা বেরিয়ে আসছে যেন, সাদা ধবধবে ভাড়া করা উবের এসে থামল একটা বিকট আওয়াজ করে। প্রায় যেন ওর গায়ের ওপর। ক্লাবের অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে টানা চার ঘণ্টা নেচে ছিবড়ে হয়ে যাওয়া শরীরটাকে কোনরকমে টেনে নিয়ে গিয়ে উঠলো পিছনের সিটে। গাড়ি চলতে শুরু করলো নয়নার গল্পের ভেতর। একদা ছাত্র-যুব উৎসবের রাজ্য স্তরে নৃত্যে প্রথম স্থান অধিকারিণী নয়না চক্রবর্তী, এখন মিস নিনা মুম্বাই ব্রাইটস্টার ট্যালেন্ট অ্যান্ড মডেল ম্যানেজমেন্ট স্কুলের লিড ড্যান্স টিচার। মোদ্দা কথায় আইটেম ড্যান্সার তৈরি করে ওরা, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির জন্য। এরকম হাই প্রোফাইল অনুষ্ঠানে ওকেও নাচতে হয়, কিন্তু এটা আর পারছে না, অস্তরাগের সময় হয়ে এলো প্রায়। কীভাবে, কেন এই চাকরিতে ঢুকল ও, সেসব এখন নয়না ভাববে না। বরং ও এখন ভাবুক যে সন্তানকে ভ্রূণেই নষ্ট করে ফেলেছিল, তার কথা। নাগরিক জ্যোৎস্না ওর ক্লান্ত কপালের ওপর ফুটে থাকা বাদামী তিল ছুঁয়ে পিছলে গেলে ও ভাবে- খুব ভুল করেনি সেদিন। বাচ্চাটাকে পৃথিবীতে আনলে আরও বেশি কষ্টই দিত। সেই প্রেমিকও তো পিছলে গেছে কবেই। যেমন পিছলে গেছে বাবা-মা-ভাই, কাছের ও দূরের স্বজন সব। তারপর আর কোনও পুরুষকেই ও ভালবাসতে পারেনি। হয়েছে কিছু ক্যাসুয়াল সম্পর্ক, কিন্তু প্রেম? নাহ, হয়নি, বরং বলা ভালো প্রেম আসেনি। অনেকটা সময় চলে যাওয়ার পর বুঝেছে, ও আসলে ভালবেসেছিল তমালিদিকে। কলেজের সিনিয়র ছিল। কিন্তু বলতে পারেনি কিছু তখন। আজকাল সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলোতে নয়না ভীষণ অ্যাক্টিভ।  নাচের ক্লাস ও অনুষ্ঠান সবই রাতে থাকে বলে সারাদিন ও প্রায় ফ্রি। সেইসময় কবিতা লেখে। অনেক ঘুরে বহু অপমান সয়ে শেষে বিবিধ শর্তে পাওয়া ইস্ট বান্দ্রার এককামরার ভাড়ার ফ্ল্যাটে বসে নয়না লেখে কবিতা। পুঞ্জীভূত যে ব্যক্তিগত কুয়াশা, তাই কালি হয়ে ওঠে ওর কবিতার। সমাজের মজ্জার ভেতরে পুরুষতন্ত্রের বহতা ধারায় কীভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত, সেই কথাই উঠে আসে। আসে সেক্সুয়ালিটি। কেউ নিজের টার্মসে বাঁচতে গেলে এখনও সমাজ কেমন টুঁটি চিপে ধরতে আসে, ঠিক যেমন হয়েছিল একটা ভদ্র বাসস্থান যোগাড় করতে গিয়ে, লেখে সেসব নিয়ে। বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে; ফেসবুক ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করার একঘণ্টার মধ্যে শ’দুয়েক লাইক, খান পঞ্চাশেক কমেন্ট পায়। কিছু কিছু কবিতা ঘিরে ট্রোলড হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়াতেও স্বঘোষিত মরাল পুলিসের অভাব নেই। কিন্তু এখন ও বোঝে এইসবই পার্ট অফ দ্য গেম; খুব একটা গায়ে মাখে না। ক’দিন আগে র‍্যান্ডমলি খুঁজে ফেসবুকে পেয়েছে তমালীদি’কে; স্ট্যাটাস এখনও সিঙ্গল। বহুবার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট বাটনে আঙুল নিয়ে গিয়েও সরিয়ে এনেছে। একটা ছবি ডাউনলোড করে সেভ করে রেখেছে ফোনে, দেখে মাঝে মধ্যে। এই যেমন এখন একবার দেখবে বলে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করেছে যেই, অমনি ‘ফেরোশাস/ফ্যাবুলাস ফোর’ গ্ৰুপে পিং করলো রিকা, “কী ব্যাপার ডার্লোস…” 
মুহূর্তে বাঁহাতে ক্লান্তিকে সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো নয়না, চোখে মুখে ছোটবেলার দুষ্টু-মিষ্টি হাসি খেলে গেলো। এই হলো ওর আশ্রয়, স্যাংচুয়ারি, ওর প্রাণশক্তি, ওর তিনজন বন্ধু। মনে পড়লো পাণ্ডাপাড়া কালীবাড়ির সামনের কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়ার লাল-হলুদ পাপড়ি বেছানো রাস্তার ওপর দোলের দিনের আবীরসাজ। দল বেঁধে বন্ধুদের সাথে রং খেলা মনে পড়লো। নয়না রিপ্লাই টাইপ করতে শুরু করেছে, কান পাতলে এখন শোনা যাবে কাছেই কোথাও শিশির পড়ার উচ্ছ্বসিত শব্দ।  
“একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা 
 তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না 
 হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের”
যে দোল পূর্ণিমার চাঁদকে আমরা এতক্ষণ ব্যাঙ্গালোর ও মুম্বাইতে জ্যোৎস্না ঝরাতে দেখছিলাম, ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ তুলে আসমা তাকেই এক ঝলক দেখে নিলো। দেখলো এবং বুঝলো ওই নীলাভ আকাশের মতো কিছু বিষাদনীল স্মৃতির থেকে নিষ্কৃতি পাবে না আজ ও। দিল্লি আইআইটির কারপার্কে গাড়িতে হেলান দিয়ে ওই আকাশের গায়ে ফুটে থাকা চাঁদ ও নক্ষত্রমিছিলের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন প্রফেসর আসমাহ সিদ্দিকী, বহুল উচ্চারণে আসমা হয়ে গেছে যে। যে একটু আগেই পিএইচডি স্টুডেন্টের থিসিসের ফাইনাল রিভিউ শেষ করে এখন বাড়ি ফিরছে, এই গল্প তার গাড়িতে গিয়ে বসবে। গাড়ি চলতে শুরু করলে আসমার স্মরণের দিগন্তে একটি মুখ ফুটে উঠবে এখন, যে মুখ তার চার বছরের বন্ধু, তিন বছরের প্রেমিক, আরা বারো বছরের শোউহর ফাহাদের।     
ফাহাদ যখন ছেড়ে চলে গেলো, ওদের মেয়ে সামাইরা, আদরের ‘ফুল’-এর বয়স নয়। জেএনইউতে ফিজিক্সে মাস্টার ডিগ্রি করতে গিয়ে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম, তারপর বিদেশে পিএইচডি করার সময় নিকাহ আর তার দু’বছর পর ফুল এলো। দু’জনেই তখন পোস্টডক্টরাল ফেলো, আসমা এমআইটিতে, ফাহাদ বস্টন ইউনিভার্সিটিতে। ছোট বাচ্চা নিয়ে দু’জনের সামলাতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে আসমা যখন আইআইটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরের চাকরিটা পেলো, সবাই মিলে একসাথেই ফিরে এলো। ফাহাদের কোনও দ্বিমত ছিল না। দেশে ফিরে ফাহাদ নিজের কেরিয়ারে খুব সুবিধে করতে পারল না, নামী ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে কোনও অফার পেলো না। বছর দেড়েক পর গুরগাঁও-এ একটা সদ্য খোলা প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারারের চাকরি পেলো। অন্যদিকে পড়ানোর পাশাপাশি সরকারি অনুদানে আসমার রিসার্চও চলতে লাগলো পুরো দমে। আর তার সাথেই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকল ফাহাদের সাথে অশান্তি। নিজের উপযুক্ত চাকরি না পাওয়া আর আসমার ক্রমবর্ধমান খ্যাতি ওকে খুঁড়ছিল। আসমা সব বুঝেও ওর মেল ইগো-কে যতটা সম্ভব প্রলেপ দিয়ে রাখতো। বাঁধ ভেঙে গেলো সে’দিন যখন ফাহাদ বাড়িতেই ছিল অথচ ফুলকে স্কুল থেকে আনতে যেতে ভুলে গেলো বলে আসমা শুধু বলেছিল এটুকু হেল্প না করলে সে মন দিয়ে কাজটা করবে কীভাবে। সেদিনের ঝগড়া স্পষ্ট করে দিয়েছিল ফাটল কত গভীর অবধি। আসমা এখনও বোঝে না, ইউনিভার্সিটিতে অমৃতা প্রীতম, অরুন্ধতী রায় পড়া ছেলেটার মুখ দিয়ে ‘ব্লাডি ফেমিনিস্ট’ কীভাবে বের হতে পারে! ফেমিনিজম গালি হয়ে গেলো কবে? ফাহাদ নিজেও কি ফেমিনিস্ট নয়? ও কি কোনো দিন সকলের সমানাধিকারে বিশ্বাসই করেনি তবে? সেদিনই ঝগড়ার মাঝে আসমা জানতে পারে সৌদিতে একটা ইউনিভার্সিটিতে চাকরি পেয়েছে, ও চলে যাচ্ছে। এরপর আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয়নি। তিন-তালাকে ডিভোর্স ঘোষণা করে সে চলে যায়। আর ছোট্ট ফুলগাছ মাকেই অভিযুক্ত করে বসে তার আদরের আব্বুর সাথে থাকতে না পারার কারণ হিসেবে। কিছুদিনের মধ্যে ডিভোর্স সার্টিফিকেট এসে পৌঁছায়, সই-এর ওপর আসমা আঙুল বোলায়। কতদিনের পরিচিত সবকিছু নিমেষে অচেনা হয়ে যায়, আর এখন এতবছর পরেও এসব ভেবে আসমার চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। থেকে থেকে সন্দেহ হয়, ফাহাদ আদৌ কখনো ভালোবেসেছিলো! আসমা তবু পারেনি কোনো রাগ জমাতে। ফুলগাছ মায়ের ওপর রাগ করে বেশিদিন থাকেনি, কিছুমাসের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যায়। আব্বু তার সাথে যোগাযোগ রেখেছে, ইমেলে নিয়মিত, ফোন মাসে একবার। আসমার সঙ্গে ওর বৃদ্ধা মা, ওদের দীর্ঘদিনের পরিচারিকা, আর ফুল এই চারজনের বেশ ঝিলমিল সংসার ওদের। ভালোই আছে, অনেকটা নবনীতা দেবসেনের ‘মাতৃয়ার্কি’-র মতো, ভাবে আসমা…   
কালকে ফুলের জন্মদিন, ফাহাদেরও, কাল দোল, কমপ্লেক্সের অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে এক হয়ে গিয়ে ফুলও হোলি খেলে। অত রঙ আসমার ভালো লাগে না বলে দূরে দাঁড়িয়ে দেখে অন্যদের আনন্দ। কেউ ওকে জোর করে না। ফুলগাছকে নিয়ে চিন্তা হয় খুব, দিল্লির অবস্থা ভালো নয়, দাঙ্গার পরে এখনো যেন ভেতরে ফুঁসছে। মেয়ের এই আঠেরো হলো, স্কুল, টিউশনি, গানের স্কুল সব একাই তো করে। এ’সব ভাবতে ভাবতেই গাড়ি পৌঁছে গেলো চিত্তরঞ্জন পার্ক, আসমার মনে পড়ে একবার রিকার সাথে কথা বলতে হবে, মেয়েটা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পড়তে চায়। আর তখনই ওদের ‘ফেরোশাস/ফ্যাবুলাস ফোর’ গ্ৰুপে পিং করলো রিকা, “কী ব্যাপার ডার্লোস…”, ফোনের স্ক্রিনে চোখ রেখে আসমা ভাবে এই মেয়েটা কি টেলিপ্যাথি জানে!   
“মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা; 
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সংকল্প স্বপ্নের উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা। 
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো 
এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।”   
কোনোরকমে শাড়ির কুঁচি তুলে ধরে স্থানীয় এমএলএ-র বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নেমে শালবনী কাঁচুমাচু মুখে ড্রাইভারকে বলল “সরি গো রহমত ভাই, তোমার বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো দেখো তো”, বলেই উঠে পড়ল গাড়িতে। রহমত গাড়ি স্টার্ট করে বলছে, “তাতে কিছু অসুবিধা নেই। আমি তো বিবিকে জানিয়ে দিয়েছি, কিন্তু আমার চিন্তা হয় আপনার জন্যই দিদিমণি। জানেন তো এই এমএলএ-টা একটা শয়তান, তার ওপর আজ এসে হাজির হয়েছিল ওই হাঙর দারোগাটা। আপনি না ফেরা অবধি খুব অশান্তি হচ্ছিল”। শালবনী মৃদু হেসে বলে “জানি, সবই জানি ভাইজান, কিন্তু কী করবো বলো এই আমার কাজ, আমার ভালবাসা।“ বলে শালবনী পিছনের সিটে ক্লান্ত মাথা হেলায়। কথা না বাড়িয়ে রহমত সিডি প্লেয়ারটা চালু করে, ধ্রুপদী সংগীতের আলাপ বেজে ওঠে।  
মনের ভেতর আটকে থাকা শেষ বিকেলের রোদের মতো অতীত গল্পের গাড়িতে বসা সমাজকর্মী শালবনীকে এখন মনে পড়াবে কাল ওর শাশুড়ি-মায়ের মৃত্যু-বার্ষিকী। সন্তানের জন্ম দিতে না পারার জন্য, ‘স্বামী’ অফিস থেকে ফিরলে তাকে চা বানিয়ে দেওয়ার সময় অনুপস্থিত থাকার জন্য, ‘নিষিদ্ধপল্লী’-তে গিয়ে কাজ করার জন্য, আর্থিক উপার্জন হবে এমন কাজ না করার জন্য, আরও বহুকিছুর জন্য শালবনীকে গঞ্জনা দিতে দিতে শাশুড়ি চলে গেছেন গত বছর। প্রথমদিকে কষ্ট পেলেও পরে শালবনী ওই মানুষটার প্রতি সিম্প্যাথেটিক ছিল বরাবর। বুঝতো সেই কোন অল্প বয়স থেকে বিধবা মা ভাসুর-দেওরদের সংসারে থেকে একা হাতে ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে বুঝি অমন খিটখিটে হয়ে গেছিলেন। শালবনী আগে যে এনজিওতে কাজ করত, সেখানে ভেতরের খেয়োখেয়ি, টাকাপয়সার নয়ছয় এসব দেখে সরে গিয়ে নিজেই একটা ছোট সেন্টার খুলেছে। নরেন্দ্রপুরে প্রায় সাত কাঠা জমির ওপর শালবনী আর তন্ময়ের ফিনিক্স এনরিচমেন্ট সেন্টার। এক-দু’জন নয়, প্রায় জনা সত্তর ছেলেমেয়ের মা এখন শালবনী। সোনাগাছি, হাড়কাঁটা গলি, আর কালি টেম্পল রোডের যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েরা সেন্টারের বাসে করে আসে এখানে পড়তে, গান বা আঁকা শিখতে, আর একবেলা পেট ভরে খেতে। তাদের মায়েদের কাজ করতে অসুবিধে যাতে না হয়, তাই ওদের অনুরোধেই শালবনীরা সেন্টারের সময়টা রেখেছে বিকেল তিনটে থেকে রাত দশটা। সেন্টারের বাসে দিনের শেষে ডেরায় ফিরে ক্লান্ত বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। মায়েদেরও সন্তানের সামনে বিব্রত হতে হয় না। তন্ময় নিজের চাকরিতে ব্যস্ত বলে বেশি সময় দিতে পারে না, কিন্তু শালবনী পাশে পেয়েছে বেশ কিছু ভলান্টিয়ারস। কেউ টিচার, কেউ বাস ড্রাইভার, দুজন রান্নাঘর পরিচালনা করেন, দুজন সিকিউরিটিটা দেখেন। আর আছে তন্ময়ের উকিল-বন্ধু নির্মাল্য। এখন নির্মাল্যর কথা মনে পড়বে শালবনীর আর একটা শিরশিরানি ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়বে মন-ভর্তি শরীরে। একটা ইন্টেলেকচুয়াল বন্ড আছে দু’জনের মধ্যে; ব্যস এটুকুই, কিন্তু একটা খুব ভালো লাগার জায়গা এটা, দু’জনেরই।      
      
আইনি ব্যাপারগুলো নির্মাল্যই দেখে। আজও যেমন আসার কথা ছিল, কিন্তু কোর্টে জরুরী কাজ চলে আসায় আসতে পারেনি। স্কুলের একজন বাচ্চার মা মারা গেছে। মনে হচ্ছে তার ক্লায়েন্ট জোর করে স্ম্যাক শুঁকিয়েছিল। কিন্তু কেউ মানতে রাজি নয় সেটা। এই মৃত্যু ঘিরে চাপান উতোর চলছে, ঝামেলা চলছে বাচ্চা মেয়েটির কী হবে তাই নিয়েও। কালীঘাটের লোক্যাল এমএলএ আর থানার দারোগার সাথে এই নিয়েই মিটিং ছিল। পুলিশ তো গিরগিটির মতো রং বদলায় শাসক বদলানোর সাথে সাথেই। এই কদর্যতায় গা ঘিনঘিন করে শালবনীর। এমনকি ওর দিকেও কতবার উড়ে এসেছে নোংরা প্রস্তাব, কিন্তু ও হাল ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নয়। এই যুদ্ধের শেষ দেখে তবে ছাড়বে। সকালে নির্মাল্যকে একটা ফোন করতে হবে, চোয়াল শক্ত করে ভাবছে এখন। 
   
সেন্টারটা আরো বাড়ানোর ইচ্ছে আছে। দেখছে যদি খিদিরপুরেও কাজ করা যায়। একজন ফিজিক্যাল এডুকেটর খুঁজছে, ছেলেমেয়েগুলোকে বেসিক মার্শিয়াল আর্ট শেখানো যায় যদি। নয়নাও হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে মুম্বাই ছেড়ে চলে আসবে এখানে নাচের টিচার হয়ে। শালবনী নিজে থেকে না চাইলেও রিকা আর আসমা এই প্রতিষ্ঠানের জন্য নিয়মিত টাকা দেয়। কোথায় কতটা খরচ হলো, সবকিছুর হিসেব পাঠায় ও। এখন ভাবে একবার লিখবে ওদের আজকের মিটিংয়ের কথা, তখনই নোটিফিকেশনটা আসে  “কী ব্যাপার ডার্লোস…”
কাল দোল? ও তো ভুলেই গেছিলো কলকাতায় থেকেও, অথচ রিকা অত দূরে বসেও ঠিক মনে রেখেছে! একটু উদাস মনে বাইরে তাকায়, দেখে ওরই সঙ্গে উড়ে চলা মেঘেদের ভাঁজ থেকে উঁকি দিচ্ছে রুপোর থালার মতো পূর্ণচাঁদ। আকাশটাকে কেউ যেন ধোঁয়া রঙের শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে আজ, যার কপালে চাদঁটিপ। কল্লোলিনী শহরের গুমোট হাওয়ার বুক চিরে ছুটে চলেছে গাঢ় নীল রঙের হন্ডা জ্যাজ, আর এই গাড়ির ভেতরে বাইরে সমস্ত চরাচরে ঠিক এখনই বাজতে থাকলো শোভা গুর্তুর ভজন “আজ বিরাজ মে হোলি রে রসিয়া…”

পাদটীকা : উদ্ধৃত কবিতার পঙক্তিগুলো জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। 
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।