• Uncategorized
  • 0

“নারী-দি-বস” উদযাপনে শতাব্দী দাশ

নারীদিবস বা মেয়েকামরার গল্প

আমি যে কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করি, যেখানে শান্তি, রাবেয়া, টুকটুকিরা নারীদিবস বোঝে না৷ শ্রমজীবী নারীদিবসও না। এবার তাই সেখানেই নারীদিবস পালন করব ভেবেছি৷ রাজিও করিয়েছি ক’জনকে। রোববার তো সম্ভব নয়, অগত্যা সোমবার।

দ্বিতীয়বার এই লেডিজ কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত শুরু করি ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে। তার আগে সচরাচর যাতায়াত ছিল জেনারেলে৷ 

প্রথম দফায়, অর্থাৎ ছোটবেলায়, মেয়ে-কামরাকে স্যাডিস্ট প্রান্তর মনে হত।  মেজোবাবু আজ গায়ে হাত দিয়েছে…ফ্ল্যাটের বৌদি দেরি করে আসায় যাচ্ছেতাই অপমান করেছে…শাশুড়ি বলেছে,’ট্রেনে গলা দাও না কেন?’…এই যে এত এত পুঞ্জীভূত রাগ, ক্ষোভ, তা  উগরে দেবে না লোকে? কেমন যেন খ্যাঁকখ্যাঁকে স্বভাব সবার! কথায় কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে ৷ আমার তখন ভালো মেয়ে হওয়ার প্রথম পাঠ চলছে। ভালো লাগে কি এসব? 

দ্বিতীয়বার, ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে লেডিজ কামরায় ফিরেছিলাম  খুব একলা হতে চেয়ে। এতদিনের দলবল, চেনা মানুষজন…তাদের এড়াতে, চুপচাপ জানলার ধারের সিটটা পেতে ঠাঁইনাড়া হলাম। ততদিনে আড়ে বহরে বেড়েছি, মুখ ঝামটা দিতে শিখেছি, ঘাড় উঁচু করে দেখতে হচ্ছেনা প্রবল মহিলাদের। 

এইবেলা দাঁতমুখ খিঁচোনো মেয়ে দৈত্যগুলোকে  মানুষের মতোই লাগল। চোখের তলায় কালিঝুলি দেখা গেল। সে আয়া-সেন্টারের আয়া হোক বা ইস্কুল দিদিমণি, প্রত্যেকে যে যার বাড়ি থেকে কাজে বেরিয়েছে  ভালো বউ,ভালো মা হওয়ার ব্রাউনি পয়েন্ট সংগ্রহ করে। সক্কাল সক্কাল জেনারেল কম্পার্টমেন্ট আড় ভাঙছে। আর লেডিজ কামরা দিনের শুরুতেই আধেক শক্তি খুইয়ে বাকি আধেক নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ছুটছে।

-চুল বেঁধে আসা হয়নি। 

-আয় বেঁধে দি।

-শাড়ির কুঁচিটা ধরে দেবে কেউ?

তাদের চলন্ত ট্রেনে প্রসাধন।  তাদের মাথা-ধরানো সাতকাহন। সেনকো জুয়েলারি, চন্দ্রাণী পার্লস, ‘শ্রীময়ী’- যা যা প্রয়োজন ভালো থাকার ভান করতে, সবের হদিশ আছে এই কামরায়। আছে মেছুনি বউর মাথার আলু।  যে কলেজের দিদিমণির বর মিডিয়ায় কাজ করেন, তাঁর অবশ্য মাথা ঠুকে দেওয়া হয় না। শোনা যায়,তিনি দিবারাত্র পড়ে যান, বাথরুমে, উঠোনে…পড়ে গিয়ে গাল ফুলে যায়, মাথা ফেটে যায়, বাহুতে কালশিটে…  

এখানে  হিজাব পরা একটি স্কুলের মেয়ে হাত জড়িয়ে ধরে হঠাৎ বলতে পারে, ‘বাঁচাও। আমার বিয়ে দিয়ে দেবে’। এখানে  আপাতসাধারণ বধূ সেরিব্রাল পালসির শিশুকে নিয়ে অসীম যুদ্ধের ঝাঁপি খুলে বসতে পারে। বোরখা পরা আট বছর মুখের ঢাকনা সরিয়ে কলকল করে বলতে পারে তার প্রিয় কার্টুন চরিত্রদের নাম। আবার আজকের ছটফটে মেয়েটা কাল নবোঢ়া হয়ে ট্রেনে চড়তে পারে,পরশু সে কথায় কথায় খেই হারিয়ে ফেলতে পারে, বিড়বিড় করতে পারে, ‘মরে যাই না কেন? মরে যাই না কেন?’ 

এহেন মেয়ে কামরায় নারীদিবসের কথা জানে না রাবেয়া, টুকটুকি, শান্তিরা। তা বলে কি আর দিদিমণিরা জানে না? জানে তো। তাঁরা জানেন, নারীশ্রমিকদের আন্দোলনের কথা। ভোটাধিকারের লড়াই-এর কথা। কিন্তু সেসব গল্প হু হু করে চাউর হয় না শ্রীময়ীর আত্মত্যাগের মতো। অথচ তাঁরা নারী, উপরন্তু তাঁরা সকলেই শ্রমজীবী।  এখানেই ব্যর্থতা রয়ে গেছে। একদিন লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরাগুলো আন্তর্জাতিক ‘শ্রমজীবী’ নারীদিবস পালন করবে একসাথে। সেই দিন ৮ই মার্চ সার্থক হবে।

৮ই মার্চ ‘International Women’s Day’ শুধু তো নয়, আদতে ‘International Working Women’s day’। বিংশ শতকের শুরুতে, আমেরিকার সোশ্যালিস্টরা বা খোদ ইউ.এস.এস.আর এভাবেই পালন করত দিনটি। রক্ত-ঘামের ঘ্রাণ,কাজে সম-পারিশ্রমিক,সমমর্যাদার দাবির অনুরণন জড়িয়ে আছে এই দিনে। 

শ্রমজীবী নারী কে? তাঁর শ্রমের বৃত্ত কোথায় শুরু, কোথায় শেষ? এই যে কাজের মাসি, গেঞ্জি কারখানার কর্মী, আনাজওয়ালি বা অফিসযাত্রী- প্রত্যেকে এক পৃথিবী কাজ সেরে ট্রেনে ওঠেন আরেক কর্মজগতের উদ্দেশ্যে৷ প্রথম ধাপের কাজগুলির মধ্যে পড়ে রাঁধাবাড়া, ঘর পরিষ্কার, ছেলেমেয়েকে ইস্কুলের জন্য তৈরি করা, তার টিফিন গোছানো।  তারপর নিজেকে কোনোমতে প্রস্তুত করে ট্রেনে চাপা। সত্যিই এঁরা দশভুজা। শুধু ‘দশভুজা দেবী’ না বলে ‘দশভুজা শ্রমিক’ বললে আরও সঠিক বলা হয়। 

‘শ্রমিক’  শব্দটি অপমানের নয়। মাথার পিছনের আলোকবর্তিকার চেয়ে অনেক বেশি কাঙ্ক্ষিত এই ‘শ্রমিক’ তকমা। ‘শ্রমজীবী’ শব্দেও কোনো অপমান নেই৷ এই শব্দে ‘শ্রম’ ও ‘জীবিকা’ স্পষ্টভাবে  পাশাপাশি অবস্থান করে৷ তাই শব্দটির সঙ্গে প্রাপ্য মজুরি, সম্মান ও মর্যাদার জরুরি দাবি অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকে ৷ বি.পি.এল থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত পর্যন্ত নানা অর্থনৈতিক স্তরে এমন কোনো নারী সচরাচর দেখি না,  যিনি শ্রমজীবী নারী নন৷ কারণ গৃহকর্মেও যথেষ্ট শ্রম-ব্যয় হয়৷ 

অথচ রাষ্ট্রসংঘ অবলীলায় ‘শ্রমজীবী’ কথাটি ছেঁটে ফেলে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ বানালো ৮-ই মার্চকে৷

নারীর শ্রম দুই প্রকার-এক, যা পুঁজিবাদী চোখে দৃশ্যমান, যার অর্থমূল্য আছে। আর দুই, যা পুঁজিবাদী চোখে অদৃশ্য, কারণ তার অর্থমূল্য নেই। যেমন জনন, প্রতিপালন, গৃহকর্ম। নারীর চেয়ে বড় শ্রমিক আর কে? 

অনেক বিস্মৃতি আর বিকৃতি পেরোলে, তবেই আজকের ‘হ্যাপি উইমেন্স ডে’-তে পৌঁছনো যায়। টমসন রয়টার্স স্কেলে ভারত মেয়েদের জন্য সবচেয়ে অ-সুরক্ষিত দেশ৷ আনন্দের অবকাশ কোথায়? আজ  কোনো বিজ্ঞাপনী দিনও নয়৷ ডিসকাউন্ট কুপন সংগ্রহ করে সক্ষম কনজিউমার বা ক্রেতা হিসেবে নারীর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দিনও নয়। 

আজ  মেহনতি নারীর দিন। সে তিনি কারখানা শ্রমিক হোক, গৃহশ্রমিক হোন, এমনকি সাদা কলারের শ্রমিক হোন- তাঁদের সবার স্বীকৃতির দিন। তাই 

উদযাপনের পরিধি বাড়ুক। ওই যে বললাম, একদিন সব লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরাতেই ৮ই মার্চ পালিত হবে….

সমষ্টিচেতনা গড়ে ওঠার  অবকাশ কিন্তু আছে। ফাঁকিবাজি থেকে যাচ্ছে হয়ত প্রচেষ্টায়। এখনও ফেমিনিজম এখানে মূলত আকাদেমিক ডিসকোর্স৷ সেই ডিসকোর্সের মাটির কাছাকাছি পৌঁছনো নাকি আছে। জনমানবীর কাছে, তাদের ভাষায়,তাদের মনোমতো ভাষ্যে নারীবাদকে পৌঁছে দেওয়া বাকি আছে৷   নারীবাদ ‘হোয়াই শুড বয়েজ হ্যাভ অল দ্য ফান’ বিজ্ঞাপনে মনোনিবেশ না করে, রাবেয়া, টুকটুকিদের শ্রমজীবী নারীর মর্যাদা দিতে পারত। এখনও দিতে পারে। নারীবাদই পারে।

আর তথাকথিত মুক্ত, স্বাধীন দিদিমণিদের একবার নিজের সামনে দাঁড় করাতেও পারত। এখনও পারে।  এই বছরের নারীদিবসের থিম হল -‘আমরা সাম্যবাদী প্রজন্ম’। সত্যি? অসুরক্ষিত সেক্টরে নারী-পুরুষের মজুরি সমান? নাহ্।  এদেশে জেন্ডার পে-গ্যাপ ২৫%। আর সুরক্ষিত সেক্টরে, যেখানে মজুরি সত্যিই সমান? অদৃশ্য অসাম্য সেখানেও মাথা চাড়া দেয় না? মাতৃত্বকালীন ছুটি চেয়ে ছাঁটাই হন না হোয়াইট কলার শ্রমিক? কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন ঘিরে মিটু আন্দোলন করতে হয় না? গৃহকর্মের অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হয় না? লিঙ্গভিত্তিক শ্রমবিভাজন হয়ত কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে৷ হয়ত কোনো কোনো পুরুষ গৃহকাজেও হাত লাগান৷ কিন্তু সেটি তাঁর কর্তব্য নয়, ‘মহত্ব’। আগে বলা হত, মেয়েরা সব পারে। এখন বলে, ‘মাল্টিটাস্কার’। ভবি তাতেও ভোলে। ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার খাঁচা বড় লোভনীয়। 

তবু, নারীবাদ তার বাইরের আকাশ৷ আজ যে দিদিমণিরা নারীবাদী তকমাকে ভয় পান, কাল তাঁরা আকাশ ভালোবাসবেন নিশ্চয়৷ 

আপাতত এক এক করে সবাই নেমে যায়, যার যার স্টেশনে ।  ছড়িয়ে পড়ে, একা আর নি:সঙ্গ হয়ে যায়- আবার একসাথে মেয়ে-কামরায় উঠবে বলে। একসাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে বলে। একসাথে  সিরিয়ালের গল্প করবে, রাতের মেনু ঠিক করবে। পরিকল্পনা করবে কীভাবে বিয়ে না করতে চাওয়া মেয়েটিকে বাঁচানো যায়। কীভাবে হঠাৎ চুপ হয়ে যাওয়া বকমবকম-টিকে আবার কথা বলানো যায়। কখনই সংসার ভেঙে বেরোবে না যে মেয়ে, তাকেই বা কীকরে নিত্য ভালো রাখা যায়।  এই সব ছোটখাটো প্রচেষ্টায় অসীম সমষ্টি-সম্ভাবনা দেখতে পাই ৷ একলা হতে চেয়ে মেয়ে-কামরায় উঠে আমার আর একলা হওয়া হয় না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।