বরোদা এয়ারপোর্টে নেমে বিদিশা খানিকটা নিশ্চিন্ত হল। যাক্,শেষ পর্যন্ত আসা হল তাহলে। ভারতের একদম পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই রাজ্য। সেই বিয়ের পর থেকে ইচ্ছে যে একবার নবরাত্রির সময় গুজরাটে আসবে,ছোট ভাসুর আর জা কবে থেকে বলছেন একবার ঘুরে যা আমাদের বাড়ি। কোন না কোন কারনে আসা আর হয়ে উঠছিল না। অবশ্য এরজন্য শুধুমাত্র পরিস্থিতিকে দোষ দেওয়া যায় না। আসলে পুজোর সময় কোলকাতা ছেড়ে আসতে বিদিশা বা তুষার কারোরই মন চাইত না। পুজোর সময় কোলকাতায় যা মজা হয়-সারাদিন বন্ধু বান্ধবদের সাথে হুল্লোড়,আড্ডা,অস্টমীর অঞ্জলী ,গভীর রাতে গাড়ি নিয়ে প্যান্ডেল হপিং। এসব কি আর গুজরাট গেলে পাওয়া যাবে? আর একটা ব্যাপার যা বিদিশা কোনদিন কাউকে বলেনি সেটা হল,মহালায়ার চন্ডীপাঠের সেই মন্ত্র—ইয়া দেবী সর্বভুতেশু শক্তি রুপেন সংহস্থিতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বিদিশার মনের মধ্যেও একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হয়,মনে হয় যেন পুজোর ক’টা দিন দেবী দুর্গা তার উপর ভর করে। তাই যতবার প্রোগ্রাম করেছে নিজেরাই ভেস্তে দিয়েছে। কিন্তু এবার মেয়ে নয়না একরকম জোর করেই বাবা মাকে টিকিট কাটিয়েছে।
এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এসেছে ছোট জা তন্দ্রা আর তার দুই ছেলে মেয়ে রিয়া,রিকি। ভাশুর আ্সতে পারে নি, অফিস আছে।
জা বিদিশাকে জড়িয়ে ধরে বলল, শেষ পর্যন্ত এলি তাহলে!
বিদিশা হেসে বলল,তুমি এত করে ডাকছ, না এসে পারি বলো?
নয়না পাশ থেকে ফুট কাটল,জেঠিমনি, বাবা মাকে এখানে আনার পুরো ক্রেডিট কিন্তু আমার।
তন্দ্রা নয়নাকে বুকে জড়িয়ে ওর কপালে চুমু খেল।
গাড়িতে যেতে যেতেই ওরা ভাইবোনে মিলে প্রোগ্রাম করতে থাকল কবে কোন ক্লাবে ওরা গর্বা খেলতে যাবে।
তন্দ্রা জিগ্যেস করল,হ্যাঁগো ঠাকুরপো তোমাদের ফেরার টিকিট কবে? আসলে ক’দিন আছ জানতে পারলে সে ভাবে পোগ্রাম করা যাবে।
তুষার বলল,সাতদিন আছি বৌদি গুজরাটে,তার মধ্যে দুদিন সোমনাথ আর দ্বারকায়,একদিন গির ন্যাশানাল পার্কে কাটাব। তারপর আবার বরোদায় ব্যাক করে এখান থেকে রিটার্ন ফ্লাইট ধরব।
রিয়া আর রিকি চেঁচিয়ে উঠল। এ মা মাত্র চারদিন থাকবে তোমরা আমাদের কাছে? না না হবে না। টিকিট ক্যান্সেল কর।
তুষার বুঝল, এদের উৎসাহে বাঁধা দিলে বিপদ,তাই বলল,আচ্ছা। এখন তো তোদের বাড়ি আগে পৌঁছই, তারপর দেখা যাবে।
(২)
বিদিশা দেখল,সাধারন মধ্যবিত্ত একটা পাড়ায় ছোট ভাশুরের ফ্ল্যাট। ছোট কিন্তু বেশ সাজানো। মাত্র তিন ঘণ্টার প্লেন জার্নি। তাই এমন কিছু ক্লান্তি লাগছিল না তবুও ফ্রেশ হয়ে জায়ের হাতে বানানো গরম গরম ভাত আর মাছের ঝোল খেয়ে একটু গড়িয়ে নিল। কখন যে দু চোখ জুড়ে ঘুম নেমে এসেছে বুঝতেই পারে নি। বিদিশার ঘুম ভাঙল জায়ের ডাকে।
আরে ওঠ ওঠ,অনেক ঘুমিয়েছিস। একটু বাদেই তোর ছোড়দা চলে আসবে। তারপর আমরা সবাই গর্বা দেখতে যাব।
রিয়া জিগ্যেস করল,কাম্মা চানিয়া চোলি এনেছ?
চানিয়া চোলি ? কেন?
এমা, চানিয়া চোলি না পড়লে তো তোমরা গ্রাউন্ডে ঢুকতেই পারবে না। চানিয়া চোলি মাস্ট।
বিদিশার মন খারাপ হয়ে গেল,এটা তো তার জানা না।
বিদিশা কে মন খারাপ করতে দেখে তন্দ্রা হো হো করে হেসে উঠল। আমি জানতাম তুই আনবি না। এই দেখ আমি তোর আর নয়নার জন্য রেডি করে রেখেছি।
ওমা কি সুন্দর!এটা আমার জন্য? থ্যাঙ্ক ইউ জেঠিমনি বলে নয়না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে দেখল,গাঢ় নীলের সঙ্গে গোল্ডেন বর্ডারের ওড়নাটা সত্যিই খুব সুন্দর।
নে, নে আর দেরী করিস না। চা খেয়ে তৈরী হয়ে নে। আমি চা বানাতে যাচ্ছি।
সন্ধ্যে হতেই রিয়া,রিকি আর নয়না সেজে গুজে বেরিয়ে পড়ল। ওরা অন্য ক্লাবে যাবে, মায়েদের সঙ্গে যাবে না। সারাক্ষন জিন্স আর টপ পরা মেয়েকে চানিয়া চোলিতে দেখে বিদিশার বুকটা ধক্ করে উঠল, একটু ভয় ভয় করছে মেয়েকে এইভাবে ছাড়তে। যা দিনকাল পড়েছে,সব জায়গাতেই মেয়েদের বিপদ। তন্দ্রা আশ্বাস দিয়ে বলল,ওরা যে ক্লাবে যাবে সেটা খুব রেপুটেড ক্লাব। ভয় পাবার কিচ্ছু নেই।
চানিয়া চোলি আর নাকে টানা নথ পরে বিদিশাও আজ গুজরাটি হয়ে গেল। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বিদিশা ভাবছে, সত্যি তো! এই ড্রেসেই তো বোঝা যায় কে কোন্ প্রদেশের। না হলে মানুষ তো সবই এক।
গ্রাউন্ডে ঢুকে বিদিশা অবাক। চারিদিকে আলোর রোশনাই। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই জোড়ায় জোড়ায় সুসজ্জিত সুন্দর সুন্দরীদের ঢল। মেয়েদের লো ওয়েস্ট, ব্যাক ওপেন চানিয়া চোলি। ব্যাক পালিশ করা মসৃন গ্রীবা,পিঠ,মেদ হীন কোমরের হিল্লোল। অন্যদিকে জমকালো শেরোয়ানিতে সুসজ্জিত পুরুষদের উন্মাদনা। গোটা পরিবেশটা এতটাই উৎসব মুখর যে মনটা আপনা থেকেই নেচে উঠছে। বিদিশা পাশে তাকিয়ে দেখল, তুষার মগ্ন হয়ে নাচ দেখছে।
(৪)
দুদিন বরোদাতে খুব মজা করে কাটিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল সোমনাথ দর্শনে। মন্দিরে পুজো দিয়ে পরের দিন বিদিশারা চলল এশিয়াটিক লায়নের একমাত্র সংরক্ষন কেন্দ্র গির ন্যাশানল পার্কের উদ্দেশ্যে। রাস্তায় যেতে যেতে অল্পবয়সী ড্রাইভার রাজেশের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর রাজেশ বলল, সাব আপ লোগ খানা খায়েঙ্গে?
একদম ঘর কা মাফিক মিলেগা সাব বলে সে একটা ঝুপড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করালো।
সামনে একটা ছোট্ট পার্ক । তাতে বেশ কয়েকটা দোলনা লাগানো । নয়না আর বিদিশা দোলনায় বসে পড়ল। খানিকক্ষন পর রাজেশ ও আর একজন দেহাতি মহিলা তাদের জন্য নিয়ে এল গরম গরম থেপলা আর গাঢ় দুধের চা।
নয়না বলল,মা এটা কিন্তু সিংহের দুধের চা।
ওর কথা শুনে রাজেশ আর দেহাতি মহিলা দুজনেই হেসে উঠল। বোঝা গেল বাঙ্গালী টুরিস্ট এখানে মাঝে মধ্যেই আসে। তাই ওরাও একটু আধটু বাংলা বোঝে।
(৫)
খাওয়া শেষ করে আবার বিদিশারা বেড়িয়ে পড়ল। এবার চারিদিকে বড় বড় ঘাসের বন। মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে গাড়ি। প্রতি মুহূর্তে বিদিশার ভয় করছে হঠাৎ করে সিংহ এসে না ঝাপিয়ে পড়ে।
তুষার রাজেশকে হিন্দীতে জিগ্যেস করল,তুমি কখনো সিংহের সামনে পড়েছ?
না সাব এ্যায়সা নেহী হুয়া। একবার হুয়া কেয়া বলে রাজেশ যা শোনালো তাতে তো বিদিশার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল-ওদের গ্রামে নাকি এক গরীব মানুষের বাড়িতে সিংহ হানা দিয়েছিল। সন্ধ্যেবেলা ছাগল গুলো গোয়ালে বাঁধছিল লোকটা। ঠিক তখনই সিংহটা বুড়ো লোকটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে। ওনার মেয়েও বাবাকে সাহায্য করার জন্য পিছন পিছন আসছিল। বাবার উপর সিংহকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখে মেয়েটা হাতের কছে গরুর খর কাটা বটি নিয়ে সিংহের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। একের পর এক কোপ বসাতে থাকে। সিংহটা বিপদ বুঝে বুড়োকে ছেড়ে পালায়,ততক্ষনে বুড়োর আধমরা অবস্থা। চিৎকার চেঁচামেচিতে গ্রামের লোক সব জড়ো হয়ে যায়। বুড়োকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বুড়ো কোনো রকমে প্রানে বেঁচে গেলেও ওর কাজ কর্ম করার ক্ষমতা চলে যায়।
তারপর রাজেশ গর্ব করে বলল,জানেন সাব,সরকার থেকে মেয়েটাকে নকরি দিয়েছে। আপনারা যেখানে যাচ্ছেন ওখানেই নকরি করে ও। আমরা মেয়েটাকে অম্বা বলে ডাকি।
তুষার বলল,আগে জঙ্গল সাফারি করে আসি তারপর দেখা করব। গুজরাট গভর্মেন্টের জিপে করে প্রায় পনেরো জনের একটা দল সমেত বিদিশারা ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। গাইড প্রথমেই বলে দিয়েছে জানলা না খুলতে আর কোনো শব্দ না করতে। যাত্রীরা সবাই ভয়ে ভয়ে আছে কখন সিংহ এসে ঝাপিয়ে পরে, যেমন সিনেমায় দেখা যায় আর কি। সবাই হাতের ক্যামেরা তাক করে আছে। তার মধ্যে যারা জানলার সামনে সিট পেয়েছে নিজেদের লাকি মনে করছে। কিন্তু কোথায় পশুরাজ? জীপ ততক্ষনে অনেকটা গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ দেখা গেল দেবী দুর্গার বাহন মহানন্দে স্ত্রী, পুত্র কন্যা নিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। একবার তাচ্ছিল্য ভরে জীপের দিকে তাকিয়ে বিরক্তভাবে মুখ ফিরিয়ে নিল। সবাই জানলা খুলে পটাপট ছবি তুলছে। কি মনে করে সিংহটা একবার পোজ দেওয়ার ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়াল। বিদিশারা খুব খুশী যাক জঙ্গল সাফারি সার্থক হল। ন্যাশানল পার্কের অফিসে এসে তুষার এনকোয়ারিতে অম্বার সম্বন্ধ্যে জানতে চাইলে একজন সিকিউরিটি গার্ড ওর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল।
অলিভ গ্রীন কালারের শাড়ি পরা অম্বাকে দেখে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল বিদিশা। এই মেয়েটা একা একটা সিংহকে কাবু করেছে! অম্বার সঙ্গে হাত মেলাতে বিদিশার হাত কাঁপছিল ।
বিদিশা বলল,তোমাকে হ্যাটস অফ ,অত বড় কাজের জন্য।
অম্বা হাসল।
বিদিশা অম্বার সঙ্গে সেলফি তুলল,নয়নাকেও ডাকল কিন্তু নয়না কেমন যেন ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল। কি ব্যাপার? হঠাৎ কি হল মেয়েটার? বিদিশা মনে মনে ভাবল,যাক গে পরে জিগ্যেস করব।
সরি মা । আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আসলে আমার তখন ওই মেয়েটার উপর খুব হিংসে হচ্ছিল।
কেন? বিদিশা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল।
মা সিংহটাতো পেটের দায়ে ওদের উপর হামলা করেছিল,কোন অন্যায় তো করেনি।
মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?
আমরা যারা রোজ বাসে, ট্রেনে কলেজে যাই । প্রতিদিন কত পশুর লোভের শিকার হতে হয় আমাদের। কখনো চোখ দিয়ে ,কখনো নখ দিয়ে আমাদের শরীরটাকে ওরা ছিন্ন ভিন্ন করে। ফাঁকা রাস্তায় দিনের বেলাতেও ভয় করে।
বিদিশা বুঝতে পারছে না কী উত্তর দেবে মেয়েকে? মা দুর্গার মত হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বলবে, না সর্বংসহা বসুন্ধরার মত সহ্য করতে বলবে। শুধু আরো নিবিড় করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরল।