আমি তনিমা হাজরা। লিখি কবিতা, গল্প, অনুগল্প, মুক্তগদ্য, প্রবন্ধ।
মায়ের স্বাদ মায়ের ভাষা
আমার পিসিমণিকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আচ্ছা, তুমি সবসময় লালপাড় সাদা শাড়িই পরো কেন বলোতো?পিসিমণির বয়স তখন বছর চল্লিশ হবে।সালটা ১৯৭৬-৭৭ বোধহয়। পিসিমণি উত্তরে বলেছিল, আমার ছেলে বলে, মা তোমাকে লালপাড় সাদা শাড়িতে সবচেয়ে বেশি মা মা লাগে তাই।
আমার ছেলে গতবছর পূজোয় আমাকে কেপ্রি আর টপ কিনে দিয়েছিল। কিছুদিন আগে বিদেশ বেড়াতে গিয়ে আমার জন্য লংস্কার্ট আর জিপসী ড্রেস কিনে নিয়ে এসেছে। তার ধারণা ঐ বেশভূষায় আমাকে খুব ভালো লাগবে। আবার সেই ২৮ বছরের শিশুই ফোন করে সেদিন বল্ল, মা তুমি ছোটবেলায় মাথায় হাত বুলিয়ে যে হারাধনের দশটি ছেলে আর অন্য আরো ঘুমপাড়ানি গানগুলো গাইতে সেইসব একজ্যাক্ট সুরে গেয়ে তার একটা রেকডিং করে পাঠাও তো। সেবার আমার কাছে এসে তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে ওগুলো গেয়েছিলে। শুনলে খুব স্ট্রেস ফ্রি লাগে।
না,না, যদিও পঞ্চাশ পেরিয়েছি কিছুদিন আগে তবুও এখনো এমন ভীমরতি হয়নি যে আমি ভরদুপুরবেলায় আপনাদের ডেকে ডেকে মেয়েলি গালগল্প শোনাবো।
উপরের দুটো কাহিনীর মধ্যে সময়ের ফারাক বছর চল্লিশ। এই সময়ের মধ্যে আমাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বহুল পরিবর্তন ঘটেছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং জীবনবোধসংক্রান্ত দর্শনের ক্ষেত্রে।
কিন্তু জীবনের যা মূল সুর, মূল সত্য তা কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতেই কিছুতেই বদলায় না। তা হল নিজের একান্ত স্বচ্ছন্দ আবেগ, নিভৃত অনুভূতির নিরাপদ আশ্রয়।।
মা মানে একটা অনুভূতি। কারো কাছে সেটা চোখের ক্যানভাসে আঁকা, কারো কাছে সেটা মনের জানালায় শীতল বাতাসের ঝাপটার মতো। যে চিরন্তন সত্যের স্বাদকে অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই।
মা হলো আপনার প্রথম আশ্রয়, প্রথম বিশ্বস্ত মানুষ, প্রথম ভালোবাসা। তিনি যে ভাষাতে আপনাকে প্রথম আদর করেছেন, যে শিক্ষার বীজ বুনে দিয়েছেন আপনার মননে, জীবন দর্শনে, আপনার বোধের ভেতর আপনার জ্ঞানের আদিবীজ কিন্তু সেটাই। সেখান থেকেই আপনার মানসিক গঠনের সাবেক কাঠামোটি তৈরি হয়ে গেছে।
তাঁর ভাষাতেই আপনি উচ্চারণ করেছেন জীবনের প্রথম শব্দটি। কী স্বর্গীয় অনুভূতি একবার ভাবুন। আপনার মনে নেই সেই শব্দ অথচ সেটাই আপনার অঙ্কুরিত মূল শিকড়। আপনার মাতৃভাষা।।
আপনার একান্ত আবেগের, একান্ত নিরাময়ের,একান্ত ভালোলাগার বর্ণমালা দিয়ে তৈরি এক আনন্দময় আলোর শব্দভাণ্ডার।।
আপনার জীবনের শস্যভান্ডারে জমিয়ে রাখা এক দুর্মূল্য, দুস্প্রাপ্য শস্যবীজ।।
এবার কি ইচ্ছে করছে না তাকে সস্নেহে রক্ষণ করতে??
ভাষাও কী আর এক আছে চিরদিন? সেও তো অভিযোজন আর অভিব্যক্তির হাত ধরে ক্রমাগত বদলেই চলেছে। আগেরকার লেখার সাধুভাষা, কথ্য কর্কশ শব্দ বিবিধ তৎসম, তদ্ভব এবং বিদেশি শব্দকে বর্ণমালায় জারিত ও লালিত করে ভাষা নিত্যনতুন শব্দভান্ডারে সমৃদ্ধ হয়েই চলেছে রোজ।
মা যেমন শাড়ি ছেড়ে জিন্স কিংবা সালোয়ার কামিজ পরে যুগোপযোগী বা কার্যপযোগী হয়েছেন কিন্তু তাঁর স্নেহের স্পর্শ, স্নেহের দায়দায়িত্ব বদলেছে কি একটুও? একই তো থেকে গেছে। তেমনি ভাষাও। তার মধ্যে নিজ প্রদেশের নিজস্ব মাটির স্বাদ, নিজস্ব সংস্কৃতির আমেজ, নিজের অস্তিত্বের বর্ণচ্ছটা।।
সেই বীজকে হারিয়ে ফেলবেন না। আর্থসামাজিক প্রয়োজনে দেশের বাইরে পা রাখতে হবে, জীবন ও জীবিকার বাস্তব প্রয়োজনে অন্য ভাষাকে শিখতে হবে কিন্তু নিজের বীজমন্ত্রটি নিজের সন্তানের মনের জমিতে রোপণ করার দায়িত্ব কিন্তু মা হিসেবে একান্ত আপনারই।।
এই অধিকার কারো কাছ থেকে নিজেও কেড়ে নেবেন না আর কাউকে আপনার কাছ থেকেও কেড়ে নিতে দেবেন না।।
এই কৃষিকাজে একবার অবহেলা করলে তার মাসুল কিন্তু সারাজীবন দিতে হবে আপনাকেই।