ছাদের এক কোণে পেটে দু-হাত চাপা দিয়ে ছ-সাত বছরের ছেলেটি বসে আছে। তার বাবা আর কাকার মৃতহে উঠোনে চাপ চাপ রক্তের মধ্যে পড়ে। ডাকাতির সাফল্যে উজ্জীবিত ওপার থেকে আসা ডাকাতরা আনন্দে ধর্ষন করে ফেলে রেখে গেছে ছেলেটির মা, কাকিমা আর দিদিকে। রিক্সোভ্যানে তাদের নিয়ে যাওয়া
হয়েছে করিমপুরের হাসপাতালে। গ্রামের নাম হোগলবেড়িয়া। বাংলাদেশের সীমান্ত খুব কাছে। সময়টা সম্ভবত ১৯৮৮-৮৯ সাল। তখনো কাঁটাতারের বেড়া বসেনি। অনুপ্রবেশ আর অপরাধের এক খোলা মেলা মুক্তাঞ্চল।
বসে থাকা ছেলেটি কিন্তু পেটে ডাকাতের গুলি নিয়ে মারা গেছে দশ ঘণ্টা আগেই। মোটা কাঠের গুঁড়ির ধাক্কায় যখন দরজা ভেঙে পড়েছে, তখন ঘুম থেকে তাকে তুলে সিঁড়ির মুখে পৌঁছে দিয়ে ছেলেটিকে তার বাবা বলেছিল ছাদে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে। ছেলেটি শুনেছিল। শুধু নীচ থেকে মায়ের আর্ত চিৎকার শুনে ছাদ থেকে ঝুঁকে যখন সে দেখে জনা চারেক লোক ঠাকুর ঘরে লুকিয়ে থাকা মাকে টেনে বের করে নিয়ে যাচ্ছে, সে চিৎকার করেছিল। মুহূর্তে একটি মর্মন্তদ গুলি ঢুকে যায় তার পেটে। পেট চেপে সে ছাদের কোনায় লুকিয়ে পড়েছিল। আর এই অবস্থাতেই নিঃশব্দে মারা যায়। করিমপুরে ডাকাতি যখন হতো, আর সেসব ছিল এক কল্পনাহীন একঘেয়েমির পুনরাবৃত্ত ধরণ। দরজা ভেঙে ঢোকা। প্রথমেই বাড়ির পুরুষদের মেরে ফেলা। তারপর লুঠতরাজ। গোরু মোষ গুলো ওপারে পৌঁছে দেওয়া সুনিশ্চিত করে ‘এবার আসি’ বলে সহাস্যে বিদায় নেবার মতো বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণ।
এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আভ্যন্তরীণ বিপর্যয় মোকাবিলাগুলিও ছিল একইরখম কল্পনাহীন, একঘেয়ে। দলের কোন কর্মী ওপারের ডাকাতের সাহায্যে এগিয়ে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে থানায় ফোন যেত অপরাধীকে ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিয়ে। ফোনে কাজ না হলে লেটার হেডে চিঠি পাঠানো হতো। সেই চিঠির বাহক প্রায়ই নিষ্ঠার সঙ্গে তার ফটো কপি রেখে দিত কাছে।
হোগলবেড়িয়ার সেইদিনটিতে বিডিওর সাথে গাড়িতে বিধায়ক ঘটনাস্থলে পৌঁছলে তাঁরই দলের উত্তেজিত সাপোর্টাররা তাকে কাদায় চুবিয়ে তুলে এনে থানায় পাঠানো তার ভালবাসার চিঠিগুলির জেরক্স তাঁকে দেখায়। অদম্য বিধায়ক এমনকি তখনও তাঁদের তৃতীয় শক্তির চক্রান্তর কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। খুবই কুন্ঠার সঙ্গে, মার্জিত ভঙ্গিতে তাঁকে তখন চপেটাঘাত করেছিল কেউ, এবং, সম্ভবত, অনুতপ্ত হয়েছিল তারপর।
উঠোনে পড়েছিল ছেলেটির দেহ। চেককাটা শার্ট আর হাপ প্যান্ট রক্তে চুপচুপে ভেজা। সব রক্ত বেরিয়ে যাবার পর ছেলেটির ফ্যাকাসে হলদে গায়ের রঙ থেকে শরৎকালের সূর্য চোখে ফেরাতে পারছে না। পরতে পরতে পাগলের মতো মাখিয়ে দিচ্ছে হলুদ আভা। কয়েকজন মহিলা চাপা গলায় কাঁদছেন ছেলেটিকে ঘিরে
অনেক বছর আগে মাদুরে শুয়ে থাকা হাড় জিরজিরে ছেলেটির গায়ে থকথকে রঙ মাখিয়ে দিতে দিতে কাঁদছিল যারা, ত্রিশ বছর আগে তারা কি এই দৃশ্যেরই চূড়ান্ত মহড়া দিচ্ছিল সেদিন? নাকি এই দৃশ্যটি সেই আগের ঘটনার কোনো পুনরাভিনয়?আমি জানি না।
৪|
পাঁচ বছরের মেয়েটির বাবা গলায় ফাঁস দিয়ে মেরেছিল তার মাকে। অথবা অন্যভাবে মেরে একটা আত্মহত্যার আলগা শ্রী দিতে চেয়েছিল তার হত্যাকে। মেয়েটি জানতো তার বাবা মাঝে মাঝেই অত্যাচার করে, মারে তার মাকে। এই সময় গুলো সে কানে হাত চেপেদিয়ে লুকিয়ে পড়তো পাশের ঘরে। বছর দুয়েক বড়ো দাদা সাথে সাথে দুজনের আর্ত চিৎকার শোনা যেত সেই বাড়ি থেকে- “মা মরে যাবে! মেরে ফেলেছে মাকে!” বছর চল্লিশ আগে মানুষ তখনও গুটি পোকার মতো আত্মবন্দীর জীবনে চলে যায়নি। প্রতিবাদ করতো না কেউ তবু। শুধু জেনে রাখত।
আমার বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বাড়ি ছিল ওদের। হত্যার অপরাধে বাবা জেলখানায়। পিসি আর কাকা জামিনে ছাড়া পেয়েছে। পাশের বাড়ির একটা ছেলে তার সাইকেলে বসিয়ে কাছাকাছি বেড়িয়ে নিয়ে আসত মেয়েটিকে। কেউ মেয়েটিকে ডাকলে, নিয়ে যেত তাদের বাড়ি। মেয়েটি যাতে খেতে পারে কিছুক্ষন। মায়ের কথা কখনও বলত না। কাঁদত না কখনও। শুধু ইটের টুকরো দিয়ে লাল রঙের মেঝেয় আঁকতো ফাঁসির দড়ি, পুলিশ, মা ঝুলছে, মাকে মাটিতে শোয়ানো হয়েছে।
এর প্রায় বছর ত্রিশ পরে মেয়েটির দাদা পাগলাগারদে ঠিকানা পেল। বাবা মারা গেছে অনেক আগেই। বাড়ির একটা অংশ ভাড়া দিয়ে সেই টাকায় মেয়েটি নিজের সংস্থান করে। খুব কম বেরোত বাড়ি থেকে। যেচে কথা বলত না কিন্তু কেউ কথা বললে স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিত। রাস্তার একটা কুকুরকে চেন বেঁধে পুষত ওরা। কালো স্যান্ডো গেঞ্জি আর মাথায় নাবিকের টুপি পরে চেন বাঁধা কুকুরকে নিয়ে হাঁটতে বেরোত ছেলেটি। রাত্রে মাঝে মাঝে আর্ত-চিৎকার করতো কুকুরটা, আর মারতে মারতে তাকে শাসাতো ছেলেটি। আর এই আত্মপ্রতিষ্ঠার সময় নিজেকে তার নির্জ্ঞানে সে বদলে নিত তার বাবার প্রতিরুপে। ঘোরের মধ্যে নিজেকে সে পরিচিত করতো তার বাবার নামে। “আমি চাইছি, তাই তোকে মারতে হবে” – এটা বলার সময় সে নিজের নামের বদলে চিৎকার করে বলত তার মৃত বাবার নাম। পাগলা গারদে যাবার সময় সে চিৎকার করেছিল কুকুরটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। বলেছিল মাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। তার চিৎকারে কান দেয়নি কেউ, স্বাভাবিক ভাবেই।
এবার থেকে অশক্ত বুড়ো কুকুরটাকে নিয়ে বাড়িতে একাই থাকে মেয়েটি। বাইরে বেরোনো কমে গেল আরো। মান্সিক হাসপাতালে মাঝে মাঝে দেখতে যায় দাদাকে। একটু বাজার হাটে বেরোয়। ব্যাস্ এরপর একদিন মারা গেল অনেকদিনের সঙ্গী কুকুরটাও। স্তব্ধ একটা বাড়ি, যেখানে পিঁপড়ের পায়ের শব্দও শোনা যায়, তাকে ডেকে নিল লুকোচুরি খেলার সঙ্গী হতে। ২০১৮ এর মার্চ মাস। পুলিশের গাড়ি এল সকালে। চাপ দিয়ে দরজা খুলে পলিথিন শিটে জড়িয়ে দিন চারেক আগে মরে যাওয়া মেয়েটির ইঁদুরে ঠোকরানো শরীর তুলে নিয়ে গেল মর্গে।
৫|
১৯৭৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে বছর তেইশের ঝকঝকে তরুণী অরুনা যখন মুম্বাইয়ের কেইএম হাসপাতালে নাইট ডিউটি করছিলেন তখন সাফাইকর্মী মোহ্নলাল বাল্মীকি টেনে নিয়ে যায় তাঁকে দূরের পরিতক্ত গুদামঘরে। কুকুর বাঁধার চেন এমন শক্ত করে বাঁধা হয় অরুণার গলায় যাতে কোনরখম চিৎকার না করতে পারেন তিনি। তারপর রাতভর পৈশাচিক অত্যাচার চলে অরুণার ওপর। গলার মাংস কেটে ঢুকে যাওয়া চেন আর মুখে মাথায় উপর্যুপরি আঘাতে চোখের দৃষ্টি আর মুখের ভাষা সম্পূর্ন হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। মূক, অন্ধ, পক্ষাঘাতগ্রস্ত অরুণার ঠিকানা তখন থেকেই সেই কেইএম হাসপাতালের তিন বাই ছয় ফুটের একটি বিছানা। ৩৬বছর ধরে কোমায় আচ্ছন্ন অরুণা। চোখ মেলে তাকাতে পারেন না, কোনো সাড় নেই হাত পায়ে। কিন্তু ইনজেকশন দেবার সময় তাঁর ত্বক অস্থির হয়ে ওঠে। তীব্র যন্ত্রণা তাঁর সচেতন শরীরের একমাত্র সঙ্গী। আর আছে বাল্যবন্ধু পিংকি ভিয়ানি, যে ছত্রিশ বছর ধরে প্রতিমুহূর্তে বন্ধুর পাশে থেকে নিজেকে নিঃশেষে মুছে দিচ্ছে।
ঘোরের মধ্যে বন্ধুর হাতে আঙুলের স্পর্শ পাঠিয়ে অরুণা মৃত্যু চেয়েছিল। পিংকি ভিরানি সেইমত অরুণার হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানিয়েছিলেন শীর্ষ আদালত। হাসপাতালে জোর করে খাবার খাওয়ানো বন্ধ করতে বলেছিলেন যাতে মৃত্যু দ্রুত আসে। তাঁর বেঁচে থাকা ছিল গলা অর্ধেক ছিন্ন কোনো পশুর অস্তিত্বের মতো করুণ। কোনদিনই তিনি আর সুস্থ হবেন না। ছত্রিশ বছরের টানা কোমাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যেই মরতে হবে তাঁকে। কিন্তু যান্ত্রিক বিচার ব্যাবস্থা মনে করে মানুষের কষ্ট যত অবর্ণনীয়ই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই তাকে মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া যায় না। ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯ এই মর্মে সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ডিভিশন বেঞ্চ।
আর ধর্ষক সেই সাফাইকর্মী মাত্র সাত বছর কারাবাসের মেয়াদের পর মুক্তি পেয়ে যায়।
একজন ভিয়াইপি অপরাধী হিসাবে যতরকম সুবিধে পাওয়া যায় সব পেয়েছে সে। কারণে অকারণে দীর্ঘদিন হাসপাতালে আর জেলখানার নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়ে এখন সে চাকরি করেছে আরো দামী হাসপাতালে। যে কোনো অপরাধীর মতো সহজ, স্বাভাবিক, নিরুদ্বিগ্ন জীবন পেয়েছে সে।
৬|
তাপমান নেমে গেছে ছয় ডিগ্রিতে। টানা শৈত্যপ্রবাহ চলছে কদিন ধরে। কনকনে হাওয়া আর ঘন কুয়াশার ঝাপটা। তিনটে বাচ্চা দিয়েছে খাবারের জন্য আমাদের দরজায় রোজ দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটা। চোখ ফোটার দিনকয়েক পরেই গাড়িচাপা পড়ে মারা যায় একটা বাচ্চা। রাতে প্রচন্ড ঠাণ্ডায় কাঁদতো বাচ্চা দুটো। চট, ছেঁড়া বেডশিট আর বাতিল কম্বল দিয়ে ঢাকা দেওয়া একটা জায়গায় তাদের রাখার ব্যাবস্থা হলো। এক রাতে ঘুমের মধ্যে কানে এল বাচ্চা কুকুরের কান্নার শব্দ। জানালা খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। কিছু নেই । সকালে পুরসভার সাফাইকর্মী ড্রেন থেকে তুলে আনল বাচ্চাটাকে। তখনও প্রাণ আছে ছোট্ট শরীরটায়। একটা কাপড়ে মুড়ে রাখা হলো এক কোণে। একটা পাত্রে দুধ রাখা হলো। যদি বাঁচে। যদি খায়। অন্য বাচ্চাটা ডাকছিল ওকে। চেটে দিচ্ছিল। নিজের তাপ সঞ্চারিত করতে চাইছিল তার শরীরে। পাশের বাড়ির প্রাচীরে একটা বেরাল চুপচাপ দেখছিল সব। সামনে রাখা দুধ। তবু কোনো ভাবান্তর নেই তার মধ্যে খেল না সহজে পাওয়া দুধটুকু। হাতের কাজ শেষ করে সেই সাফাইকর্মী ফিরে এল এমন মুখ নিয়ে যেন কিছু একটা বেঁধে রেখেছে তাকে। তখন মারা গেছে সেই কুকুর ছানা। তখনও অন্য বাচ্চাটি একইভাবে জরিয়ে রেখেছে তাকে ডাকছে। বাড়ির সামনে থেকে একটু সরিয়ে রাস্তার পাশে দেয়াল ঘেঁষে রাখা হলো মরে যাওয়া বাচ্চাকে। কম্বলের বিছানাটাও নিয়ে আসা হলো অন্য বাচ্চাটার জন্য যে ঘুরে ঘুরে ওর কাছেই ফিরে আসছে। ডাকছে। চেটে দিচ্ছে নিঃসাড় মুখ। দুধে ভাত মেখে পাশে রেখেছি তার। ছুঁয়েও দেখেনি। বাইরে খেতে শেখেনি তো তখনও!
পরের দিন দেখলাম দুটো বাচ্চা যেন পরস্পরকে আদরে জড়িয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। সকালের কুয়াশা আরও দুর্ভেদ্য আর দুস্প্রাবেশ্য সেদিন। যেন মরে যাওয়া দুটো কুকুরের বাচ্চাকে আড়াল করে তার কোনো অপরাধকে ঢাকা দিতে চাইছে সে।
সবুজ খাতায় পাতার অদৃশ্য হাতে যে লিখে যায়, এই বাচ্চা কুকুরটাকে সে মনে রাখবে তার স্তব্ধ একাগ্র ভালবাসার জন্য। মনে রাখবে কোমায় বসবাস করা মেয়েটিকে, পেটে গুলি নিয়ে ছাদের কোণে বসে থাকা মৃত ছেলেটিকে। আরো কতো সত্যিকারের অর্জন আছে তার। মনে রাখবে সেসব কথাও।
শুধু বিজাতীয় ঘৃণায় আর তাচ্ছিল্যে সে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবে আমাদের। দেবে না?