ঘুম ছাড়া রুমার আর একটা প্রিয় কাজ আছে। মাথার খুসকি খোঁটা। মাথায় খুসকি দেখতে পেলে আপন পর ভুলে সেদিকে চিরুণি বাগিয়ে ধেয়ে যেতে ইচ্ছা করে। রাতে শোবার সময় বর কিংবা মেয়ের মাথায় খনন কার্য করা রুমার প্রিয় বিনোদন। সব চেয়ে ভালো জাতের খুসবি হল চাবড়া খুসকি। সদ্যজাতদের মাথায় দু-তিন পর থেকেই পাওয়া যায়। ঝুরো খসকির মতো সবটা ঝরে পড়ে না; চিরুণির দাঁড়ায় আটকে থাকে, হাতে করেও টানা ধরা যায়। বেশ কয়েকদিন শ্যাম্পু না করলে অতীনের মাথাতেও চাবড়া দেখা দেয়। সে খুঁটে কী সুখ, কাকে বোঝাবে?
মেয়েরা বোধহয় এই ধরণের খোঁটাখুঁটি অনেকেই পছন্দ করফে। রুমার মায়ে মতো অনেক মহিলাই যেমন কানের ময়লা খুঁটতে ভালো বাসেন। রুমারও মন্দ লাগে না। তবে কানের ময়লা যদি বাদামী আঠালো হয় তো ঘেন্না করে, কিন্তু ঝুরোঝুরো খুসকির মতো হলে মজা লাগে বইকি। এই ব্যাপারে আবার ওর প্রতিপক্ষ হয়ে দেখা দিচ্ছে কন্যা গুবলু রানী। নরম কচি হাতে বাবার মাথা টেনে এনে সেফটিপিন দিয়ে কুরকুর করলে খুব কাজ না থাকলে অতীনের চোখ আয়েশে বুঁজে আসে যদিও ভয়ও লাগে।
ডাব্লিউবিসিএস পরীক্ষার পড়া তৈরি করতে হোত মশারির মধ্যে বসে; না হলে একতলায় মশার কামড় শ্মশানে পাঠানোর পক্ষে যথেষ্ট। তাই শোবার ঘরে আলো জ্বেলে পড়াটা অন্তু মেনে নিয়েছিল সানন্দে। এমনিতেই তার বিছানায় দেহ আর বালিসে মাথা ঠেকলেই ঘুম টুক করে ওকে পেড়ে ফেলে। তার ওপর বৌ মাথায় হাত ছোঁয়ালে খারাপ তো লাগার কথা নয়। কিন্তু মাথায় দিনের পর দিন লাঙল চাষ হলে কাঁহাতক সহ্য হয়? একবার তো স্বপ্ন দেখেছিল পেরেক পোঁতা হচ্ছে সম্ভবত হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। প্রথম প্রথম মাথায় হাত দিয়ে আলতো চিরুণি চালনা করলে বেশ আরাম লাগে। কিন্তু লাগাতার একই জায়গায় ঘর্ষণ আর কতক্ষণ হর্ষ উৎপাদন করতে পারে? কোদাল, লাঙল, নিদেনপক্ষে পেরেকের তুলনা চলে আসে। একটা মোক্ষম আপার কাট জ্যাব ছুঁড়েছিল মাথার প্রতিবেশ অভিমুখে। সেটা গায়ে লাগলে চারশো আটানব্বই করার জন্য কেউ বেঁচেই থাকত না। ভয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে সরে এসে পড়ায় মন দিয়েছিল রুমা। তখন গুবলু হয়নি।
খোঁটার মতো আর কিছু ইন্টারেস্টিং জিনিস আছে। যেমন গায়ে কাটা ঘা সারার পর বা রক্তপাত শুকিয়ে যাওয়ার পর চামড়ায় মামড়ি ওঠে। সেটাও খুঁটে তুলতে বেশ লাগে। অনেক সময় নিজের গায়েও সামান্য মশার কামড়কে চুলকে চুলকে রক্তপাত করে ফেলে। সেটার ওপর মামড়ি পড়লে খুঁটে তোলে। আর সেটা ঠিক মতো না শুকোলে তুলতে গিয়ে ফের রক্তপাত ঘটে। সুতরাং আবার মামড়ি। তাছাড়া পায়ের গোড়ালির শক্ত চামড়া নখ দিয়ে খুঁটে তুলতেও ভালো লাগে। অনেক সময় কাঁচা চামড়া পর্যন্ত টান পড়ে যায়। জ্বালার সাথে রক্তপাতের উপক্রম ঘটে। তখন আর না টেনে নেলকাটার দিয়ে উদ্যত চামড়া কেটে ফেলতে হয়। এর পরে আসছে সেফটিপিন দিয়ে চিরুণির ময়লা খোঁটা। সবানজলে ভিজিয়ে রেখে পুরোন টথব্রাশ দিয়ে ঘষলেই চিরুণি সাফ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে খোঁটাখুঁটির সুখটা ফস্কায়।
খুব বেশি বিষাদের দিনগুলোয় এসব কাজও কারতে ইচ্ছা করে না। চিরুণি বাগিয়ে শিকার সন্ধান করা মানে রুমার মেজাজ ঠিক আছে। এই মাথা খুঁটে খঁটেই তো ও দিব্যি ডাব্লিউবিসিএস মূল লেখা পরীক্ষা পর্যন্ত উতরেছিল। সাক্ষাতকারের ডাক পেল নার্সিংহোমে পেট কাটা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে। বলতে গেলে নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই এগারো দিনের শিশুকে ননদের কোলে দিয়ে ননদাইয়ের গাড়ি করে পাণিহাটি থেকে মোদি আলি। তখন অস্ত্রোপচারের জন্য গোটা পেটটাই জ্বলত। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলেই নাভির নীচে চড়াক্ করে টান লাগত। তার ওপর, রুমার হয়েছিল বাটি ওপচানো দুধ। শ্বাশুড়ির দুধ সাবুর গুণ গাইতেই হয়। ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বারবার বাচ্চা কাঁদছে শুনে নীচে যেতে হয়েছে দুধ খাইয়ে আসতে। শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে সঙ্গে আনা চুষি-বোতলের মধ্যে দুধ গেলে আসতে হল। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ ছমাসের আগে বাইরের জল পর্যন্ত খাওয়ানো চলবে না।
সারা গায়ে চট্চটে আস্বস্তি নিয়ে একটু কুঁজো হয়ে বসে হাসিমুখে সাক্ষাতকার দিয়েছিল। কিন্তু হল না, শেষ রক্ষা হল না। বরের মাথায় জ্বালা ধরিয়ে, আলো জ্বেলে রেখে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েও শেষ পর্যন্ত ফলাফল শূন্য হয়ে গিয়েছিল। বোধহয় ইন্টারভিউ বোর্ডের সদস্যদের বোঝাতে পারেনি, পেটে মেজর সিজারিয়ান অপারাশনের যন্ত্রণা আর কোলে সাত দিনের বাচ্চা নিয়ে যে মহিলা অতটা রাস্তা আসতে পারে পরীক্ষা দিতে, তার স্বনির্ভরতার তাগিদ কতটা এবং সে যে কোনও চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত। তাদের চোখে আবেদনকারীর সাময়িক বেহাল অবস্থাটাই প্রাধান্য পেয়েছিল। হয়তো ভেবেছিল মহিলা পরের বছর একটু শক্তপোক্ত হলে কাজে যোগদানের উপযুক্ত হবে। কিন্তু তার জন্য প্রথম বারের ফলাফল বেরোনোর আগে থাকতেই পড়াশুনো শুরু করতে হয়, যেটা গর্ভিণী রুমা শরীরে আনচানানি নিয়ে আর পারেনি।