“শুধু শুরু হল বললেই হবেনা নন্দিনী, স্বাদ পেলাম এক নতুন এক্সপেরিমেন্টের। আমার দেখা লালুদা এই প্রথম জোনাল একটিং গেলেন, এই নাটকের কতগুলো ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য ছিল, যেমন ভিক্ষাজীবি হরিপদ আর ছেলে, সমীরণ এই নাটকের প্রোটাগনিস্ট বলতে পারো, শিল্পপতি রায়সাহেবের অফিস, সম্ভ্রান্ত বার যেখানে মিলিত হত শহরের এলিট ক্লাসের লোক জন, আমরা নাটকে দেখতে পাই, একজন বিখ্যাত ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ার, লিডিং নিউজপেপারের ফোটোগ্রাফার, এক শিখ বিজনেশম্যান, রায়সাহেবের মেয়ে মন্দা, আর অনশন মঞ্চ। একটা স্টেজের মধ্যে এতগুলো জোন। কি অসাধারণ ব্যবহার করেছিলেন গোটা স্টেজটা। এই জিনিষ তোমরা হয়ত উৎপল দত্তের মধ্যে দেখছ ইউটিলাইজেশন অফ স্টেজ”।
“এর মধ্যে ফজল আলির ভূমিকা কোথায়?”
“তার ভূমিকা খুব বড় নয়, অথচ গোটা নাটকটা কিন্তু তাকে কেন্দ্র করে”।
“গল্পটা কি?”
“তুমি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসটা পড়নি, নাটকে যদিও কিছু পরিবর্তন করা হয়েছিল মূল বক্তব্যটা রেখেই। সমীরণ যাকে এই নাটকের প্রোটাগনিস্ট বলছি আমি, সে গ্রামের ছেলে, শরীর স্বাস্থ্য খুব ভাল মুখ চোখ একটু চোয়াড়ে টাইপে প্রথম দর্শণে দেখে ভাল লাগার কথা নয়। কলকাতায় এসেছে চাকরীর খোঁজে। স্বাস্থ্যই যখন তার সম্পদ, সুতরাং তার চাকরীও সেই অনুযায়ীই হবে, শিল্পপতি রায়সাহেবের বডিগার্ড হিসাবে চাকরী পেল। যে সময় এই উপন্যাস লেখা হয়েছে বাউন্সার কথাটা তখন চালু হয়নি, তাহলে শীর্ষেন্দুবাবু নিশ্চয়ই ব্যবহার করতেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে এই জন্যেই ভাল লাগে, এমন এমন বিষয় নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই নায়ক’কে দেখা যায় সে এত সাধারণ সাধারণ পাঠককেও নতুন করে ভাবতে হয় সেই চরিত্রটি সম্বন্ধে। অথচ এই ধরনের মানুষ কিন্তু রাস্তা ঘাটে বিস্তর ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের দিকে আমরা নজর দিইনা। সমীরণ অনেকটা সেইরকমই। চাকরীর প্রথমদিনে রায়সাহেব যেখানে বিফ্র (brief) করছেন তার কাজ সম্পর্কে সংলাপটি মনে রাখার মত- “ তোমার কাজ হবে রাস্তা ঘাটে বাজে লোকের দিকে নজর রাখা’। সমীরণ হচ্ছে এমনই একটা চরিত্র কোন সময় মাথাটা সে খাটায় না।তাই সে জিজ্ঞাসা করছে- “ বাজে লোক কিকরে চিনব স্যার”। রায় সাহেবের উত্তর “ খুব সহজ, কাজে আসবার আগে নিজের চেহারাটা আয়নায় ভালো করে দেখে আসবে কারণ তোমার মত চেহারাওলা লোকগুলোই রাস্তা ঘাটে সত্যিকারের বাজে লোক”। এটা হচ্ছে এমপ্লোয়ার আর এমপ্লয়ির তথাকথিত চিরন্তন সম্পর্ক। যাকে তিনি নিজের দেহরক্ষার কাজে নিযুক্ত করছেন তাঁর দৃষ্টিতে সেও ক্রিমিন্যাল গোত্রীয়। তাই তার জন্যে সার্বিক ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই পড়ে থাকেনা। দেখ নন্দিনী আমি এই কথাটা বোঝাতে এতগুলো কথা খরচ করলাম লেখক কিন্তু তা করেননি। একটি সংলাপের মধ্যে দিয়ে পুরোটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।
“তারপর”।
এই সমীরণ একদিন বৃষ্টির মধ্যে সামিয়ানা খাটানো আছে দেখে সেখানে ঢুকে পড়েছে, গিয়ে দেখে কারখানার শ্রমিকরা অনশন করছে, কারখানা বাঁচানো দাবীতে, হঠাৎই সেখানে সমীরণ তার গ্রামের একটি ছেলেকে দেখতে পায় ফজল আলি সেও অনশন করছে। আশ্চর্য হয়ে সে বলে ফজলু তুই গ্রামে ফিরে যা। উত্তরে সে জানায় সেখানেও তো অনশন সমীদা। এই ছোট্ট কথাটা কতখানি অর্থবহ। আবার সেই একটা শব্দের মধ্যে দিয়ে বলে দিলেন ফজল আলির সার্বিক অবস্থা কথা।অতিরিক্ত শব্দ খরচ করতে হল না। এটাই একজন বড় লেখকের গুণ।
দিন চলে যায় ফজল আলি অনশন করেই চলেছে তার অনশনের দুশো দিন পার হয়ে গেছে, সে অনুভব করছে না খেয়ে বেঁচে থাকা যায়, গাছের মতন। মাটিতে দাঁড়িয়ে গাছের শিকড়ের মতন রস সুষে নিতে হবে, সূর্যের দিকে হাত বাড়িয়ে ভিটামিন সংগ্রহ করতে হবে। সে যে শুধু নিজে ওই ভাবে বেঁচে থাকবে না তা নয় অন্যকেও শেখাবে এই কলাকৌশল। এ এক মস্ত সমাধান, খাওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে এক বিরাট ধাক্কা, কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে। সমীরণের চাকরী চলে গেছে । ফজল আলি বলছে আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব কি’করে না খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়।
“ম্যাজিক রিয়ালিটির এক দুর্দান্ত প্রয়োগ, মালিক আর শোষণ করতে পারবে না শ্রমিককে”।
“ ঠিক বলেছ নন্দিনী ফজল আলি আসছে মানে সমাধান আসছে। অনেক গুলি গান ছিল। বুবু মানে প্রকাশ মুখোপাধ্যায় আর শান্তনু গাইত। লালুদা এক ক্রিমিন্যাল ল’ইয়ারের চরিত্রে অভিনয় করতেন। সে আর এক দুর্দান্ত পারফরমেন্স। এর জন্যেই উনি দিশারী পুরষ্কার লাভ করেছিলেন।
“ফজল আলির কথা বলো”।
“আবার তাহলে নিজের কথাই বলতে হয়। খুব শক্ত অভিনয়, অনশনের দিন পার হয়ে যাচ্ছে, চেহারা পাল্টাচ্ছে, গলার স্বর পাল্টাচ্ছে। প্রতি সিনে আলাদা মেক আপ আলাদা কণ্ঠস্বর। যখন দুশো দিন পার হয়ে গেছে, সেই কন্ঠস্বর আমি আনতে পারছি না। চেষ্টা করছি, বুঝতে পারছি হচ্ছে না। একদিন রবিবার সকালে রিহার্শ্যাল হচ্ছে। ঐ দৃশ্যে কাশি এসে যাচ্ছে। লালুদা বললেন- তুমি নাকীসুরে খোনা গলায় কথা বলতে পারো। চেষ্টা করে দেখি। শুরু করলাম নিজেই বুঝতে পারছি কি অদ্ভুত পরিবর্তন। উচ্ছ্বসিত লালুদা এই তো হয়ে গেছে আর চিন্তা নেই। এই চরিত্র আমার জীবনের একটি মাইল ফলক। সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র তাঁরজন্যে । আমি আর বেশী কিছু বলব না নন্দিনী। গলা ধরে আসছে। শেষ দৃশ্যে আমার কঙ্কালসার চেহারায় ক্ষীণ মিনমিনে নাকীসুর যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলতেন মঞ্চে যেন এক প্রেতের আবির্ভাব ঘটছে,এটা সম্ভব হয়েছিল মেক আপ ম্যান রবিদার (রবি ঘোষ) কল্যাণে। কয়েক বছর আগে তিনিও পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর নন্দিনী যেটাই বলব সেটাই হবে আত্মপ্রচার।
চিত্তরঞ্জনের নাট্য প্রতিযোগিতার কথা বলতেই হয়।সারা রাত জেগে মোঘলসরাই প্যাসেঞ্জারে চিত্তরঞ্জন যাওয়া। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। খুব ভাল শো হয়েছিল। পুরস্কারও পেয়েছিলাম বেশ কয়েকটা। শুধু মাত্র প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম ভাগ্যের দোষে। ওখানকার একটি স্থানীয় দল মনোজ মিত্রের সাজানো বাগান অভিনয় করেছিল। মনোজ মিত্র যে চরিত্রটি অভিনয় করতেন ওখানকারই একজন নামী অভিনেতা সেই চরিত্রে অভিনয় করেন। বিচারকদের বিচারে আমার এবং তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ছিল এক । ফলে এই টাই ভাঙ্গতে ওই নাট্যপ্রতিযোগিতার কমিটির সেক্রেটারীর ভোটে স্থানীয় অভিনেতা প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। আমাকে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠও করা হয়না যেহেতু আমি প্রথম শ্রেষ্ঠ অভিনেতার প্রতিযোগিতায় নমিনেটেড ছিলাম। যখন আমাদের ফজল আলি আসছে নাটক চলছে তখন একই সঙ্গে সুন্দরম সাজানো বাগান’ও চলছে। মনোজ মিত্র একাধারে যেমন নাট্যকার আবার দুর্দান্ত অভিনেতাও বটে। এই সাজানো বাগান নাটকে যে উনি কি অভিনয় করেছিলেন নন্দিনী আমি বলে বোঝাতে পারব না।
“এটাই কি বাঞ্ছারামের বাগান নামে সিনেমা হয়েছিল”।
“হ্যাঁ। তোমরা সিনেমাটা দেখেছ, মনোজ মিত্র সেখানেও ভালো অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু নাটক না দেখলে বুঝতে পারবে না, কোন লেভেলে মঞ্চে ঐ চরিত্রে অভিনয় করতেন,উবু হয়ে বসে পিছন ঘসে ঘসে মঞ্চের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, আগাগোড়া সেকেন্ড ভয়েসে অভিনয়। কতখানি শারীরিক সক্ষমতা ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয় এই চরিত্র রূপদান করতে হলে। তবে ফিল্মে যাবার পর মনোজ মিত্র ম্যানেরিজিমের শিকার হয়ে গেলেন। পরবাস বা সাজানো বাগানের মনোজ মিত্রকে আর আমরা পেলাম না। তাঁকে সেভাবে ব্যবহারও করা হল না। সিনেমা যারা বানান তারা ব্যবসাটা বোঝেন শিল্প বোঝেন না। ওই আমার সিনেমায় সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল জমিদারের প্রেত্মাতার চরিত্রে দীপঙ্কর দে’র অভিনয়। যদিও সেটি উত্তমকুমারের কথা ছিল কিছুটা তাঁর দোষেই সেই সুযোগ হারিয়ে ছিলেন, উনি করলে হয়ত একটা মাইল স্টোন হত। যাইহোক যে জন্যে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম এসব ঘটনার অনেকদিন পরে আমি চাকরী করতে চলে গেছি। ফজল আলির শো’ও বন্ধ হয়ে গেছে , কোন এক অনুষ্ঠানে মনোজ মিত্রের সঙ্গে লালুদার একান্ত আলাপচারিতায়, মনোজ মিত্র বলেছিলেন ফজল আলি ওনাদের ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। কি অপূর্ব প্রোডাকশন আপনারা করেছিলেন। প্রথম কথা আমাদের টাকা ছিল না যে একের পর এক ক্ষতি স্বীকার করে নাটক চালিয়ে নিয়ে যাব। আর একাডেমীর ভাড়া বেশী বলে আমরা মুক্ত- অঙ্গনেই আটকে থাকলাম। ফলে সেভাবে স্বীকৃতি জুটল না, যা সাজানো বাগান পেল, আমরা পেলাম না।