এবং প্রাচ্যে যে ভাষা বৈচিত্র্য বৈজাত্যবোধ শিউরে উঠছে, সেই সেঁকুলে বিদ্ধ, অহমের পশ্চাদগামী মেঘ বানিয়ে ফেলেছে ইতিমধ্যেই নীহার। বাসন্তীবিলাপ আসে না তার, শুদ্ধোর্ধ ত্রিপল বিছানো চৌকো বারান্দা তার। একদিনের পর কাব্যি করার সাধ সাধন হয়ে উঠেছিল এখানেই। রবীন্দ্রপক্ষ থেকে নজরুলজয়ন্তী, সুভাষ থেকে স্বদেশ, বিনয় থেকে বৈকুণ্ঠে, আবার বঙ্কিম থেকে মহাশ্বেতা আস্তে আস্তে অর্থহীন রোজগেরে বানিয়ে তুলেছে তাকে। আজ নীহার একটা নাম, গতকাল সেটা স্বপ্নে দেখেছিল। আগামীকাল কোনো বোনেদি কৃষিজাত মদ্যপ হয়ে সিগারেট হাতে কফিহাউসে বা কোনো স্মৃতিমঞ্চে তার উড্ডীন আপদধর্ম পশ্চাৎপ্রদেশের রোগ ভুলিয়ে দেবে এ আশায় “শাহিভৃত্য” পত্রিকা বানায়নি সে। খোঁজ, লিটারেচার গার্গিল অনর্গল ঘড়ঘড় করতে পারে এরকম কিছুর খোঁজ নেচারাল দম ভরিয়ে দিয়েছে তার কর্নফ্লেক্স কলমে।
সুতরাং পত্রিকা করার সুবাদে টুকটাক পরিচিত হয়েছে নীহার এখন। একটু আত্মসম্মানও হয়েছে সেই সাথে নিজেকে আলাদা করার চেষ্টাও হয়েছে প্রবল। এতদমধ্যে এক কবি তথা প্রাবন্ধিক এসে আজ তার ত্রিপল চৌকে এসে উপস্থিত হয়েছেন। যেরকমটা হয় আর পাঁচটা ক্ষেত্রে এবারেও তার ব্যতিরেক রেখা আঁকা হয়নি। প্রথমেই নিজের মহত্ত্ব প্রচারের আদীম সুর ভেঁজে শুরু করলেন –” নীহার নামটাও একটা পত্রিকার নাম হতে পারতো কী বলো নীহার?” অন্যদের ছোট করার এই সুলভ টেকনিক নীহারের খুব চেনা, ইতিমধ্যে তার অভিজ্ঞতাও কম হয়নি সুতরাং সে মুচকি হেসে কথায় মিছরি মিশিয়ে উত্তর করল — “আমি তো ভেবেছিলাম আপনার ‘টেঙরি বিভ্রাট’ দিয়েই নামকরণ করবো, কিন্তু অনেকের ইচ্ছাতেই এই নামটিতেই থিতু হয়েছি। ভদ্রজনের চোখ কপালে তখন। তাঁর সদ্য বের হওয়া শ’এর অধিক বিক্রিত বইয়ের এরূপ পাঠকও আছে যে তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।সুতরাং আপাতত ওই প্রসঙ্গ ছেড়ে ভদ্রজন কিছু জলোযোগ সেরে নিজের কিছু কবিতা নীহারের কাছে রেখে (পত্রিকায় প্রকাশের উদ্দেশ্যে) বেরিয়ে পড়লেন। যাওয়ার সময় সহজে নাম কেনার কিছু সহজ পন্থা বাতলে গেলেন।
ভদ্রজন অদৃশ্য হওয়ার আগেই নীহার ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিল। তার অনেক স্বপ্নদোষ পেরিয়ে এই পত্রিকার স্বঘোষিত সম্রাট হয়েছে সে, কোনো মূল্যেই একে বাজারী করতে পারবে না সে। এই ভেবে কোন দূরত্ব যেন তাকে গ্রাস করে নিল।
বহু পরিশ্রম আগলে সে একটি মুদ্রিত পত্রিকা চালায় ডিজিটাল যুগেও। কত নিন্দা, কাঠিন্য, আলোচনা আলোচক পেরিয়ে তার বাড়ি। কিছু সন্ধ্যায় নিজের বাড়ির পথ ভুলে গিয়েছে সে, বেহাল হয়েও হাল ছাড়েনি। ইউনিক দিনতাপ, ঝোড়ো পলিথিন, হারানো উত্তাপ, সেক্স, ক্রোমোজোম, শুক্রাণু, গর্ভাশয়ে লুকিয়ে রাখবে বলেই নাম দিয়েছিল ‘শাহিভৃত্য’। না চেনা যারা তাদের তুলে আনাই তার কাজ। এর ব্যতিক্রম হবে না। চেষ্টাও চালিয়েছে সে অনেক। সফলতা বিফলতা সব দেখেছে সে, জীবনের চতুরঙ্গসেনা তার যৌনশহরে ভাসে। গ্রহরা যেমন।
এভাবে কেটে গিয়েছে প্রায় ত্রিশটা বছর। নীহার বৃদ্ধ হয়েছে এখন। অনেক স্মৃতি আগলে রেখেছে সে, কিন্তু “শাহিভৃত্য” হয় না আর। একদিন আনকোরা লেখকদের তীর্থভূমি ছিল যেটা তার নামও নেয় না অনেকে। এখন নীহারের খোঁজ রাখে না আর বিশেষ কেউই। সেদিনের যৌনতা সময়ের সাথে যেভাবে ফিকে হয়েছে বুঝতে পারে নীহার, এভাবে অনেক অনেক কবি, লেখক, পত্রিকা হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে,যাবেও। সে এসব ভাবে আর গ্যাবড়ানো খাতায় আরো কিছু আঁকিবুঁকি কাটে। তার সিক্ত চোখ ফ্যালফ্যাল
করে দেখে এই নিরস যান্ত্রিক মানুষগুলিকে। সেই হার না মানা উদ্দাম, নীহার আজ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। ভাবতে ভাবতে তার মুখ দিয়ে খুব সযত্নে মৃদুস্বরে কয়েকটা কথা বেরিয়ে এল —
” আমি কী একায় যে হারিয়ে যাচ্ছি, নাকি আমার সাথেই সবার অলক্ষ্যে হারিয়ে যাচ্ছে সাহিত্য মানুষের জীবন থেকে?”