• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮৯)

পর্ব – ৮৯

৮৮

একটা ভাঙা দেবদেউল দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে বিরাট বটগাছ। অজস্র পাখ পাখালি ঘরে ফিরছে। শ‍্যামলীর মনে পড়ল সেই কবিতার পংক্তি, বকের পাখায় আলোক লুকায়। যে পাখিরা এর মধ‍্যেই ফিরে এসেছে, তারা বকবক শুরু করেছে। ডানা ঝেড়ে ফেলে নিজেকে রাতের বিশ্রামের জন‍্য প্রস্তুত করছে। ভোরে সূর্যের সারথি অরুণ দেখা দেবার সময়ে ওরা ঘুম ভেঙে উঠবে। ততক্ষণ নিশ্চিন্ত নিরপরাধ ঘুম। মায়ের কথা মনে এল। মা রাতে ঘুমাতে পারে না। সংসারের অজস্র দুশ্চিন্তা তাঁর কাঁধে। অনসূয়াদি বললেন, শ‍্যামলী ওই দ‍্যাখ আমাদের বাড়ি। শ‍্যামলী দেখল একটা পুরোনো দিনের বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোনো জানালায় আলো নেই। মাথার উপর দিয়ে দুটো বিশাল ডানা ওয়ালা বাদুড় উড়ে গেল। বাদুড় বেশ নিরীহ জীব। ফল খায়। আর যাই খাক, বাদুড় যে মানুষের রক্ত চোষে না এটা ঘটনা। একটা স্তন‍্যপায়ী প্রাণী বাদুড়। পাতলা চামড়ার ডানাওয়ালা ইঁদুরের মতো। তাকে নিয়ে কি রকম গল্প বানিয়ে রেখেছে। ওইরকম একটা পুরোনো বাড়ির একটা সুড়ঙ্গের ভিতর একটা কালো কফিন। কফিন খুলে ড্রাকুলা বের হবেন শিকার ধরতে। সুশ্রী সুবেশা তন্বী বরাঙ্গিনীদের কণ্ঠলগ্ন হতে ভালবাসেন ড্রাকুলা। তারপর গলায় দাঁত বসিয়ে রক্তপান। আচ্ছা, অনসূয়াদি কি ভাবছে যে শ‍্যামলী রামনারায়ণের ফাঁদে জড়িয়ে যাবে?
অনসূয়া বললেন, এইটা ব্রাহ্মণ পাড়া। এখানে অনেকেই আমাদের জ্ঞাতি। অনেক পুরুষ আগে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।  শ‍্যামলী শুনেছে, সাতপুরুষ অবধি অশৌচ গ্রহণ চলে। কেউ মারা গেলে অশৌচ। কেউ জন্মালেও অশৌচ। একটা বড়ো পরিবারের সবাই মিলে যদি একটা পাড়ায় শ’ তিনেক বছর থেকে যায়, তাহলে অশৌচ আর কাটবে না। একটা অশৌচ যদি দশদিনের মেয়াদের‌ও হয়, তাহলেও একটা অশৌচ পর্ব শেষ হতে না হতে আরেকটা অশৌচ এসে পড়বে। ভাগ‍্যিস মানুষের স্বভাব ছড়িয়ে পড়া। এই জঙ্গমতা যদি মানবসমাজের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য না হত, তাহলে কি বিশ্রী একটা পরিস্থিতি হত!
 হঠাৎ শরৎসাহিত‍্য মনে পড়ে গেল শ‍্যামলীর। বামুনের মেয়ে। বামুনেরা কতটা বামুন, তার একটা হিসাব তুলে ধরেছেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পল্লীসমাজ মনে পড়ল। বেণী ঘোষাল কিভাবে চরিত্রের বদনাম রটিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে রমা মুখোপাধ্যায়কে ব্ল‍্যাকমেল করে যেতে থাকে। আর কিভাবে বামুনের পরিবারের ভরযুবতী বিধবার গর্ভপাত ক‍রানো হয়। তারপর বিষবৃক্ষ মনে পড়ে শ‍্যামলীর। আরেকজন চাটুজ‍্যে বামুনের লেখা। ভরযুবতীরা নদীতে স্নান করছে আর পূজারী বামুনেরা চোখ বুজে পূজা করতে করতে তাদেরকে একটু একটু দেখে কামপিপাসা মেটাচ্ছে। দর্শকাম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রসিকতার তুলনা নেই। রসিকতার মধ‍্য দিয়ে ভণ্ডামির মুখোশ খুলতেন। মনে পড়ল হরবল্লভকে। প্রফুল্লর শ্বশুর। জাহাজ যখন ডুবেই গিয়েছে, তখন  দুর্গানাম জপ করে আর কি হবে!
অনসূয়া দি বললেন, চ, দুর্গা দালানে সবাই জড়ো হয়েছে। এবার সেখানে যাই। এবাড়িতে পুজোর প্রতিমা ভারি অদ্ভুত। গ্রাম‍্য ঘরোয়া মাতৃমূর্তিতে জগজ্জননী। তাঁর মাত্র দুটি হাত। আর কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই। সিংহ‌ও নেই। সন্তানসহ মা হাজির। কোনো হিংসা নেই, শত্রুতা নেই, কিলার ইনসটিঙ্কটের বালাই নেই। আছে শুধু স্নেহ আর ভালবাসা। দুর্গা প্রতিমার দিকে অবাক হয়ে শ‍্যামলীকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অনসূয়া বললেন, এখানে এক সাধু থাকতেন। তিনি এ রকম দেবীমূর্তির স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। এখানে পশুবলি হয় না। চালকুমড়া বলি হয়। রক্ত পাত নেই এই পূজায়।
প্রতিমাকে সাক্ষী করে গ্রামের প্রবীণা মহিলাদের হাতে একটা দুটো করে শাড়ি তুলে দিতে থাকেন অনসূয়া। তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করেন। কেউ কেউ বলেন ওরে ঠাকুরের সামনে কোনো মানুষকে প্রণাম করতে নেই। অনসূয়া বলেন, তোমরাই আমার ঠাকুর।
শ‍্যামলী মনশ্চক্ষে দেখতে পায় বাংলাভূমির সবসেরা বামুনটিকে।  যিনি  তরুণী যুবতী বিধবাদের বিয়ে দিতে প্রাণপণ করেছিলেন। বলেছেন, আমার ভগবান আছে মাটির পৃথিবীতে। সে প্রণাম করে না। খাড়া দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে প্রণাম করে সেই সব যুগন্ধর সাহিত্যিকদের। দেবীর পশ্চাতে ওঁরাও এসে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, বলছেন, অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করতে জাগো, জাগো ধরার ছেলে মেয়ে জাগো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *