• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮৭)

পর্ব – ৮৭

৮৬

অনসূয়া বললেন, শশাঙ্কবাবু, আপনাকে একটি অপ্রীতিকর কথা আমায় বলতেই হচ্ছে। শ‍্যামলী যদিও আমাকে এই বিষয়ে একেবারেই জানায় নি, আর আমি জানি যে ও আমায় এটা নিয়ে বলতেও চাইবে না, তবু, আমি একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে, একজন আইনজীবী হিসেবে আপনার বাড়িতে শ‍্যামলীর উপর মারধোর বিষয়ে বলতে চাই। শ‍্যামলীর শারীরিক সুরক্ষা যদি আপনার বাড়িতে নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে ওকে আমায় দিন। আমি যত্ন করে ওকে লেখাপড়ার সব কিছু ব‍্যবস্থা করব।
শ‍্যামলী বলে উঠল, না দিদি, এভাবে লেজ গুটিয়ে আমি পালাব না।
সঙ্গে সঙ্গে সবিতা বলে উঠল, দেখেছ তো, আমাদের মেয়েও চায় না, তুমি আমাদের বাড়ির ব‍্যাপারে নাক গলাও।
অনসূয়া সবিতাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে শশাঙ্কবাবুকে বলল, বাড়ির ব‍্যাপার লেবেল দিয়ে একটা অত‍্যাচারের ঘটনাকে আড়াল করা যায় না। সন্তান মা বাবার সম্পত্তি নয়। সন্তানকে দেখাশুনা ও বিকাশে সব রকম সাহায্য করা মা বাবার কর্তব্য। কিন্তু সন্তানের প্রাণসংশয় হতে পারে জেনেও যে বাবা মা ব‍্যবস্থা নিতে পারেন না, তখন আর পাঁচজনের মাথা ঘামানোর দায় এসে যায় বৈকি!
বাসন্তীবালা বললেন ওর গায়ে হাত তোলাটা শান্তুর উচিত হয়নি ঠিকই, তবে শ‍্যামলীর‌ও উচিত হয়নি দাদার মনে দুঃখ দেওয়া।
সবিতা বলল, শুনলে তো? শ‍্যামলী সব সময় ঠাকুর দেবতা নিয়ে চিমটি কেটে কথা বলে। আচ্ছা, তুমিই বলো, শ‍্যামলীর ভক্তি না থাকতেই পারে, দুটো নম্বর পায় বলে মাটিতে পা ফেলতে ইচ্ছে না করতেই পারে, কিন্তু অন‍্যের ভক্তিকে আঘাত করা কি ঠিক?
সবিতার কথাটা এবার গভীর ভাবে খেয়াল করল অনসূয়া। একটা সাংঘাতিক সংবেদনশীল বিষয় তুলে এনেছে এরা। আজ বছর আষ্টেক হতে যায় ভারতীয় সংবিধানে সেক‍্যুলার শব্দটা ঢুকিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু  ভারতীয় প্রতিবেশে এই সেক‍্যুলার শব্দটা ইউরোপীয় রেনেসাঁ ও বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনজাত মর্ম গ্রহণ করেনি। ইউরোপীয় দার্শনিকের চোখে সেক‍্যুলার শব্দটা ধর্মীয় কাজকর্ম ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ বোঝায়। আর ভারতীয় মানসিক গঠনে সেক‍্যুলার শব্দ সেই ব‍্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলে হয়ে উঠেছে সর্বধর্মে সমানভাবে উৎসাহ দান।
না বুঝেই একটা মোক্ষম প্রশ্ন তুলে দিল সবিতা। ইউরোপীয় বস্তুবাদী দার্শনিকের চোখে বিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা নেই। বিশ্বের সবচেয়ে গভীর সংকটগুলিতে ঈশ্বরের কোনো সদর্থক ও গঠনমূলক ভূমিকা পাওয়া যায় না, এই হল ইউরোপীয় রেনেসাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। বিপরীতে ভারতের চিন্তাবিদদের বক্তব্য হল, সব ধর্মের অনুসারীদের পারস্পরিক সম্ভ্রম ও সহযোগিতার নাম হল সেক‍্যুলারিজম। এই মনের কাঠামো থাকলে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কিছু বললে বক্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করাও জনসমর্থন পেয়ে যায়। নিজের বাড়িতে বেতনভুক কাজের লোকদের পর্যন্ত ঈশ্বর ভক্তি তো অনেক দূরস্থান, ভূতপ্রেতের ভয় পর্যন্ত কাটাতে পারেন নি অনসূয়া। একটা মানুষের ভিতরের মানুষ প্রশ্ন করতে না শিখলে ধর্মীয় কুসংস্কার কাটানো শক্ত।
অনসূয়া বাসন্তীবালার দিকে চেয়ে  বললেন, শান্তু যদি বাড়িতে থাকেন, আমি কি তার সাথে একটু আলাপ করতে পারি?
বাসন্তীবালা সংকোচের সাথে বললেন, আমার ছেলে একটু মাথা গরম। ওর সাথে কথা বললে যদি ওর খারাপ লাগে?
অনসূয়া বললেন, তাহলে কি ও শ‍্যামলীর মতো আমাকেও ঘুঁষি মারবে?
শশাঙ্ক পাল বললেন, থাক্ না, ওকে আর বিরক্ত নাই বা করলেন! আমি হার্টের পেশেন্ট। মনটা ভিতরে ভিতরে ভেঙে গিয়েছে। আজ ষষ্ঠীর দিন। আমি আজ আর অশান্তি চাইছি না।
আচ্ছা শশাঙ্কবাবু, আমি যদি শ‍্যামলীর হয়ে একটা কথাও না বলি, তাহলে শান্তুর সঙ্গে কথা বলতে দেবেন? আমার মনে থাকবে, আপনার ছেলে খুব মাথা গরম।
ততক্ষণে শান্তু উপরে উঠে এসেছে। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বললো, মা আজ ষষ্ঠী। আজ কি সকাল থেকে একটার পর একটা লোক এসে বাবাকে বকিয়ে যাবে?
শান্তুর আচরণে শশাঙ্ক পাল আর বাসন্তীবালা দৃশ‍্যত‌ই অপ্রস্তুত।
অনসূয়া তার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আমি অনসূয়া চ‍্যাটার্জি। অ্যাডভোকেট । আপনার সাথে কথা বলবো বলেই এসেছি। ভাল‌ই হল, আপনি নিজেই উঠে এলেন।
সামনের সোফায় বসা মহিলা একজন অ্যাডভোকেট শুনে শান্তুর মুখে একটা চিন্তার ছায়াপাত হল। শান্তু বলল, বলুন কি বলবেন। তবে আমার কিন্তু খাওয়া দাওয়া হয়নি।
সে কি কথা? খান নি কেন?
শান্তু বলল, খেতে দেয় নি। তাই খাই নি।
অনসূয়া বললেন, আর অতনু?
শান্তু বিরক্ত হয়ে বলল, সে কখন খেয়ে নিয়েছে!
অনসূয়া হাসি মুখ করে বললেন, আপনার সম্বন্ধে আপনার মা বলছিলেন, আপনার নাকি খুব মাথা গরম!
শান্তু মার দিকে তাকিয়ে বলল, মা ওইরকম না বুঝে কথা বলে।
অনসূয়া বললেন, আমি অ্যাডভোকেট। আমার ফ‍্যামিলির অনেকেই জজ সাহেব। বুঝলেন?
শান্তু বলল, তা আমায় কি করতে হবে?
অনসূয়া বললেন, দেখুন, আমি এখানে আসবার আগে একটু রেইকি করে এসেছি।
রেইকি কথাটা শুনে বাসন্তীবালা আর শশাঙ্ক দুজনেই অনসূয়ার মুখের দিকে তাকালেন।
শান্তু বলল, রেইকি মানে?
অনসূয়া শ‍্যামলীর দিকে চেয়ে বললেন, তুই যা শ‍্যামলী। বড়দের কথায় তোর থাকাটা ঠিক নয়।
শ‍্যামলী উঠে চলে গেলে, অনসূয়া একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, রেইকি মানে রিহার্সাল। আমি একটু রিহার্সাল করেছি।
শান্তু ভ্রূ কুঁচকে বলল, কি রকম?
অনসূয়া বললেন, বেশি কিছু না, আপনি কেমনভাবে সময় কাটান, তার সামান্য খোঁজখবর নিয়েছি। আপনি ফুটবল খেলতে ভালবাসেন, তাই তো?
শান্তু সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। বলে, হ‍্যাঁ, আমি জেলার হয়ে খেলি।
অনসূয়া বললেন, পাস্ট টেন্সে বলুন। বলুন খেলতাম। খেলি বলাটা গ্রামাটিক‍্যালি ঠিক হচ্ছে না।
শান্তু বলল, কেন বলুন তো?
অনসূয়া বললেন, জেলা টিমের হয়ে ফুটবল খেলার সুযোগ বাবার শরীর খারাপের পর থেকে আপনি আর পান নি।
শান্তু মাথা নিচু করে। মিনমিন করে বলে, নতুন নতুন ছেলেরা উঠে আসছে।
অনসূয়া বললেন, আমি কিন্তু আপনাকে বলেছি, আমি সব খোঁজ খবর নিয়ে তবেই এসেছি।
শান্তু বলল, তা সব‌ই যদি জানেন তো জিজ্ঞেস করার আর কি দরকার?
অনসূয়া বললেন, পুলিশের খাতায় যা লেখা থাকে, অ্যাডভোকেট হিসেবে সে সব বিশ্বাস করব কেন? তাই জিজ্ঞাসা করা। মিলিয়ে নেব কতটা কি?
সবিতা জিজ্ঞেস করে, হ‍্যাঁ গো, পুলিশের খাতায় ওর নাম দিয়েছ তুমি?
অনসূয়া সবিতার কথার জবাব না দিয়ে বললেন, পুলিশের খাতা বলছে আজকাল শান্তুবাবু ফুটবলে পা ঠেকাতে না পেয়ে, লোকের গায়ে ঘুঁষি ঠেকাচ্ছে।
শান্তু বলল, বোনের ব‍্যাপারটা মাথা গরম করে হয়ে গেছিল।
অনসূয়া বলল, আমি আপনার বাবা মাকে কথা দিয়েছি, আপনার বোনের হয়ে আমি কোনো কথা বলব না।
শান্তু তাকায় অনসূয়ার দিকে।
অনসূয়া বলেন, বলছি কি, বাড়িতে বোনকে মারধোর করলেন, আপনার বোন কিল খেয়ে কিল হজম করল। কিন্তু এ রকম তো সবাই হবে না। যেমন, মাথা গরম করে যদি আপনার আমার গায়ে হাত তুলতে ইচ্ছে করে, তখন ব‍্যাপারটা বেশ একটু ঘোরালো হয়ে যাবে।
সবিতা বলে বসল, তুমি তো বেশ জাঁহাবাজ মেয়েছেলে। চিবিয়ে চিবিয়ে কথাগুলো কেমন বলছে দ‍্যাখো। বলি আজ ষষ্ঠীর দিন।
চোপ র‌ও। ধমকে ওঠেন অনসূয়া। ধমকের দমকে জানালার কাচের শাসিগুলি ঝনঝন করে ওঠে।
মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে অনসূয়া বলেন, খেলাধূলা করতে গিয়ে ছেলেদের মধ‍্যে  ধাক্কাধাক্কি যে হয় না, তা কিন্তু নয়। আমাদের বাঙালি ফুটবলারদের মধ‍্যে বিদেশ বোসকে বেশ মার খেতে দেখেছি। ক্রিকেটে নরি কন্ট্রাকটরকে মনে আছে। ফ্রাঙ্ক ওরেলকেও। কিন্তু সে খেলার মাঠের ব‍্যাপার। পুলিশের খাতা বলছে আপনি কিন্তু ইদানীং মাথাগরম একটু বেশিই করছেন। অবশ‍্য মদ খেয়ে ফেললে মাথা ঠিক রাখা মুশকিল।
শান্তু বাবার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, বিশ্বাস করো বাবা, মদ আমি খাই নি।
অনসূয়া শান্ত কঠিন গলায় বললেন, ব্রীদ অ্যানালাইজারে আপনাকে টেস্ট করিয়েছিল থানার মেজোবাবু। আমার কাছে তার কপি আছে। দেখবেন?
ভয়ে কেঁচো হয়ে যায় শান্তু। সহসা নিচু হয়ে অনসূয়ার পা ছুঁয়ে কাতর মুখে তাকায় সে। আমায় বাঁচান দিদি।
অনসূয়া পা ছাড়ানোর চেষ্টা পর্যন্ত করেন না। শশাঙ্কবাবুকে বলেন, আপনি হার্টের পেশেন্ট। আজ এইটুকু থাক। এটা ট্রেলার হল। পিকচার আভি বাকি হ‍্যায়।
শ‍্যামলী দরজায় এসে বলে, দিদি, আজ ছেড়ে দিন। এরপর আর কিছু হলে আমার এই বাড়িতে টেঁকা মুশকিল হয়ে যাবে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।