• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৮১)

পর্ব – ৮১

৮০

হেডমিস্ত্রি বলল, ব‌উ বাচ্চাকে নিয়ে না গিয়ে আমার উপায় ছিল না।
শ‍্যামলী বলল, কেন?
মিস্ত্রি বলল,  পাল অটো থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে শুনলে এ লাইনে আর কেউ আর আমায় কাজ দেবে না।
শ‍্যামলী জানতে চাইল, কেন? কাজ দেবে না কেন?
মিস্ত্রি বলল, সবাই জানে পাল অটোর মালিকের দয়ার শরীর। সেই লোক যদি সহ‍্য করতে না পেরে তাড়িয়ে দেয়, কেউ আর বিশ্বাস করে কাজ দেবে না।
শ‍্যামলী বলল, তা, এত‌ই যদি বোঝেন, ক‍্যাশ ফেলে চলে গিয়েছিলেন কেন?
আমি বীরুস‍্যারকে ভয় পাই।
শ‍্যামলী জানতে চাইল, কেন? কি দুর্বলতা আপনার?
 হেডমিস্ত্রি বলল, বীরুস‍্যার অনেক ক্ষতি করে দিতে পারে।
শ‍্যামলী রাগ দেখিয়ে বলল, বাঃ , আমি ক্ষতি করতে পারি না, তাই আমায় ভয় পান না, তাই তো?
আর ওর কাছে যাব না। ডাকলেও শুনব না। হেডমিস্ত্রি যেন নিজেকে বোঝায়।
শ‍্যামলী তাকে গতকালের কালেকশনের টাকা ক’টা দেয়। ক‍্যাশবুক আপডেট করতে বলে। তার পর বলে, রোজ দুটোর মধ‍্যে ব‍্যাঙ্কে গিয়ে কালেকশনের টাকা জমা করে রাখবেন। রসিদটা এই খাতায় সেঁটে রাখবেন।
 তারপর শ‍্যামলী অফিস ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। ঘাড় ঝুঁকিয়ে খাতা লিখতে থাকে হেডমিস্ত্রি। শ‍্যামলী বাইরে দেখতে পায় গাড়ি সারানোর কাজ চলছে। বাচ্চা শ্রমিকটিকে বলে, একটা টুল এনে দে। শ‍্যামলী বসে বসে কাজ দেখতে থাকে। সব মিস্ত্রিরা তাকে দেখে নীরবে কাজ করে যেতে থাকে। বিড়ি বা গুটখা পান মশলা পর্যন্ত খায় না ওর সামনে।
 খানিকটা সময় ওদের কাজ করা দেখার জন‍্য বসে থেকে, শ‍্যামলী অফিস ঘরের পিছনটায় গেল। এখানে কতকগুলো গাছ অযত্নে বেড়ে উঠেছে। শিউলি, কামিনী, আর একটি স্থলপদ্মের গাছ। কামিনী ফোটে সন্ধ্যায়। তার সুবাস কারখানার তেলকালির গন্ধে চাপা পড়ে যায়।  সকালে গাছের নিচে ঝরা শেফালির মেলা। শ‍্যামলীর তা তাকিয়ে দেখার সময় হয় না। স্থলপদ্মের গাছে বেশ কতকগুলো ফুল ফুটেছে। রোদের তাপ বাড়লে শাদা শাদা ফুল লাল রঙের হয়ে যাবে। এমন সময় বাচ্চা ছেলেটা কাছে এসে বলল, ছোড়দি তোমাকে ফুল পেড়ে দেব?
 শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ রে দিবি তো বলছিস, কিন্তু কিসে করে দিবি?
বাচ্চাটা বলল, আঁচল পাতো।
শ‍্যামলী তাকে ভেঙিয়ে বলল, হ‍্যাঁ আঁচল পাতো। আর আমার এত ভাল শাড়িটা নষ্ট হয়ে যাক আর কি। ও হবে না।
বাচ্চা শ্রমিকটি মাথা চুলকে জানতে চায়, তাহলে কি করে দেব?
শ‍্যামলী বলল, আমি জানি না যা। বলে সে অফিস ঘরে ফিরল। হেডমিস্ত্রিকে বলল, ক‌ই কি লিখলেন দেখান।
 ক‍্যাশবুক দেখে শ‍্যামলী বলল, দুটো গাড়ি সারানোর দাম যে কোম্পানি পায় নি, তা কি করে বোঝা যাবে?
মিস্ত্রি বলল, যে টাকা হাতে আসে নি, পাওয়া হয় নি, তা ক‍্যাশ বুকে ঢুকবে না।
শ‍্যামলী জিজ্ঞাসা করল, আর স্টক রেজিস্টারে?
স্টকে দেখানো হবে পার্টস কি কি এসেছে, আর কি কি বেরিয়ে গিয়েছে।
শ‍্যামলী জানতে চাইল, আর যে পার্টসের দাম পাই নি, তার কি হবে?
মিস্ত্রি মাথা নিচু করে।
শুনুন, ওই পার্টস দুটোর নাম আর দাম আমায় লিখে দিন একটা কাগজে।
এমন সময় বাচ্চা শ্রমিকটা একটা বড়ো কাগজের ঠোঙায় স্থলপদ্ম ফুলগুলো তুলে এনে টেবিলে রাখল।
মজুরদের সবাইকে একবার অফিস ঘরে ডাকল শ‍্যামলী। বলল, শোনো তোমরা, পুজোর দিনগুলো রোজ খানিকটা করে সময় কারখানা খোলা থাকবে। সকালে একটা আর বিকেলে একটা করে শিফট চলবে। দশটা থেকে দুটো, আর দুটো থেকে ছয়টা। এই দুই শিফটে কাজ করাবো। এই কদিন বাড়তি রেটে মজুরি দেব। এই সময়ে কে কি কাজ করলে হেডমিস্ত্রিকে বলে রাখবে। উনি লিখে রাখবেন। সেই হিসেব দেখে আমি পয়সা দেব। কোম্পানির রোজগার ভাল হলে একটা গ্র‍্যাণ্ড ফিস্ট। সব মজুররা আনন্দে হ‌ই হ‌ই করে উঠল। সবাই  চায় দু শিফটেই কাজ করে ওভার টাইম নেবে। শ‍্যামলী বলল, না তা হবে না । সবাই সারা বছর খাটো। পুজোর সময় একটু বাড়তি নগদ পয়সা দেবো। বৌ বাচ্চাদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে যেও। বাচ্চাদের আনন্দ দিলে তারা তোমাকে মানবে, ভালবাসবে।
হেডমিস্ত্রি বলল, পুজোর ক’টা দিন অফিস কাছারি বন্ধ। বাবুরা অফিস না গেলে গাড়ি বের করবে কেন? এত সেল হবে কি? সব গ‍্যারেজ বন্ধ রাখছে। আগে আমাদেরও গ‍্যারাজ বন্ধ থাকত।
শ‍্যামলী বলল, আপনি সব সময় নেগেটিভ দেখাটা বন্ধ করবেন? পুজোর দিনে সব গ‍্যারাজ বন্ধ, ওই জায়গাটা দিয়েই আমি বাজার ধরতে চাইছি। আমাদের এই চত্বরে যাদের বাড়িতে নিজের গাড়ি আছে, তাদের সকলকে ফোন করে বলতে হবে, সন্ধেবেলা ঠাকুর দেখতে বের হতে গেলে একবার আপনার গাড়িটা আমাদের কাছে চেক করিয়ে নিন।
হেডমিস্ত্রি বলল, তাতেই হবে?
শ‍্যামলী বলল, ওইখানেই ক্লিক করবে। বাড়িতে গাড়ি থাকলে সবার ইচ্ছে করে ফ‍্যামিলি নিয়ে ঘুরতে বেরোয়।
হেডমিস্ত্রির দিকে তাকিয়ে বলল, যাদের বাড়িতে নিজের গাড়ি আছে, আপনি সবাইকে ফোনে বলবেন, পাল অটো খোলা থাকছে। আপনার গাড়িটা এখানে কম পয়সায় চেক করিয়ে নিন।
শ্রমিকরা বলল, গাড়ি পোষা লোকে পুজোর দিনে কম পয়সায় গাড়ি সারাবে কেন?
শ‍্যামলী বলল, আরে এটা বিজনেস স্ট্র‍্যাটেজি। গাড়ি চেক করো। কি প্রবলেম বুঝিয়ে দাও। তেল মোবিলে কি পয়সা লাগবে, বলে দেবে আর কি পার্টস লাগবে, তার নাম আর দাম বলবে। সহজ কথা সোজাসুজি বলে দেখবে, নতুন লোক পর্যন্ত তোমাকে সারাইয়ের কাজ দেবে।
হেডমিস্ত্রি বলল, গাড়িওলাদের ফোন নম্বর কি করে পাব?
শ‍্যামলী তাকে ধমকে বলে, আপনি যোগাড় রাখেন না কেন? বলে একটা তালিকা বের করে হেডমিস্ত্রির হাতে দেয়। বলে, এতে আমি টেলিফোন ডিরেকটরি খুঁজে খুঁজে এই চৌহদ্দির সবক’টা পয়সাঅলা লোকদের নম্বর লিখে রেখেছি।
হেডমিস্ত্রি বলল, কি বলতে হবে?
তাহলে দেখুন,  বলে হেডমিস্ত্রিকে দেখিয়ে একটা নম্বরে ডায়াল করে শ‍্যামলী। ও প্রান্তে  ফোন  বাজতে তাকে। তারপর ও প্রান্তে কেউ ধরলে  শ‍্যামলী চোস্ত গলায় বলে, আমি পাল অটো থেকে বলছি স‍্যর। আমরা খুব যত্ন করে গাড়ি সারিয়ে থাকি স‍্যর। পুজোর দিনে আপনি যাতে খুব নির্ঝঞ্ঝাটে গাড়ি নিয়ে বেরোতে পারেন সে জন‍্য আমরা খুব কম খরচে গাড়ি চেক করে দিচ্ছি স‍্যর।
ওপার থেকে ইতিবাচক সাড়া এল দেখে শ্রমিকরা সবাই অবাক। এভাবেও কাজ টেনে আনা যায়?
হেডমিস্ত্রি বলল, মেয়েদের গলা শুনলে অনেক লোক এগিয়ে আসবে।
শ‍্যামলী বলল, সে কি? আমার বলার কৌশলটা আপনার চোখে পড়ল না? আপনার কি মনে হয়,  যে কোনো মেয়ে এভাবে বলতে পারত? শুনে রাখুন, মেয়ে বলে নয়, বলার গুণে মার্কেটিং হয়। আপনারা মেয়েদের সম্মান করতে শেখেন না বলে বুঝতে পারেন না, ভাল ভাবে কাজ করার ব‍্যাপারটা ঠিক ঠিক বোঝাতে পারলে ছেলে বলছে, না মেয়ে বলছে, সেটা কোনো ব‍্যাপার নয়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *