দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৮)
by
·
Published
· Updated
২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।
এইবার লিখব
আট
শুধু বৃন্দাবনের বাড়িতেই নয়, তাদের মেলামেশার খবরটা কী করে যেন অনন্যাদের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল। শুনেই ওর মা বলেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তুই কি আমাদের মুখে চুন-কালি মাখাতে চাস, না কি?
যে বাবা মেয়েকে পাগলের মতো ভালবাসতেন, এই খবর শোনামাত্র— না, তিনি কিছু বলেননি। এমন একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়েকে কিছু বলতেও তাঁর যেন রুচিতে বাধছিল। তাই কিচ্ছু বলেননি, শুধু মেয়ের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে মেয়ের আর বিয়ে দিতে পারবেন তাঁরা? ছি ছি ছিঃ, শেষ পর্যন্ত কি না…
বাবা-মা সে রকম কিছু না বললেও, অনন্যার দুই ভাই একেবারে নড়েচড়ে বসল। খোঁজখবর নেওয়া শুরু করল, ছেলেটা কে? কোথায় থাকে? কী করে?
ছেলেটা কে?ঠিক আছে। কোথায় থাকে? তাও ঠিক আছে। কিন্তু কী করে?— যখন জানতে পারল, কিছুই করে না। একই টাইপ স্কুলে বোনের সঙ্গে টাইপ শেখে। আর ওখান থেকেই ওদের পরিচয়, মেলামেশা আর ঘনিষ্ঠতা। তখন তারা আর ঠিক থাকতে পারল না। বোনকে বলল, তোকে আর টাইপের স্কুলে যেতে হবে না। বন্ধ করে দে ও সব। ঘর থেকে এক পা-ও আর বেরোবি না। আর তুই যদি বেরোস, তা হলে ওর এমন অবস্থা করব, যাতে ও আর কোনও দিন ওই স্কুলে তো নয়ই, নিজের পায়েও আর উঠে দাঁড়াতে না পারে। কোনটা চাস বল? তুই যা চাইবি তাই হবে। বল, কী চাস?
অনন্যা বলেছিল, আমি আর টাইপের স্কুলে যাব না।
কিন্তু যে জন্য অনন্যা এ কথা বলেছিল, তার ক’দিন পরেই এক ভরসন্ধেবেলায় সেটাই ঘটে গেল।
বৃন্দাবন যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপন-মনে বাড়ি ফিরছিল, ঠিক তখনই পাঁচ-ছ’জন ছেলে আচমকা তার পথ আটকে দাঁড়াল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথিতে রাস্তায় পড়ে গেল বৃন্দাবন। ও যখন উঠে কোনও রকমে উঠে ওদের কাছ থেকে ছুটে পালাতে যাবে, ঠিক তখনই, ক’হাত দূরের ঠান্ডা পানীয়র দোকান থেকে এই ছেলেগুলোর মধ্যে থেকেই কে যেন দৌড়ে গিয়ে একটা সোডার বোতল নিয়ে এসেছিল। পেছন দিক থেকে সপাটে চালিয়ে দিয়েছিল ওর মাথায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল বৃন্দাবন। আরও হয়তো মারত, হয়তো মেরেই ফেলত। কিন্তু ততক্ষণে আশপাশের লোক হইহই করে ছুটে আসায় এই ছেলেগুলো সঙ্গে সঙ্গে বাইক নিয়ে চম্পট দিয়েছিল।
আটটা সেলাই পড়েছিল বৃন্দাবনের মাথায়। কালশিটে পড়ে গিয়েছিল চোখের নীচে। লেগেছিল ঘাড়ে, পাজরেও।
ওর বাবা বলেছিলেন, এটা কারা করেছে বুঝতে পেরেছিস তো? ওই মেয়েটার বাড়ির লোকেরা। দেখলি তো, তোকে ওই মেয়েটির সঙ্গে মিশতে কেন বারণ করেছিলাম? আমার কথা শুনিসনি। এখন তার ফল কী হল দ্যাখ। কোনও বাবা-মা কখনও তার সন্তানের খারাপ চায় না। কোনও বেকার ছেলের সঙ্গে তার মেয়ে মিশছে, এটা কোনও মেয়ের বাবা-মাই মেনে নেবে না। ছাড়াবার চেষ্টা করবে। সহজে না ছাড়লে তাকে এমন শিক্ষা দেবে যাতে সে বাপ-বাপ করে ছেড়ে পালায়। তোকে বারবার করে বলছি, আগে নিজের পায়ে দাঁড়া। আজ যদি তোর কোনও সরকারি চাকরি থাকত, মাস গেলে যদি একটা মোটা টাকা মাইনে পেতিস, তা হলে কি ওরা তোর সঙ্গে আর যাই করুক, এ রকম ঘটনা ঘটাতে পারত? পারত না। আমি তো বলছি, হয় এটা ওর ভাইয়েরা করেছে, না হলে ওর বাবা লোকজনকে টাকা-পয়সা খাইয়ে করিয়েছে। না হলে তোর কে এমন শত্রু আছে বল তো, যে তোকে এ রকম নৃশংস ভাবে মারবে? লোকগুলো ছুটে না এলে তো ওরা তোকে মেরেই ফেলত।
বৃন্দাবনের কানে তখন কোনও কথা ঢুকছিল না। ও শুধু ভাবছিল, অনন্যা কি জানে তার এই অবস্থার কথা? জানে, সে এখন হাসপাতালে ভর্তি?
মাথায় লেগেছে ঠিকই, তবে যে ভাবে লেগেছিল, ডাক্তাররা আশঙ্কা করেছিলেন ভয়ানক কিছু হয়েছে। কিন্তু না, সিটি স্ক্যান করে দেখা গেছে সে রকম কোনও চোট লাগেনি। ফলে ইন্টারনাল হ্যামারেজও হয়নি। তাই দু’দিন পর্যবেক্ষণে রেখেই বৃন্দাবনকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুরা।
বাড়ি আসার পর ওর বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, অন্য কাউকে ভালবাসার আগে নিজেকে ভালবাস। নিজেকে ঠিক মতো ভালবাসলে অন্যকে ভালবাসা মানায়। নিজেকে ভালবাস। নিজেকে।
শুধু ওর বাবাই নন, বাবার কথা শুনে ওর মায়েরও বদ্ধমূল ধারণা হল, এই কাজটা ওই মেয়েটার বাড়ির লোকেরাই করিয়েছে। তাই ছেলেকে ওই অনন্যার কবল থেকে বাঁচানোর জন্য, ওই মেয়েটি আর ওর পরিবারের লোকজনদের সম্পর্কে রোজই একটু একটু করে এমন বিষ ছেলের মনের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন যে, বৃন্দাবনও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, বাবা-মা খুব একটা ভুল বলছেন না।
তাই তিন দিনের মাথায় ও ঠিক করে ফেলল, অনেক হয়েছে, আর নয়। এ বার সত্যিই তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। রাত-দিন এক করে মন দিয়ে সে শুরু করল পড়াশোনা।
মা ওর বাবাকে বললেন, ছেলেটার মুখের দিকে আর তাকাতে পারছি না। ও কিন্তু মনের মধ্যে খুব বড় রকমের একটা আঘাত পেয়েছে। এই আঘাত থেকে ও যে কবে বেরিয়ে আসতে পারবে আমি জানি না।
বাবা বললেন, ভগবান যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।
মা বললেন, তুমি বাবা হয়ে এ কথা বলছ?
— বাবা বলেই বলছি, প্রতিবেশী হলে বলতাম না। এত দিন পর্যন্ত ও এক রকম ছিল। এ বার দেখবে, ও মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠবে। দেখছ না, আগের থেকে ও কত বদলে গেছে!
বৃন্দাবন সত্যিই একদম একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গিয়েছিল। ‘কর্মক্ষেত্র’, ‘এমপ্লয়মেন্ট গ্রেজেট’ বেরোলে একেবারে ভোরবেলাতেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে স্টল থেকে কিনে নিয়ে আসত। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ত, কোথায় ভ্যাকেন্সি আছে! কোথায়!
এক-দু’দিন পর পরই আজ এখানে কাল সেখানে ও পরীক্ষা দিচ্ছিল।না, শুধু সরকারি চাকরিতেই নয়, আন্ডারটেকিং থেকে মার্চেন্ট ফার্ম, কোনওটাই বাদ দিচ্ছিল না। শুধু লিখিত নয়, মৌখিক পরীক্ষাগুলোও খুব ভাল ভাবে দিচ্ছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। আশাব্যঞ্জক কোনও চিঠিও আসছিল না তার কাছে। তার পর হঠাৎ করেই একদিন এক সঙ্গে দু’-দুটো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসে হাজির। একটা বাড়ি থেকে কিছু দূরে লোকাল পঞ্চায়েত অফিসে। আর একটা রেলে।
মা চেয়েছিলেন। ছেলে পঞ্চায়েতেই ঢুকুক। তা হলে বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে যাতায়াত করতে পারবে। চোখের সামনে থাকবে। কিন্তু বাদ সেধেছিলেন বাবা। তিনি ওর মাকে বললেন, না। ও যদি এখানে থাকে, তা হলে ও হয়তো আবার ওই মেয়েটির পাল্লায় পডবে। আর এ বার যদি ওর ওপরে ওর ভাইরা চড়াও হয়, তা হলে কিন্তু ওকে আর বাঁচানো যাবে না। তুমি কি ওকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাও? না, ও ওর মতো একটা সুস্থ জীবন যাপন করুক সেটা চাও?
মা বলেছিলেন একদম অলক্ষুনে কথা বলবে না তো…
ওর বাবা বলেছিলেন, তা হলে ওকে রেলের চাকরিটাতেই যেতে দাও। আমি চাই, ও এখান থেকে দূরে থাকুক। আউট অব সাইড, আউট অব মাইন্ড। ক’দিন দূরে থাকলেই মেয়েটিকে ও নিশ্চয়ই ভুলে যাবে। ও ভাল থাকবে।
— ঠিক আছে, আমি আর কী বলব! তা হলে তুমি যা ভাল বুঝবে, তাই করো। আমি আর কিছু বলব না।
মা রাগ করে এ কথা বললেও, বাবা কিন্তু ছেলেকে রেলের চাকরিটা নেওয়ার জন্যই সুপারিশ করলেন। বললেন, রেলে ক’বছর পর পর বদলি হতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার সঙ্গে কত সুযোগ-সুবিধে আছে দ্যাখ। পঞ্চায়েত তো রাজ্য সরকারের। আর রেল হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের। তুই তো একেবারে মূর্খ না, কোনটা ভাল, নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করে দ্যাখ। দরকার হলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু আলাপ-আলোচনা কর… কোনটা ভাল, পঞ্চায়েত, না রেল?
বাবা আরও যা যা বললেন, তাতে বৃন্দাবন তার বাবার কথাতেই সায় দিল। বলল, ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ, আমি রেলেই জয়েন করব।