• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে সিদ্ধার্থ সিংহ (পর্ব – ৪)

২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো চুয়াল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

এইবার লিখব

চার

বৃন্দাবনকে ডেকে ওর বাবা বললেন, কী ব্যাপার রে, কী করছিস তুই? তুই নাকি ইলেক্ট্রিকের দোকানে গিয়ে বলেছিস, তুমি আমাদের কাগজে বিজ্ঞাপন দাও। ফুল পেয়ে পঞ্চাশ টাকা। কিসের কাগজ?
— এমনি সাহিত্যের কাগজ।
—সাহিত্যের কাগজ মানে? তুই কি আবার সাহিত্য-ফাহিত্য করছিস নাকি?
— না, ফাহিত্য করছি না। আবার ঠিক সাহিত্যও না। সাহিত্যের মতো…
ওর বাবা একটু গলা চড়িয়ে বললেন, এ সব ভূত একদম ঘাঢ় থেকে নামা। কত লোক দেখলাম। এ সব করে কিচ্ছু হয় না। শেষ বয়সে না খেয়ে মরতে হয়। শুনিসনি, কত বড় বড় সাহিত্যিক না খেতে পেয়ে মরেছে। যেটা করছিস, সেটা মন দিয়ে কর। পড়াশোনা ঠিক মতো কর।
— কেন, আমি কি পড়াশোনা করছি না?
— কী করছিস সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ইলেক্ট্রিকের দোকানের লোকটা ডেকে বলছে, আপনার ছেলে তো ওদের কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন চেয়ে গেল…
একটু বিরক্ত হয়ে বৃন্দাবন বলল, চেয়েছি। হ্যাঁ, চেয়েছি। ওনার যদি দিতে ইচ্ছে না হয়, দেবেন না। সেটা সরাসরি উনি আমাকে বলবেন। আমি তো আর ওনার  কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে বলিনি, আপনাকে বিজ্ঞাপন দিতেই হবে। দিলে ওনারই লাভ। লোকেরা জানতে পারবেন যে, উনি বাড়ি বাড়ি গিয়েও ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ের কাজ করেন। এতে ওনারই লাভ।
— ওনার লাভ তোকে দেখতে হবে না। তুই তোর লাভটা দেখ। চাকরির জন্য যে পরীক্ষাগুলো দিচ্ছিস, তার জন্য একটু বেশি করে মন দিয়ে পড়। যত ভাল পরীক্ষা দিবি, চাকরির কম্পিটিশনে তত এগিয়ে যাবি। এগুলো যদি করতেই হয়, এর জন্য প্রচুর সময় পড়ে আছে। আগে চাকরি-বাকরি জোটা। রোজগারপাতি কর। নিজের পায়ে ভাল করে দাঁড়া। তার পর না হয় অবসর সময়ে এ সব সাহিত্য-ফাহিত্য করবি। আমাকে যেন আর দ্বিতীয় বার কারও কাছে শুনতে না হয় যে, তুই কারও কাছে বিজ্ঞাপন চেয়েছিস…
বৃন্দাবন একটু বিরক্ত হল। বলল, তুমি এমন করে বলছ, যেন আমি কারও কাছে হাত পেতেছি। ভিক্ষে চেয়েছি।
— হ্যাঁ, ব্যাপারটা প্রায় সে রকমই।
— তাই নাকি? ঠিক আছে কাল ওকে মজা দেখাচ্ছি। এত বড় সাহস। যখন গেলাম তখন তো ভিজে বেড়ালের মতো মিঁউমিঁউ করছিল। দাঁড়াও, কাল ওর ব্যবস্থা হচ্ছে।
বৃন্দাবনের বাবা বললেন, কী করবি? হুজ্জুতি করবি?
— না, জিজ্ঞেস করব, কেন তোমাকে এটা বলতে গেছে?
— ও, তুই করতে পারবি, আর ওরা বলতে পারবে না, না? একদম ওমুখো হবি না। আমি যেন শুনতে না পাই। এই বলে দিলাম। ভাল বুদ্ধি দিচ্ছি, শোন। এখনও সময় আছে, আমি থাকতে থাকতে সব গুছিয়ে নে। আমি চলে গেলে…
চুপ হয়ে গেল বৃন্দাবন। বাবার মুখের ওপরে কোনও কথা বলতে পারে না সে। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা বললেন, তোর বন্ধুদের দেখ, সবাই কেমন টপটপ করে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। আর তুই? সারা দিন টো-টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। কী যে করিস কে জানে!
ছেলে আর ছেলের বাবাকে একটু জোরে কথা বলতে দেখলেই বৃন্দাবনের মা তড়িঘড়ি সেখানে এসে হাজির হন। উনি জানেন, ছেলের এ সব ব্যাপার উনি একদম ভাল চোখে দেখেন না। উনি চান, আর পাঁচটা ছেলে যেমন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ও-ও করুক। ছেলেকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন উনি। এই চিন্তা এখন দিন দিন উদ্বিগ্নের দিকে ঝুঁকছে। সব সময় ছেলেকে ও সব কথা বলতেও পারেন না। এখনকার দিনের ছেলে কোন কথা কী ভাবে নেবে, কোনও ঠিক আছে? এই তো সে দিন পাশের পাড়ার ঘটনা, বাবা একটু কী যেন বলেছে, ব্যস। ঘরের ভিতর ঢুকে ছিটকিনি তুলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে। এখন কিছু বলার উপায় আছে?  তাই ছেলেকে নয়, খেতে বসে সমস্ত কষ্ট বউয়ের ওপরে উগড়ে দেন তিনি।
আর ছেলেকে কিছু বলতে গেলেই কথায় কথায় কথা বাড়ে। বাবার গলা চড়ে। অতটা না হলেও ছেলের পারদও কম চড়ে না। তার পর একজন রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তাই সেটা আঁচ করেই বৃন্দাবনের মা এসে ছেলেকে বললেন, তুই একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয় তো বাবা। বলেই, স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি, তুমি কি চা খাবে নাকি?
গজগজ করতে লাগলেন বৃন্দাবনের বাবা। — ধ্যাৎ, ছেলেটা যা হয়েছে না, আর পারা যাচ্ছে না।
ভাগ্যিস ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বেশ খানিকটা চলে গিয়েছিল বৃন্দাবন। না হলে এই কথার পিঠে ও নিশ্চয়ই এমন কিছু বলত,আর তা নিয়েই দু’জনের মধ্যে আবার শুরু হয়ে যেত কথা কাটাকাটি। মাঝখান থেকে উনি বাপ-বেটার ঝগড়ার মধ্যে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপটা হতেন।
স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে উনি তখন বোঝার চেষ্টা করছেন, আকাশে ঘনিয়ে আসা কালো মেঘটা কেটে গেছে কি না।
বউকে ও ভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃন্দাবনের বাবা বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার মুখ দেখছ?
আমতা আমতা করে বউ বলল, না, বলছিলাম, তুমি চা খাবে কি না…
খেঁকিয়ে উঠলেন বৃন্দাবনের বাবা, এটা জিজ্ঞেস করার কি আছে? দাও।
এই যে উনি ‘দাও’ বললেন, তাতেই যেন তাঁর শান্তি। উনি চা খেতে রাজি হয়েছেন মানে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। যাক বাবা, বাঁচা গেছে। ভাগ্যিস তখন ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম! না হলে এখনও দু’জনের চলত… মনে মনে বলে, উনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি ঘরে গিয়ে একটু পাখার তলায় বসো, আমি চা নিয়ে আসছি। বলেই, আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে তিনি সোজা ভিতরে ঘরের দিকে চলে গেলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।