দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৮)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১৮
১১৭
সাদা পোশাকের পুলিশ দেখলে বেশ সহজেই চেনা যায়। তারা হাফ হাতা জামা আর সাধারণ প্যান্ট পরে বলেই নয়, তাদের হাবে ভাবে, চুল ছাঁটায় আর কথা বলার ধরণে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তারা আদতে পুলিশ। নিজেকে লুকোনোর বিশেষ ইচ্ছেও তাদের সেভাবে থাকে না। একটা অমন লোক খানিক ক্ষণ ধরেই ঘুর ঘুর করছিল । খানিকবাদে আরো জনা দুয়েক অমন লোক এল। তাদের দেখেই শ্যামলী তার চার পাশের জনতাকে নির্দেশ দিল রাম নারায়ণ মিশ্রের বাড়ির লোহার ফটকের ছোটো গেটটি দিয়ে যাতে আসা যাওয়ার ফুরসৎ মেলে বাড়ির লোকেদের । তখনি সাদা পোশাকের পুলিশ এসে কড়া গলায় শ্যামলীকে বললো – “অ্যাই মেয়েটা , এখানে কি হচ্ছে?”
শ্যামলী হেসে জবাব দিল “ গান হচ্ছে গো বড়োবাবু , রামধুন গান। তুমিও গাইতে পারো ।“
ওদের মধ্যে সব চাইতে ষণ্ডা মার্কা লোকটা ধমকের সুরে বললো “ ইয়ারকি হচ্ছে না?”
শ্যামলী বললো “ ছি ছি, পুলিশের লোকের সাথে কেউ ইয়ারকি মারে? গরিবের পেটে লাথি পড়েছে , তাই সে ভগবানের নাম নিচ্ছে । এ পোড়া দেশে গরিবের মা বাপ হলে তোমরা পুলিশেরা, আর ওই ভগবান।“
বার বার তাকে পুলিশ বলে সম্ভাষণ করায় সাদা পোশাকের পুলিশটি বিব্রত বোধ করছিল । বিব্রত ভাব কাটাতে সে বললো – “লোকের বাড়ির পথ আটকাতে পাবে না। রাস্তা ছেড়ে দাও ।“
শ্যামলী সহজ চালে বললো “গান গাইছি তো । ভ্যানের তলায় চাকা আছে। বড়ো গেট খুলে ওদের বেরোতে দেখলেই পথ ছেড়ে দেব।“
ষণ্ডা মার্কা লোকটা বললো – “ভালয় ভালয় বলছি, রাস্তা ছেড়ে দাও । নইলে মজা টের পাবে।“
শ্যামলী মাথা ঠাণ্ডা রেখে বললো “ রামধুন গান ভারি ভাল জিনিস। আমাদের গান্ধিজি খুব গাইতেন। একটা চরকা যোগাড় করতে পারলে সেটাও আনতাম। তোমরাও আমাদের সাথে গাইতে পারো রামধুন।মন ভালো থাকবে ।“
পুলিশের লোকে হারমোনিয়াম ছিনিয়ে নিতে গেলে শ্যামলী ব্যঙ্গ করে বললো “ বড়ো বাবু, গান গলা থেকে বেরোয় , যন্ত্র থেকে নয় ।“ সমবেত জনতা তার কথায় হেসে ফেললো । শ্যামলী হারমোনিয়াম ছাড়াই গলা তুলে বলতে লাগলো “ রঘুপতি রাঘব রাজা রাম/ গাড়ি সারিয়ে তুমি মেটাও নি দাম / ঈশ্বর আল্লা তেরে নাম/ গরিবকে চড় মেরে কেনো বদনাম / এত বড় বাড়ি করে কি তোমার কাম ? / গাড়ি সারিয়ে তুমি মেটাও না দাম। “
সাদা পোশাকের পুলিশটি খেঁকিয়ে উঠলো – “ তুই চুপ করবি ?”
শ্যামলী বলে যেতে লাগলো “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম/ গরিবকে চড় মেরে কেনো বদনাম !”
পুলিশটি আবার ধমক দিল – “তুই থামবি না তো ?”
শ্যামলী বললো – “তোমার মালিককে গিয়ে বলো – গাড়ি সারিয়ে দাম না মেটানোর জন্যে শ্যামলী পাল সত্যাগ্রহ করছে !”
চোখ পাকিয়ে পুলিশ পুঙ্গব জিজ্ঞাসা করে “কে গাড়ি সারিয়ে দাম মেটায় নি?”
শ্যামলী ব্যঙ্গ করে বললো – “ সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ? যাও না তোমায় যে পাঠিয়েছে , তাকেই জিজ্ঞাসা করো , শ্যামলী পাল তার মিস্ত্রী মার খেয়েছে বলে থানায় এলে, বাবুদের এফ আই আর নেবার ফুরসৎ হয় না, আর রঘুপতি রাঘব রাজা রাম এর বাড়ির সামনে রামধুন গাইলে, পুলিশ কর্তাদের ঘুম ছুটে যায় ?”
এমনি সময় কোথা থেকে শ্রমিক নেতাটি এসে গলার শির ফুলিয়ে স্লোগান দিতে গেল । অমনি সাদা পোশাকের পুলিশের সাথে লেগে গেল ধ্বস্তাধ্বস্তি । শ্যামলী বার বার বোঝাতে চাইল – “এ একটা অহিংস অসহযোগ আন্দোলন । আপনারা কেউ প্ররোচনায় পা দেবেন না।“ তার গলা সমবেত হট্টগোলে চাপা পড়ে গেল। গণ্ডগোল একটু থিতু হতে একটা বড়ো কালো গাড়ি থেকে বিশ পঁচিশটা উর্দি ধারী পুলিশ নিয়ে থানার ওসি নামলেন। শ্যামলী লক্ষ্য করলো কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোঁড়বার জন্যে জনা তিনেক পুলিশ পজিশন নিয়ে ফেলেছে। ওসি এসে বললেন “ এলাকায় শান্তি ভঙ্গ করা আর সরকারী কর্মচারীর কাজে বাধা দেবার অভিযোগে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল ।“ কালো গাড়ির ভেতর শ্যামলীকে সেঁধিয়ে যেতে দেখে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল ।