• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১)

পর্ব – ১

১০৬
শ্যামলী আন্দাজ করেছিল লোহামাফিয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে না । তাই জন্যে এফ আই আর করতে দিল না। কারখানায় ফিরে এসে জানতে পারলো প্রবল জ্বর নিয়ে ঘরে ফিরে গিয়েছে হেড মিস্ত্রী। অমনি তাকে তার বাড়ি গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে হল তার। গেল মিস্ত্রীর বস্তিতে একটা ছেলেকে নিয়ে। তখন সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। নোংরা গলি ধরে বেশ অনেকটা যেতে হল শ্যামলীকে। কে জানে তার শহরের আনাচে কানাচে এত নোংরা গলি আছে! এসে দেখছে, তাই জানতে পারছে। খোলা কাঁচা নর্দমা। শিশুরা মলত্যাগ করছে প্রকাশ্যে। মলত্যাগ করতে করতে নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছে। কলের তির তির করে পড়তে থাকা জলের আশায় লম্বা লাইন। শ্যামলীর খুব মন খারাপ হয়ে গেল।
মিস্ত্রীর ঘরে পৌঁছে দেখল সে জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে । তার বউটির বয়স কম। সে শ্যামলীর সাথে কথা বলবে কি, ভেবেই অস্থির । মালিক কখনো মজুরের অসুখে বাড়ি বয়ে দেখতে আসে, সে জানেই না। আর মেয়েমানুষ কারবার চালায় এটাও তার জ্ঞানের সীমার বাইরে। শ্যামলী চিকিৎসা খরচের দরুণ কয়েকটি টাকা দিতে সে নিঃশব্দে গ্রহণ করলো । মিস্ত্রীর মা ঘরের বাইরে বসে আছে । ঘোলা চোখে পিট পিট করে তার দিকে তাকাচ্ছেন বৃদ্ধা । শ্যামলী বুঝতে পারলো বুড়ি ওই ঘরের বাইরেই কাঁথা কানি সম্বল করে থাকে । এ্তে কেউ কিছু অস্বাভাবিক মনে করে না। বর্ষার দিনে নালা নর্দমা ভেসে গেলে এদের কি হয় ভেবে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠছিল সে। মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিল সন্ধ্যায় কাঁচা কয়লার ধোঁয়ায় বস্তি অন্ধকার হয়ে আছে । ঘরে ঘরে এক আধটি করে যে বাল্ব জ্বলছে, তাদের গায়ে তেলচিটে ময়লা। তার মধ্যেই কোথাও কোথাও তাসের আড্ডা বসেছে। ছোট বাচ্চারা তেলেভাজা ফুলুরির দোকানের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে । লেখাপড়ার কোনো পরিবেশ নেই ।
মিস্ত্রীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। মিস্ত্রীর বউ কিছু বললো না। ‘আবার আসবেন’, ‘আপনি এসেছেন বলে খুব ভরসা পেলাম’ , এসব সাজানো কথা বলা এদের অভ্যাসের বাইরে। বাইরে বেরোতে হেলে পড়া সূর্যের আলো কেমন ঠিকরে এসে তার চোখে লাগছে। শরীরের ভেতরে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে । হঠাৎ এক ঝলক তেতো জল ভেতর থেকে গলায় উঠে এলো তার । বমি পাচ্ছে । শরীর পাক দিয়ে গ্লানি উদগীরণ হল সহসা। রাস্তার ধারেই নর্দমার দিকে মুখ করে বসে পড়লো সে। বমি হয়ে যেতে ভারি দুর্বল লাগছে নিজেকে। হাত ধরে টেনে তুললো সাথে আসা মজুর ছেলেটা । শ্যামলী তার মুখের দিকে চাইলো । হ্যাঁ , বছর পনেরোর এই ছেলেটাই একদিন কোমরে ছুরি নিয়ে ঘুরঘুর করছিল তার বাড়ির কাছে। বলেছিল “ ছোড়দি, তোর কেউ কোনো ক্ষতি করলে তার গলায় ছুরি চালিয়ে দেব ।” এর সাথে সেদিন আরো একটি কিশোর ছিল। সেদিন খুব রাগ হয়েছিল এদের উপর। আজ সেই কথা মনে পড়ে ম্লান হাসি খেলে গেল তার মুখে। এমন একটা পরিবেশে শৈশব থেকে কেউ বেড়ে উঠলে তার ভেতর যুক্তি বুদ্ধি পরিশীলন এঁকে দেওয়া শক্ত। পরে মনে হল বাইরের পরিবেশটাই কি সব? মানুষের নিজের অস্তিত্বের ভেতরে কি আর একটা স্রোত খেলা করে না ?  ভেতরের ইঙ্গিত কি কোনো কোনো সময় জেগে ওঠে না ?
কিশোর ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো “ ছোড়দি, আজ সারা দিন কিছু খাও নি , না?”
১০৭
হেড মিস্ত্রী নেই বলে কারখানাটা কেমন ঝিম মেরে আছে । শ্যামলী আন্দাজ করলো যে কারিগরদের মনে একটা ভয় কাজ করছে। এ দেশের সাধারণ মানুষ মাফিয়াদের ভয় পায় । পুলিশকে আরো বেশি ভয় পায়। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের বেঁচে থাকাটাই একটা আশ্চর্য ব্যাপার । ভয়ে ভয়ে টিম টিম করে বেঁচে থাকা মানুষ গুলি জানেই না, বাঁচার আনন্দ কাকে বলে। শ্যামলীর মায়া হল । নিজের অফিসঘর থেকে বেরিয়ে সে কারিগরদের কাছে ঘুরঘুর করতে লাগলো। তারপর বললো “ তোমরা আমাকে অনেকদিন মুড়ি তেলেভাজা খাওয়াও নি। আজ খিদে পেয়েছে । খাওয়াতে হবে।“
একজন মিস্ত্রী বললো “ ছোড়দি, কাল কিছু পার্টস চাই । না আনালে কাজ আটকে যাবে ।“
তার সাথে মিলে শ্যামলী মোটর পার্টসের স্টক মেলাতে বসলো । ফোনে চাহিদার কথা জানিয়ে দিল মহাজনকে । তারপর ক্যাশবুক মেলাতে বসলো ।
রাত হলে হাত ব্যাগে টাকা গুছিয়ে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো শ্যামলী । কিশোর মজুরটি তাকে একা ছাড়তে চাইলো না। “ দিদি, আজ বমি করেছ । তোমায় বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে আসি ?”
“ না, তুই পালা । সকাল থেকে খাটছিস । যা বাড়ি যা।“
মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকে ছেলে ।
“কাল এসে চেক নিয়ে যাস। মহাজনের গদিতে পৌঁছে দিবি । এখন বাড়ি যা।“
তবু ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকে । আর সময় নষ্ট করে না শ্যামলী । জোর কদমে হাঁটা দেয়। টের পায় পিছন পিছন ছেলেটি আসছে । বেশ কিছুটা তফাত রেখে আসছে। অশ্বথ গাছটি ছাড়িয়ে অনেকটা উঠে গিয়েছে চাঁদ ।
বাড়িতে গিয়ে দেখলো দিদি জামাইবাবু এসেছেন । জোর করে মুখে একটা হাসি টেনে আনতে চাইলো শ্যামলী । দিদি তাকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠলো – “ চেহারার কি দশা করেছিস? দেখলে মনে হবে কারখানার মজুর একটা। “
জামাইবাবু ঠাট্টা করতে চাইলেন ”তাতে তো ভালই হবে । আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাথে খাপ খাবে। তা লেখাপড়াটা একেবারে বাদ দিচ্ছ না তো শ্যামলী ? “
“ খেটে খুটে দু মুঠো অন্ন জোগাড় করে তবে না লেখাপড়া ? গরিব মেয়ের যেমন হয় আর কি?”
সবিতা পিসি তাকে ধমকে উঠলেন “ এই মেয়েটার যতো পাকা পাকা কথা। এই তো বয়েস। এই বয়েসে কোথায় সাজুগুজু করে থাকবি , ফুর্তি করবি , তা না, কেবল ভারি ভারি কথা ! যা, গা ধুয়ে নে । “
ধীরে ধীরে পা টেনে টেনে নিজের ঘরে চলে যায় মেয়ে । তার চলে যাওয়া দেখে পিছন পিছন আসে মা। “ হ্যাঁ রে শ্যামলিমা, তোর শরীর খারাপ ?”
মায়ের বুকে একটু মুখ রেখে একটু কান্না এসে যায় তার। গলা দিয়ে বেরোয় না যে আজ সারা দিন খাওয়া জোটে নি। থানায় তারা বসিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ । তার পরে অসুস্থ মিস্ত্রীর বাড়ি গিয়ে সেখানে নোংরা গলির দুর্গন্ধে গলা দিয়ে সবুজ পিত্তি পড়া জল উঠেছে । নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে মায়ের হাতে সংসার খরচের টাকা গুণে দেয় মেয়ে। ডায়েরি বের করে বলে “মা এখানে একটা সই করে দাও ।“ মা আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখতে থাকেন “ বাসন্তীবালা পাল।“

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।