• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯)

পর্ব – ৯

১০১
নিজের কলেজ ছুটি হলে অনেক সময় মহকুমা গ্রন্থাগারে যায় শ্যামলী । সেখানে অনেকগুলি খবরের কাগজ থাকে। সে সবে আগ্রহ আছে তার। আর নানা রকম সাময়িক পত্র। আর কিছুটা এ বই সে বইয়ে চোখ বোলায় । গ্রন্থাগারের পাশে ছেলেদের কলেজ । সেখানে চীপ ক্যান্টিনে যেতে ইচ্ছে করে । কিন্তু পেরে ওঠেনি এখনো। আজ কলেজ থেকে সোজা বাড়ি ফিরবে ভাবল । কি ভেবে কারখানায় ঢুকে পড়লো। কলেজ গেলে সাধারণতঃ বাড়িতে ফিরে স্নান খাওয়া না করে সে গ্যারাজে ঢোকে না। আজ ঢুকে দেখলো তার অফিসঘরের সামনেটায় সকলে মিলে মিটিং করছে ।
“ কি ব্যাপার , এখানে কি হচ্ছে?”
শ্রমিকেরা কেউ কেউ অপ্রস্তুত হয়ে দেখিয়ে দিল প্রবীণ শ্রমিক নেতাটিকে। এই নেতাটিই বড়ো মুখ করে তাকে বলেছিল – আমরা শ্রমিক সংগঠনের লোকেরা কারখানা মালিকের থেকে কিছু পেয়ে থাকি। তারপর কথায় কথায় নিজের বিবাহিতা কন্যার অকালমৃত্যুর কথা আর সেই জামাইয়ের সাথেই নাবালিকা ছোটো মেয়েটির বিয়ের কথা তুলেছিল। সেদিন এই নেতাটির প্রতি মানুষ হিসেবে সমবেদনা হয়েছিল। আজ হলো রাগ।
“পাল অটোমোবাইলস-এ এ সময় আপনি কি করছেন?”
বেশ নরম গলায় প্রবীণ নেতাটি বললেন , “গরিব ভুখা শ্রমিকে আর কি করবে মা, আমরা মিটিং করছিলাম।“
“আমাদের কারখানায় আপনাদের মিটিং, কই কেউ তো আমার পারমিশন নেন নি!”
“মা গো, শ্রমিকের আন্দোলন গড়ে তুলছি, সব সময় এ রকম নিয়ম মেনে তো কাজ করা আমাদের পক্ষে শক্ত।“
একটা মাঝবয়সী লোক বলে উঠলো “ শ্রমিক কি মালিকের সঙ্গে আঁতাত করে সংগঠন করবে?”
“আপনি কে? আগে তো কোনদিন দেখি নি ?” শক্ত গলায় জানতে চাইল শ্যামলী।
প্রবীণ নেতাটি বললেন “ তুমি কলেজ থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে, তা তো আমরা জানতাম না। সে জন্যে…”
“সে কি কথা, আমার কারখানায় আমাকে লুকিয়ে মিটিং করবেন কেন? উনি কে?” শ্যামলী ছাড়বার পাত্র নয়।
“ও এই রাস্তার দুধারে যে সব শ্রমিক সংগঠন আছে তাদের সাধারণ সম্পাদক।“
শ্যামলী দেখলো সাধারণ সম্পাদক লোকটি বেশ একবগগা মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নেতাদের শুনিয়ে শ্যামলী হেড মিস্ত্রীকে হুকুম দিল “আমার অজান্তে এখানে কিছুই হতে পাবে না। এটা যেন তোমাদের মনে থাকে।“
সাধারণ সম্পাদকটি যেন আকাশ থেকে পড়লেন এমন ভাণ করে বললেন ‘ কি বলছেন ম্যাডাম, শ্রমিকের অধিকার আন্দোলন করা। সে আন্দোলনের জন্য সংগঠন, আর সংগঠন দাঁড় করাবার জন্যে মিটিং। মিটিং তো ম্যাডাম আমরা করবোই।‘
শ্যামলী তাকিয়ে দেখল বয়স্ক নেতাটির চোখেও সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের প্রতি পুরো মাত্রায় সমর্থন রয়েছে।
‘শুনুন, আপনার বইতে শ্রমিক আন্দোলন বলতে কি বোঝায় আমি জানি না। কিন্তু আমার কারখানায় আমার বাবার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বহু চুরি হয়েছে। বহু মোটর পার্টস বেরিয়ে গেছে । দেনায় ডুবতে বসা কারখানা থেকে একে একে বেরিয়ে গিয়েছে বাবার হাতে তৈরি কাজ জানা ছেলেরা। সেদিন আপনার সংগঠন কোথায় ছিল?’
“ আপনার ক্রাইসিস কি আমাদের মেটাতে হবে না কি? আপনারা ভুলভাল কাজ করবেন, আর যতো দায় আমাদের?” সাধারণ সম্পাদকটি ফুঁসে ওঠেন।
‘বেশ বলেছেন তো ! কারখানা বাঁচলে শ্রমিক আর তার পরিবার বাঁচে সেটা জানেন? সেই শ্রমিক যে মুদি দোকান থেকে চাল ডাল নুন কেনে, সে সব দোকান চাঙ্গা থাকে সেটা জানেন ? “
প্রবীণ নেতাটি হস্তক্ষেপ করেন । বলেন, ‘মানিয়ে নাও মা, আমরা মিটিংটা সেরে ফেলি।‘
‘দাঁড়ান আপনি। কিসের শ্রমিক সংগঠন বোঝাবেন আপনি? এই যে চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলেরা কাজ করে, ওদের এসব কাজ করার বয়স হয়েছে? আপনারা ওদের পড়াশুনার কথা ভেবেছেন? এই যে আমি দায়িত্ব হাতে নেবার আগে শ্রমিকেরা রাস্তার ধারে সর্ব সমক্ষে প্রস্রাব করতো, এ নিয়ে শ্রমিক সংগঠনের কোনও সচেতনতা ছিলো ? কারখানায় ফার্স্ট এইড বক্সের কোনো ব্যবস্থা আমার আগে ছিলো?’
নেতারা চুপ করে যান ।
শ্যামলী বলে, “শুনুন, আপনাদের সংগঠন আসলে রাজনৈতিক দলের লেজুড় । শ্রমিক দরদের নাম করে আপনারা ভোটের স্বার্থে কাজ করেন। কারা রাজনীতির মসনদে বসবে, সেই নিয়ে আসলে আপনাদের মাথা ব্যথা।“
সাধারণ সম্পাদকটি ক্ষেপে ওঠেন । “ আমাদের সংগঠনের নামে নিন্দে মন্দ করবেন না বলে দিলাম।“ এই বলে সে শ্রমিক সংহতির পরিচিত ধ্বনি তুলতে চায়। তার নাড়া লাগানোয় অনেকেই সাড়া দেয় না।
শ্যামলী বলে “শুনুন, আপনি কোথায় কাজ করেন?”
নেতাটি চুপসে যান।
“শুনুন, আপনি শ্রম না করে খান। আর গরিব শ্রমিক আপনার চটকদার কথায় ভুলে আপনাকে চাঁদা দেয়। আপনি শ্রমিক নন, একটা সামান্য তুচ্ছ পরগাছা।“
নেতাটি তিড়বিড়িয়ে জ্বলে উঠতে চান। তাকে দমিয়ে শ্যামলী বলে “আপনারা এ ধরণের শ্রমিকেরা নিজের নিজের বাড়িতে এক একটি সুলতান। বৌ মেয়েরা আপনাদের হুকুমের চাকর। আপনার বাড়ির মেয়েরা সর্বহারার সর্বহারা। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখুন তো – আপনার মেয়ে মরে যায় বিনা চিকিৎসায় । আর সেই শয়তান জামাইকে আগে থেকে চিনতে পারেন না আপনি। তার হাতে আবার নতুন করে নাবালিকা মেয়েটাকে তুলে দিতে বাধে না আপনাদের। কিসের শ্রমিক আপনারা? সব এক একটা ভিজে বেড়াল। রাতে মদ গিলে জুয়া খেলে বাড়িতে গিয়ে বৌ মেয়েকে পেটানো ছাড়া আপনারা কি জানেন?”
এক নিঃশ্বাসে এতগুলি কথা বলে শ্যামলী হাঁপাতে থাকে।
ছোট একটি ছেলে একটা গ্লাসে জল এগিয়ে দেয়। বলে “ছোড়দি একটু জল খাও।“ অল্পবয়সী শ্রমিকটির দিকে চেয়ে মায়া কাজল নেমে আসে শ্যামলীর চোখে।
১০২
কারখানার হিসেবের খাতা আর মোটর পার্টসের স্টক রেজিস্টার নিজের হাতে হাল নাগাদ করায় শ্যামলী । তার পর টাকার তাড়া নিজের কাছে নিয়ে হেড মিস্ত্রীকে বলে কি কি লাগবে লিস্ট করে মহাজনের গদীতে পৌঁছে দিন। কাল ডেলিভারির সময় কত টাকা লাগবে তাও জেনে আসবেন। আমি চেক বাবাকে দিয়ে কাটিয়ে বাড়িতে রেখে কলেজে যাব । মহাজনের সাথে লেনদেন শ্যামলী ব্যাংকের মাধ্যমে করতে চাইছে। এতে নগদ টাকা নিয়ে নাড়া চাড়ার বিপদ কমে । আর ব্যাঙ্কের সাথেও নিয়মিত সম্পর্ক থাকে ।
বাড়ি ফিরে দ্রুত পায়ে বাবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে সে দেখলো একটি সুদর্শন যুবক বসে আছে । কে সে? আগে তো কোনোদিন দেখে নি ! তাকে দেখেই বুকটা ধড়াস করে উঠলো তার। কোনদিন তো কোন পুরুষকে দেখে তার এমন হয় নি। সে দ্রুত সরে এল ঘরের চৌকাঠ থেকে । বেশ টের পেল আগন্তুক তাকে দেখেছেন। বাবা তাকে ডাকলেন “ শ্যামলিমা , ঘরে আয়। এত দেরি কেন করলি মা?”
শ্যামলী পালিয়ে বাঁচল । নিজের ঘরের দিকে গিয়ে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সবিতা পিসিকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলো সে।
“ পিসি, লোকটা কে?”
পিসি যেন কিছুই জানে না এমন ভাণ করে জানতে চাইলো “কোন লোকটা?”
“ আরে , বাবার ঘরে যে লোকটা বসে আছে , সে লোকটা কে?”
“ কেন, তুই জিজ্ঞেস করতে পারিস নি … বলতে পারিস নি … ও লো মিনসে, তুই আবার কোন মুখপুড়ির বেটা রে?”
“ ছিঃ, অমন করে কেউ কথা কয়, অসভ্য কোথাকার? বলো না পিসি, লক্ষ্মীটি পিসি, কে লোকটা?”
সবিতা পিসি গ্যাঁট হয়ে বলে “ আমি বলবো না। যে জাঁহাবাজ মেয়েছেলে তুমি … খোদ দারোগা বাবুকে চোখ রাঙিয়ে ধমক দিলে সেদিন … নিজে চোখে দেখেছি …। আর সেই তো নকুড় বাবুর ছেলের বন্ধুগুলো … বাবা , অতোগুলো সোমত্ত বেটাছেলের সামনে তুমি যেমন সওয়াল করেছিলে … ভাবলেই আমার হাত পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায় ! আমি কারও নাম বলবো না বাবা ..।“
রাগে সবিতা পিসির পিঠে গুম করে একটা কিল মারে শ্যামলী । “ জানো তবু বলবে না, মজা পেয়েছো না?
খল খল করে হাসিতে ভেঙে পড়ে পিসি … “ ওরে মেয়ে, এ যে আমাদের ছোট জামাই হবে রে?”
মুহূর্তে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় মেয়ের …। এই লোকটার পরিবার থেকেই তার চরিত্রে অপবাদ দিয়ে চিঠি এসেছিল ? এদের অপবাদই তার কলেজে তাকে প্রিন্সিপ্যালের কাছে নিদারুণ অপমানিত করে দিয়েছে? এদের জন্যেই কি কোর্টে বিপক্ষের উকিল তাকে সর্বসমক্ষে হেনস্থা করতে সাহস পেয়েছে? শ্যামলীর নিঃশ্বাস দ্রুত হয় । রক্ত যেন আরবী ঘোড়া হয়ে দৌড়চ্ছে রগের শিরা দিয়ে । ক্রোধ যেন এখনই আগুন হয়ে বেরোবে …। সে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকে দোর দেয় । তারপর লাগোয়া স্নানঘরে ঝাঁঝরি কলের ধারাজলের নিচে নিজের নারীত্বকে মেলে ধরে । আর তার চোখের জল ধারাজলের সাথে মিলে মিশে বহে যেতে থাকে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।