• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৬)

পর্ব – ৬

৬৫
শোনো তোমরা, কারবারটাকে যদি নতুন জীবন দিতে হয়, তাহলে বকেয়া আদায় না করে উপায় নেই। অনেক লোককে তোমরা নগদে পেমেন্ট না নিয়ে ছেড়ে দিয়েছো। পরে দিয়ে যাবে বলে তারা দেয় নি। আমি হাতখাতা দেখে সেই সব লোকের নাম পেয়েছি। এদের কাছে পাল অটোমোবাইল টাকা পাবে। কারখানা চালু রাখতে টাকা উদ্ধার করতেই হবে।
ছোড়দি, টাকা ওরা দেবে?
চাইতে হবে। বুঝিয়ে বলবে, তোমার গাড়ি সারাতে এনেছিলে। আমরা বিশ্বাস করে মোটর পার্টস দিয়েছি, তেল মোবিল ঢেলেছি , গায়ে তেল কালি মেখে মজুরি খেটেছি , তেল কালি ওঠাতে সাবান দিয়ে স্নান করতে হয়েছে। কারখানায় কারেন্ট পুড়েছে। এবার টাকাটা না দিলে চলবে কেন?
কি করতে হবে ?
এই চিঠি বানিয়েছি। এই নাম এর লিস্ট। নাম ধরে ধরে গিয়ে চিঠি দেবে। পেয়েছে বলে সই করিয়ে আনবে।
পোস্ট অফিস দিয়ে পাঠালে হত না?
না, হতো না। যারা গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করেছো, তারা যাবে। আর টাকা চেয়ে আনলে মাইনে হবে। বুঝতে পেরেছো? ঘর থেকে টাকা বের করে তো মালিক দেবে না!
কেন, কারবার তোমাদের, আমাদের জড়াচ্ছ কেন?
একটা বুদ্ধিমান ছেলে বলে উঠলো।
আপনি সেদিন আসেন নি। এরা যারা এসেছিলো , তারা আমার কাছে কথা দিয়েছে সবাই মিলে কারখানাটাকে দাঁড় করাবে। কি তোমরা বলেছিলে তো?
হ্যাঁ হ্যাঁ ছোড়দি , তুমি তখন একটা কবিতা বললে।
আমার ভাণ্ডার আছে ভরে, তোমা সবাকার ঘরে ঘরে …
সবাই ঠিক করলো, যারা গাড়ি সারিয়ে টাকা মেটায় নি, তাদের বাড়ি যাবে। চিঠি পৌঁছাতে।
শ্যামলী বলল – কিন্তু একটা কথা, কেউ মুখ খারাপ করবে না। খারাপ কথা বললে তুমি দুটো ভাল কথা বলবে।
তা কি করে হয়? গাল দিলে কান পেতে শুনবো? দু ঘা দিয়ে দেবো না? শ্রমিকের অভিমান গর্জে ওঠে।
না দেবে না। মারবে না, খারাপ কথাও কইবে না।
এক গালে চড় মারলে আর এক গাল বাড়িয়ে দেব? ও হবে না।
কেন হবে না? মারামারি করে জিততে পারবে? মারামারি করে গরিব মানুষ জেতে ? পুলিশ তোমাকেই কেস দেবে। বলবে – পালের গ্যারাজের লোকেরা গুন্ডাবাজি করতে এসেছিল। ডাকাতি করতে এসেছিল। পুলিশে ছুঁলে ক’ ঘা?
ছোড়দি, আমাদের ছেড়ে দাও। আমাদের মুখ দিয়ে খারাপ কথা বেরিয়ে যায়। তোমার মতো অতো গুছিয়ে বলতে পারি না। হাত উঠে যায়। অল্পবয়সী শ্রমিকটি বলে ওঠে।
মুখ্যু, সে তোরা নিজেদের পাড়ায় আপন ভাইকে গাল দিস , নেতা পুলিশের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর অভ্যেস আছে তোদের? তোরা পেটালে বড়ো জোর নিজের মাকে, বউকে পেটাস। তার বেশি মুরোদ হয় তোদের?
আমাদের মারলে মার খাবো। গাল দিলে গাল শুনবো ‘খন। কিন্তু দিদি, তোমার নামে কিছু বললে ছেড়ে কথা বলবো না। হেস্তনেস্ত করে আসবো।
দ্যাখো, এটা একটা লড়াই। তোমায় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কোনো কারণেই মাথা গরম করলে চলবে না। চিঠিটা হাতে দেবে, সই করতে বলবে। ওরা চিঠি নিক, না নিক, যাই করুক না কেন, তোমরা আজ শান্ত থাকবে।
তোমার নামে বাজে কথা বললেও?
হ্যাঁ, থাকবে। এটাই আমার আদেশ।
৬৬
কলেজ থেকে ফিরে কারবারের খাতা নিয়ে বসলো শ্যামলী। মা নিচ থেকে খেতে ডাকল। শ্যামলী শুনলো না। সবিতা পিসি এসে পিঠে হাত রাখলো।
“খেয়ে নে মা। মুখটা শুকিয়ে গিয়েছে। পিত্তি পড়ে যাবে।“
তার মুখের দিকে চাইলো শ্যামলী। “কারখানার লোকগুলো কি খাচ্ছে জানতে চেয়েছো ?”
“ভগবান আমায় অতোটা বুদ্ধি দেয় নি রে। ছোটো বয়সে সব হারিয়েছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে রক্তের সম্পর্কের লোকেরা। তোর বাবা আশ্রয় না দিলে ভেসে যেতাম। “
“ চলো যাচ্ছি।“ পিসির হাত ধরে নামতে থাকে মেয়ে।
খেতে খেতে টের পায় কারখানার লোকগুলো এসেছে। চটপট খাওয়া সেরে নিজের ঘরে একরকম দৌড়ে গিয়ে কলেজের শাড়ীটাই পরে আসে শ্যামলী।
লোকগুলো বৈঠকখানা ঘরে মাদুর পেতে বসেছে। সোফা ফাঁকা।
“কি খবর? কি রকম হল?”
“ভালই হয়েছে। অনেকে টাকা দিয়েছে।“ টেবিলের উপর ব্যাগ উজাড় করে দেয় ওরা।
“ এতে কতো আছে?”
বড়ো নোটে আড়াই হাজার আছে। খুচরো গুলো গুনি নি।“ বুড়ো শ্রমিকটি বলে।
কারখানা তালাবন্ধ করার দিনে যাকে ধুপ কিনতে দিয়েছিল শ্যামলী, সে এখন অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছে। খুচরোগুলো তাকেই গুনতে দিলো শ্যামলী। তার পর একটা অল্পবয়সী শ্রমিককে ডেকে জানতে চাইলো “ বলো তো, টাকাটা কার?”
“কার আর? তোমার টাকা।“ চটপট বলে ছেলেটি।
একজন প্রবীণ শ্রমিকের কাছে জানতে চাইল শ্যামলী “ আপনি বলুন তো, টাকাটা কার?”
“ তোমার বাবার কারবার। তাঁর টাকা।“
“কারো উত্তর ঠিক হচ্ছে না। কে বলতে পারে?”
দড়ি পাকানো চেহারার এক যুবক বললো “ টাকা যখন যার কাছে থাকে তার। “
ওর কথায় কান না দিয়ে শ্যামলী বললো “ এই টাকাটা কারবারের। কি কথাটা পছন্দ?”
সবাই একবাক্যে বলে ওঠে “ হ্যাঁ।“
“কিন্তু কেন? কেন বলছি এই টাকাটা কারবারের ?”
সবাই শ্যামলীর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। তোতলা শ্রমিকটি ততক্ষণে খুচরো টাকা সব গুণে ফেলেছে। সে বলে উঠলো – “ছোড়দি সব মিলিয়ে দু হাজার ন”শো আটাত্তর টাকা।”
শ্যামলী তার দিকে না চেয়ে বলে “কই ? কে বলবে এই টাকাটা কারবারের কেন?”
কারো মুখে উত্তর যোগায় না।
শ্যামলী বলে “কারবার করতে কি লাগে?”
সবাই একযোগে বলে “ টাকা।“
না, ওকে বলতে হবে মূলধন , ক্যাপিটাল।
আর কি লাগে?
জায়গা।
হ্যাঁ ঠিক বলেছো। জায়গা একটা লাগে। আর কি লাগে?
সবাই একসাথে বলে “গতর”। “ না, না, খাটনি” বলে কেউ শুধরে নেয়।
“হ্যাঁ, গায়ে গতরে ঘাম ঝরাতে হয় বই কি। এটাকে বলে লেবার।“
“ হ্যাঁ , আমরা লেবার, তোমরা মালিক”
ব্যাঙ্ক থেকে লোন করেছে কে?
তোমার বাবা।
মেশিন কিনেছে কে?
তোমার বাবা।
জমিটা কার?
তোমাদের।
শোনো তোমরা। আমার বাবা যদি কারবারে টাকা না ঢেলে ব্যাঙ্কে রাখত , তাহলে কি হতো ?
তাহলে কারবার হতো না।
না তা বলছি না, ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে কি হতো।
কি আর হতো? সুদ পেতে তোমরা।
আর এই জমি বাড়ি ভাড়া দিলে ?
বাড়ি ভাড়া পেতে তোমরা।
আর বাবা যে কিছু খাটাখাটনি করতো , সেটা অন্য কোথাও করলে?
মাইনে পেত।
আর তোমরা এখানে খেটে মজুরি পাও।
তাহলে চারটে জিনিস কারবার গড়ে দেয়, এক জমি, দুই মূলধন, তিন লেবার, আর কি?
সবাই চুপ করে থাকে।
কই বলো ?
ছোড়দি, তুমিই বলো।
আর হচ্ছে সংগঠন। কখন কি করতে হবে, কি করে কি যোগাড় হবে। ম্যানেজ করা।
হ্যাঁ ছোড়দি। ম্যানেজ।
এই কারখানাটা ম্যানেজ ভালো করে হয় নি। সেটা ঠিক ?
শ্রমিকরা বুঝে পায় না কি বলবে? এই মেয়েটা কি তার বাবার দোষ ধরছে?
কারখানাটাকে সবাই মিলে দেখতে হবে। যেমন খুশি টাকা নিলাম, যা খুশি খরচ করলাম, তা হবে না।
আজ সবাই আমার থেকে কিছু টাকা নিয়ে যাও। ধার হিসেবে।
ধার কেন?
বিনা সুদে ধার।
হ্যাঁ, কিন্তু ধার কেন?
কারখানা তো খোলে নি। কাজ চালু হয় নি। কোনো গাড়ি সারাও নি। তোমার পেট যাতে চলে তাই কারবার তোমায় সাহায্য করছে বিনা সুদে। কাজ চালু হলে, মূলধন তুলে আনতে পারলে সেদিন থেকে মজুরি পাবে।
সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল।
৬৭
বাবা, কিছু বকেয়া টাকা আদায় করতে পেরেছি। ওই টাকা থেকে ইলেকট্রিক বিল শোধ করতে পাঠিয়ে দিলাম। আর আজ যারা ঘুরে ঘুরে টাকা আদায় করে আনল ওদের লোন দিয়েছি।
লোন ?
হ্যাঁ বাবা, গরিব লোক সব। লোন না পেলে না খেয়ে মরবে।
কিন্তু লোন কেন শ্যামলিমা ?
বাবা, লোন না দিয়ে উপায় কি বাবা ?
না, তুমি ওদের মজুরি হিসেবেই টাকা দিতে পারতে।
বাবা, আমার কারখানা এখনো খুলে উঠতে পারি নি। এটা আমাদের কারখানার বকেয়া আয়। এই আয়টা বাস্তবে যে সময় হয়েছে, তখন ওদের মজুরি দিয়েছ। একটা কাজ করে ক’বার মজুরি পাবে বাবা? লোন দিয়েছি। শোধ করে দেবে এখন।
এখন বুঝতে পারছি কেন আমার মেয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় গিয়ে প্রাইজ না নিয়ে ফেরে না।
এটা বিতর্কের ব্যাপার নয় বাবা, কারখানা একটা সত্ত্বা , ব্যক্তিমানুষ একটা সত্ত্বা। কারখানা থেকে খুশি মতো টাকা তুলে নেওয়া যায় না।
শশাঙ্ক পালের চোয়াল ঝুলে পড়ে। মেয়ের দিক থেকে মুখটা ঘুরিয়ে নেন তিনি।
বাবা, আমার কথায় তুমি কষ্ট পেয়ে থাকলে আমায় ক্ষমা কোরো। আমি কারবারের নীতি হিসেবে ও কথা বলেছি। আর আমি প্রাণপণে নীতি ধরে থাকার চেষ্টা করে যাবো।
নীতি তোর একলার আছে, আর কারও নেই ?
বাবা, আমি কারবারের নীতির কথা বলেছি। কারবারের নীতিতে একরোখা হয়ে থাকলে সেই নীতি তোমার কারবারকে বাঁচাবে। মোট কথা কারবার আর ব্যক্তি মানুষ আলাদা আলাদা। গুলিয়ে ফেললে কষ্ট পেতে হবে।
আলোচনার মধ্যে সবিতা পিসি এসে পড়ে।
হ্যাঁ দাদা, ফলগুলো এখনো খাও নি ? ও শ্যামলী তোর বাবা যে ফলগুলো খায় নি, সেটা একটু দেখিস নি মা ? বড়ো হয়েছিস, এগুলো তো একটু দেখবি।
শশাঙ্ক পাল খসখসে গলায় বলেন – আমি ফল খাবো না। বেয়াক্কেলের মতো বিছানায় পড়ে আছি। আমার দরকার নেই ফল খাবার।
সে কি কথা দাদা? সেরে উঠতে হবে তোমায়, আবার নতুন করে সব শুরু করতে হবে। হাল ছাড়বে কেন? কিরে শ্যামলিমা , বাপ বেটিতে মন কষাকষি করেছিস না কি?
গম্ভীর মুখে ফলের বাটিটা টেনে নিয়ে শ্যামলী বলে পিসি তুমি এখন একটু যাও। বাবাকে আমি ফল খাইয়ে দিচ্ছি।
শশাঙ্ক পাল বিরক্ত হয়ে বলেন – আমি ফল খাবো না। তোরা আমায় বিরক্ত করিস না।
বাবা, তুমি এই না গর্ব করছিলে – আমার মেয়ে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় গিয়ে প্রাইজ না নিয়ে ফেরে না। আমি যেটা ঠিক মনে করেছি সেটা তোমার কাছে মন খুলে বলেছি। তুমি তোমার যুক্তি দিয়ে লড়বে। সেন্টিমেন্টাল হোয়ো না বাবা। আমার ওপর রাগ করছো করো , ফলগুলো মা কষ্ট করে আনাচ্ছে। সেগুলো নষ্ট করা ঠিক হবে না।
তোর ওপর আমার কোনো রাগ নেই। তুই ঠিক কথাই বলেছিস। কারবারের নিয়ম মানা হয়ে ওঠেনি।
হ্যাঁ বাবা, সবাইকে নিয়ে হুল্লোড় করে অতো বেড়াতে যাওয়া , অন্নপূর্ণা পুজোয় অতো খরচা করা , সব তোমার ব্যক্তিগত আয় ছিল না বাবা। তুমি কারবারের সাথে নিজের পরিবারকে গুলিয়ে ফেলেছিলে।
হ্যাঁ রে শ্যামলী , সবাইকে নিয়ে আনন্দ অনুষ্ঠান করা খারাপ কাজ? আমি ওদের পর ভাবতে পারি নি। সেটাই আমার দোষ ?
বাবা, কারবার চলে অর্থনীতির নিয়মে। যে টাকাটা কাস্টমার দিয়ে গেল, সবটাই তোমার লাভ নয়। তুমি আগে দ্যাখো , কি কি খরচ তোমায় করতে হয়েছে , কি কি ঝক্কি আছে, কি কি মেশিন বসে যেতে পারে, সেগুলোর সারাইয়ের ফান্ড আছে কি না, ব্যাঙ্কের লোন নিয়মিত শোধ হচ্ছে কি না …। বাবা, তোমার জন্যে নয়, আমি নিজের শিক্ষার জন্যে এগুলো নিয়ে আলোচনা চাইছি। আমি পাল অটোমোবাইলস কে বাঁচাতে চাইছি বাবা। তুমি আমায় গাইড করো।
হ্যাঁ , ফেল করা ছাত্রের কাছে পড়তে এসেছো তুমি।
কে বলে আমার বাবা ফেল করা ছাত্র? নাও দেখি, হাঁ করো। নাশপাতিটা খুব টাটকা পেয়েছে আজ।
বাবা মেয়েতে ভাব হয়ে গেল।
৬৮
বাবা , আজ ব্যাঙ্কে চলো।
শশাঙ্ক পাল বললেন – আজ থাক না শ্যামলিমা !
না বাবা, আগুন আর ঋণের শেষ রাখতে নেই। দু দুটো তাগাদা দিয়েছে। এবার যদি পেয়াদা পাঠায় ?
কি করে কি হবে?
বাবা, তোমাকে তো বলেছি, ফিক্সড ডিপোজিটগুলো দিয়ে মিটে যাবে।
পুরো হাত খালি করে ফেলবি?
না বাবা, লোনটা শোধ হয়ে গেলে তুমি অনেক ঝাড়া হাত পা হয়ে বাঁচতে পারবে।
তোর বিয়ের জন্যে কিছু রাখবি না?
বাবা, তোমার কি শুধু একটা মেয়ে? দু দুটো ছেলেও তো আছে! কই তাদের বিয়ের কথা তো বলছো না।
ওদের বিয়ের দেরি আছে মা।
না বাবা, আসলে মেয়েকে বোঝা ভাবা তোমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। ……
ব্যাঙ্কে যেতে ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে বসলো বাবা ও মেয়ে।
” কি পালবাবু শুনেছিলাম শরীর খারাপ হয়েছিল।”
“আর শরীর। এখন বাড়ির শাসনে বাঁধা পড়েছি। অনিয়ম করার স্বাধীনতা আর নেই। আমার লোন গুলো সব শোধ করে দেবো। দু দুটো নোটিশ পাঠিয়েছেন। আমার মেয়ে ভয় পাচ্ছে , এবার না পেয়াদা পাঠান।”
“এই আপনার মেয়ে ?”
হ্যাঁ, মেয়ে আবার মা। খুব শাসন করে আজকাল।
বেশ করে। তা কি পড়াশুনা করো তুমি?
শ্যামলী সংক্ষেপে সে খবর জানিয়ে বললো লোন শোধ করে নেবার ব্যবস্থা করতে।
“মামণিট, তুমি চাইলে লোনটা রিস্ট্রাকচার করে দিতে পারতাম। মনে হচ্ছে বাবার সব পুঁজি আমাকে দিয়ে যাচ্ছ।”
“সার, আসল পুঁজি কিন্তু দায়িত্বশীলতা। আপনি দরকারের দিনে ঋণ দিয়েছেন। এ টাকা আপনার নিজের নয়, সাধারণের সঞ্চয়। আমায় তো ফেরত দিতেই হতো।”
“না, তুমি খেয়াল করো নি আমার কথাটা। আমি লোনটা রিস্ট্রাকচার করার কথা বলছিলাম।“ চশমার ফাঁক দিয়ে তাকান ম্যানেজার।
“আবার দরকার হলে চলে আসব। লোন শোধ করে দিয়ে আমার তো কিছু নির্ভরযোগ্যতার প্রমাণ পাবেন আপনি।“
“ অ্যাজ ইউ লাইক ইট। ব্যাঙ্ক সব সময়ে নাগরিকের পাশে আছে। “ ম্যানেজারের গলায় প্রফেশনাল ম্যানারিজম।
শশাঙ্ক পাল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আড়াল করতে চেয়ে পেরে ওঠেন না।
৬৯
বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতেই সবিতা পিসি বললো – “শ্যামলী, তোর অনেক ফোন এসেছিল।“
“কে করেছিল?”
“তা জিজ্ঞেস করিনি বাপু। সে কি গম্ভীর গলা !”
“সে কি, কে ফোন করছেন জিজ্ঞাসা করবে না?”
“আমি অত শত জানি না বাপু। মেয়েছেলের অমন রাশভারি গলা হয় আমি শুনি নি!”
রাশভারি মহিলা কণ্ঠ ? কে হতে পারে? বাবাকে নিয়ে দোতলায় উঠে গেল শ্যামলী। বাবা, এ বৎসর ট্রেড লাইসেন্সটা রিনিউ করানোর জন্যে মিউনিসিপ্যালিটিতে লোক পাঠিয়েছি। সব দিক দিয়ে পরিষ্কার থাকা দরকার।
শশাঙ্ক পাল ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দেন। খোলা জানালা দিয়ে তাঁর দৃষ্টি হারিয়ে যায় কোন সুদূরে। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে। শ্যামলী ফোন ধরলে ওপার থেকে ধমক ভেসে আসে
“কি ব্যাপার, কলেজে আসোনি কেন? বাড়িতেও ফোন করে পাওয়া যায় না। কি হয়েছে তোমার?”
কলেজের প্রিন্সিপ্যাল মাদামের ফোন। শ্যামলী ভয়ে কুঁকড়ে যায় খানিকটা।
“বাড়িতে কাজ ছিল ম্যাম। বাবার শরীর ভালো না। তাঁকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যেতে হয়েছিল।“
“ব্যাঙ্কে যাবার মতো আর কেউ থাকে না বাড়িতে ? এভাবে ক্লাস কামাই করে নিজের ক্ষতি করছো কেন? শুনেছি আজকাল মাঝে মধ্যেই ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছ ! কি হয়েছে বল তো ?”
“ম্যাম , বাবার শরীর খারাপ হয়ে যেতে আমি কারখানার কাজ দেখছি। তাই মাঝে মধ্যে …।“
“শোনো, কাল বি ই কলেজে বেকাফেস্ট শুরু হচ্ছে। তুমি বিতর্কে কলেজকে রিপ্রেজেন্ট করবে। বি ই কলেজ চেনো তো ?”
“হ্যাঁ চিনি ম্যাম। কাল কখন?”
“সকাল নয়টার মধ্যে ঢুকে যাবে।“ বলে ফোন রেখে দিলেন তিনি।
দেখলি তো , কিভাবে নিজের কেরিয়ার নষ্ট করছিস? যে কোনো বিবেচক লোকে তোর কাজটাকে ভুল বলবে। কোথায় মন দিয়ে পড়াশুনা করবে, তা নয়, তেল কালি মোবিলের জগতে ঢুকে পড়লি।
শশাঙ্ক পাল এর কণ্ঠে রীতি মতো আপসোসের সুর।
শ্যামলীর মনে পড়ে তার বাবা তাকে গুরুদেবের নির্দেশ অনুসারে সংস্কৃত পড়তে বলেছিলেন। আর বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলেন কলেজ জীবন শুরু হতে না হতেই। বিয়ে একবার করে ফেললে মন দিয়ে পড়াশুনা হতো? কিন্তু অসুস্থ বাবার সাথে তর্ক করার কোনো আগ্রহ নেই তার। বরং আজ বিকেলে দুজন আপনজনের সাথে কাটাতে ইচ্ছে হচ্ছে। কাল বিতর্ক সভা। নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নিজে হাতে তাকে বাছাই করেছেন। চ্যালেঞ্জটা নেবে সে। এখন জাগাতে হবে নিজের মধ্যে সেই বাঘিনী টিকে। ঝাঁপ দিয়ে পেড়ে ফেলতে হবে বিপক্ষকে , যুক্তির কঠিন ময়দানে।
৭০
শিবপুর বি ই কলেজে বেকাফেস্ট। আন্তঃকলেজ সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। বিতর্ক সভায় নিজের কলেজের প্রতিনিধিত্ব করছে শ্যামলী। বিতর্কের বিষয় – “ নারী পুরুষের সমানাধিকার যুগের দাবী “
কলেজের মেয়েদের উৎসাহ দিতে করবী মিত্র এসেছেন। তিনি কলেজ শিক্ষিকা। বয়স ভুলে উত্তেজনায় ফুটছেন তিনি। শ্যামলী তুই তো পক্ষেই বলবি। বলতেই হবে পক্ষে। পয়েন্ট গুলো সাজিয়ে নে। শ্যামলীর কানে যেন কোনও কথাই ঢুকছে না। করবী মিত্র ছাত্রীর বাহু খামচে ধরলেন। কি রে , তুই রেডি তো ? সে মেয়ে পাথরের মতো মুখ করে বসে থাকে। করবী মিত্র বললেন – নারীর আপন ভাগ্য জয় করিবার, কেন নাহি দিবে অধিকার … এই লাইনটা কোট করবি। কিরে শুনতে পাচ্ছিস? পুতুলের মতো ঘাড় নাড়ে মেয়ে। শিক্ষিকা ধরতে পারেন ছাত্রীর মনের মধ্যে অন্য রকম একটা কিছু হচ্ছে। কিন্তু কি হচ্ছে সেটা আন্দাজ করতে পারেন না।
মঞ্চে উঠে শ্যামলী বললো – আমি নারী পুরুষের সমানাধিকার –এর বিপক্ষে
সঙ্গে সঙ্গে হাততালির ঝড় বয়ে গেল পুরুষ দর্শক দের মধ্যে। করবী মিত্র চিৎকার করে উঠলেন – তুই এটা কি করলি শ্যামলী ? উদ্যোক্তারা শিক্ষিকাকে চুপ করিয়ে দিল। মেয়ে মহলে নিচু গলায় টিপ্পনী শোনা গেল কয়েকটা, বাছা বাছা , চোখা চোখা।
কয়েক সেকেণ্ড ধরে গোটা ব্যাপারটা উপভোগ করলো শ্যামলী। মুখে তার তৃপ্তির আলো। আবার শুরু করলো সে। হ্যাঁ সমবেত ভদ্রমণ্ডলী ও মাননীয় বিচারক মণ্ডলী , আপনারা মোটেও ভুল শোনেন নি ; আমি শ্যামলী পাল , গণিত অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ; আমি নারী পুরুষের সমানাধিকার –এর বিপক্ষে
সকলে চুপ করে শোনে। যেন পিন পতনের শব্দও শোনা যাবে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *