পর্ব – ১৩৭
বাসন্তীবালা শ্যামলীকে বললেন, কাঁদিস না, আজ রমানাথদের ব্রাহ্মণভোজন হয়ে যাচ্ছে, কাল নিয়মভঙ্গ মৎস্যমুখী, কালও তো আমাদের নেমন্তন্ন। আমি কাল নিজে গিয়ে রমানাথের মায়ের পায়ে ধরে কেঁদে কেটে ক্ষমা চেয়ে সব মিটিয়ে দেব।
সবিতা কড়া চোখে শ্যামলীর মায়ের দিকে চেয়ে বলল, বৌমণি, এটা কি রকম কথা হল, তোমার মেয়ে দোষ করে নি, ঘাট করে নি, আর তুমি ওদের বাড়ির গিন্নির পায়ে ধরে ক্ষমা চাইবে? এ হতে পারে না। আমি হতে দেব না।
বাসন্তীবালা বললেন, তুই থাম্ সবিতা। তুই আজকাল বড্ড বেশি বুঝিস। মুখে মুখে তোর চোপা। রমার মা আমার চাইতে বয়সে বড়, মানেও বড়, তার কাছে ক্ষমা চাইলে দোষের কিছু হয় না।
সবিতা গোঁ ভরে বলল, শ্যামলীর দোষটা কি ছিল, সেটা আগে ঠিক হোক্। দোষ হয়ে থাকলে বৌমণি তুমি কেন, শ্যামলী নিজে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। কিন্তু দোষ না থাকলে খামোখা ক্ষমা চাওয়া মানে … না, না, সে হয় না।
বাসন্তীবালা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি যেতেই দিদি শ্যামলীর কত সুখ্যাতি করছিলেন। শুধু দিদি নয়, আত্মীয় স্বজনরা শ্যামলীর কথা আলোচনা করছে, ঝি চাকররা ওকে বাড়ির বৌরাণী হিসেবে পাবে বলে আনন্দে ফেটে পড়ছে, আমি চলে এলাম দুটো ঘন্টাও পোরে নি, তার মধ্যে এ কি সর্বনাশ হয়ে গেল গো? হে মা জগদ্ধাত্রী, এই কি তোমার মনে ছিল?
অতনু এসে দরজার কাছে দাঁড়াল। রাগত স্বরে বলল, মা, আজ কি সারাদিন তোমাদের গোলটেবিল মিটিং চলবে? খাওয়া দাওয়া কিছু হবে না?
সবিতা অতনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ও কি কথা ছোটখোকা? এই তো সাড়ে আটটার সময় তোকে রুটি আলুরদম ছানার পায়েস দিয়ে এলাম। এখন সবে দশটা বাজছে। এর মধ্যেই খিদে পায় কি করে?
অতনু বলল, তোমরা কাউকে বাজারে পাঠাবে না? দেরি হলে ভাল মাংস পাবে?
বাসন্তীবালা বললেন, এই ছেলেটা রোববার হলে মাংস না হলে চলেই না। আচ্ছা বাবা, তুমি ঘরে যাও, আমি আনাচ্ছি।
সবিতা বলল, শুধু রোববার মাংস? সপ্তাহে তিনদিন তো আসছেই।
বাসন্তীবালা বললেন, চুপ কর্ সবিতা, খাওয়া নিয়ে খোঁটা দিস্ না।
অতনু বলল, আমাকে টাকা দাও না, আমিই এনে দিতে পারব।
বাসন্তীবালা বললেন, না বাবা, পুলিশের লোক এখানে সেখানে ঘুরছে, কখন কি হয়, সব চুকে বুকে যাক, তার পর ঘুরবে বেড়াবে। কেউ আপত্তি করতে পারবে না।
শশাঙ্ক পাল উঠে বসে গলাটা সাফ করে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে, তোদের কোর্টে কবে ডাকবে খোঁজ নিয়েছিস?
বিরক্ত স্বরে অতনু বলল, ন্নাঃ। খোঁজ নিতে আমার বয়ে গেছে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, উকিলের কাছে গিয়ে খোঁজ নিতে হয় কবে কি হবে। তবে না জানবি।
অতনু বলল, কোর্ট ডাকলেও আমি যাব না, কি করবে করো!
বাসন্তীবালা বললেন, ও কি কথা রে অন্তু! কোর্ট ডাকলে সব কাজ ফেলে আগে যেতে হয়। সেখানে সব গুরুজন। তাদের কাছে মাথা নিচু করে ক্ষমা চেয়ে নিলে তাদের নিশ্চয়ই দয়া হবে।
শশাঙ্ক পাল বাসন্তীবালার দিকে চেয়ে বললেন, কি বলছ বলো তো তুমি? এ কি ক্লাস ফাইভের ছেলে অন্য বাচ্চার টিফিন খেয়ে ধরা পড়েছে যে কান ধরে ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যাবে? ঊনিশ বছর বয়স হল, রীতিমতো গোঁফ দাড়ি বেরিয়ে গেছে, এখন সব আইনের নিয়মে চলতে হবে।
অতনু শ্যামলীর দিকে চেয়ে বলল, দিদি, তোর সাথে তো ওসির খুব দহরম মহরম, তুই ওসিকে বলতে তো পারিস, আমার ভাইটাকে সারা জীবনের মতো কয়েদখানায় রেখে দিন।
শশাঙ্ক বললেন, কি মুশকিল, তুই বদ জায়গায় গিয়ে বদ কাজ করে ধরা পড়েছিস। এতে ওর কোন্ হাত আছে?
অতনু বলল, অরুণদা বলছিল, ওসি র ঘরে দিদি একবার ঢুকলে ওসি হেসে হেসে গল্পের পর গল্প করে। কত ওসি এল গেল, এমন আলুবাজ ওসি জন্মে দেখিনি।
শশাঙ্ক ছেলের দিকে তেড়ে উঠে বললেন শাট্ আপ! ওসিকে খারাপ বলতে চেয়ে নিজের দিদিকে এভাবে বলবি না, খবরদার।
অতনু তার বাবার দিকে পালটা চোখ রাঙিয়ে বলল, আমি কিছু জানি না ভেবেছ, অরুণদা ডেফিনিট খবর পেয়েছে, ও ওসির সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলছিল।
শশাঙ্কবাবু ছেলের দিকে চেয়ে বললেন, সেই ওসির সাথে আমি কথা বলে এসেছি। খুব ভদ্র আর সজ্জন মানুষ। না জেনে না বুঝে ভাল লোককে বদনাম দিও না। তার ফল ভাল হয় না।
শ্যামলী মুখ তুলে বাবার দিকে চেয়ে বলল, বাবা বদনাম জিনিসটা ঠিক ওই রকম। জাঁদরেল খারাপ লোকের বদনাম হয় না বাবা। বদনাম ভাল লোকেরই পাওনা।
ক্রমশ…