দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১১৭)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ১১৭
শ্যামলী প্রবালের চিঠি পড়ার টান কাটাতে পারছে না। আমস্টারডাম শহরে লোকসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ১৯৬০ সালে শহরের জনসংখ্যা ছিল ৮৬৯৬০২। ১৯৭০ এর জনগণনায় তার থেকে ৪.৪ শতাংশ কমে গেছে। তখন জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৮৩১৪৬৩। এই কমার হার সত্তরের দশক জুড়ে আরো বাড়ে। ১৩.৮ শতাংশ কমে ১৯৮০ র জনগণনায় আমস্টারডাম শহরের জনসংখ্যা ৭১৬৯৬৭ । প্রবাল লিখেছেন আমস্টারডাম শহরে দেশীয় ডাচ জনগোষ্ঠীর লোকের চাইতে বাইরের জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা বেশি। মরক্কো, সুরিনাম, টার্কি, ইন্দোনেশিয়া, ঘানা থেকে যেমন লোকজন এসেছে, তেমনি জার্মানি, ইংল্যান্ড আর আমেরিকার পাশাপাশি অন্যান্য দেশের মানুষও আমস্টারডাম শহরে রয়েছে। ১৯৪০ আর ১৯৫০ এর দশকে ইন্দোনেশিয়া থেকে অনেক লোক এই শহরে এসেছিল। ষাটের দশকে মরক্কো আর টার্কি থেকে অনেক লোক এসেছিল এখানে। শহরে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সুন্নিদের সংখ্যা বেশি। মোট জনসংখ্যার চৌদ্দ শতাংশ তারাই।
শ্যামলী ভাবতে থাকে, সে জানতে পারবে বলে কত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তথ্যসংগ্রহ করেছেন প্রবাল। তিনি লিখেছেন এই শহরে হিন্দু এক শতাংশ। বৌদ্ধ ধর্মসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যাও ওই একই রকম।
কিন্তু শহরের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল এখানকার ষাট শতাংশের বেশি লোক নির্দিষ্ট ভাবে কোনো ধর্মীয় অনুশাসন অনুশীলনে লিপ্ত নয়। তাঁদেরকে অসাম্প্রদায়িক বলাই সঙ্গত। আমস্টারডাম শহরে গড়ে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় হাজার পাঁচেক লোক বাস করে। শিক্ষার হার বেশ উঁচু। বাচ্চারা মন্টেসরী স্কুলে যায়। একটা অদ্ভুত কথা লিখেছেন প্রবাল। বলেছেন এখানে গ্রামার শেখানোর স্কুল আছে। তাকে বলে জিমনাসিয়াম। আমস্টারডাম শহরে মিউজিয়াম অনেক। আমস্টারডাম মিউজিয়ামের পাশাপাশি ভ্যান গঘ মিউজিয়াম, জুয়িশ হিস্টরিক্যাল মিউজিয়াম , স্টেডিলিক মিউজিয়াম, উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিষয়ে হরটাস বটানিকাস, রয়াল প্যালেস অফ আমস্টারডাম, আর অ্যানে ফ্রাঙ্ক হাউস। শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত উপন্যাসের কথা মনে পড়ে শ্যামলীর। রাজলক্ষ্মীর খাসভৃত্য কলকাতায় শ্রীকান্তের খবর নিতে এসে জ্যান্ত সোসাইটি, মরা সোসাইটি দেখে এসেছিল। সাধারণ লোকজন শিক্ষিত হবে বলে রাশিয়ার বিপ্লবীরা মিউজিয়াম আন্দোলন গড়ে তোলে। রাশিয়ার চিঠিতে রবিঠাকুরের কলমে এই কথাটা মনে পড়ে শ্যামলীর।
আমস্টারডাম শহরের লোকজন বেশ ফূর্তিপ্রবণ। প্রতি বৎসর সাতাশে এপ্রিল এরা কোনিংস ডে পালন করে। ইংরেজি ভাষায় ওর মানে হল কিংস ডে ও কুইনস ডে। ক্যাবারে উপভোগ করা এ শহরের এক উল্লেখযোগ্য বিষয় বলে লক্ষ্য করেছেন প্রবাল। এখানে ক্যাবারেকে বলে “ক্লিনকুনস্ট”। কিন্তু তা শুধু মাত্র যৌনতার প্রদর্শন মোটেও নয়। বাংলাদেশের যাত্রা কবিগান লোকগীতি হাফ আখড়াই তরজা গাজীর গান এর সাথেই আমস্টারডাম শহরের ক্যাবারে শিল্পের তুলনা টেনেছেন প্রবাল। ক্যাবারে বা স্থানীয় পরিচয়ে ক্লিনকুনস্ট রীতিমতো শিখতে হয়। প্রবাল জানিয়েছেন এই শহরে তার জন্য আকাদেমি পর্যন্ত রয়েছে। ক্যাবারে শিল্পী কমেডি থিয়েটার মিউজিক সহযোগে সামাজিক বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। এমনকি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার পর্যন্ত পেশ করেন। প্রবাল লিখেছেন “ক্যাবারে” কথাটির প্রকৃত অর্থ স্মল আর্ট। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই শিল্পের সূচনা হয় ১৯.০৮.১৮৯৫ তারিখে। শ্যামলীর মনে পড়ল বাংলাদেশের চর্যাপদের কথা।
বারো ক্লাসে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পাঠ্য ছিল শ্যামলীর। ক্লাসের শিক্ষক একটি খাতা থেকে দেখে দেখে বলে যেতেন, আর সব কজন মেয়ে তা লিখে নিত। যারা দ্রুত লিখতে পেরে উঠত না, তারা সহপাঠিনীর থেকে পরে খাতা চেয়ে এনে লিখত। শ্যামলী ওই নোট লিখত না। চুপচাপ বসে থাকত। শিক্ষক একদিন শ্যামলীকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন, শ্যামলী তুই লিখছিস না কেন?
শ্যামলী বলল, আমি শুনছি তো।
শিক্ষক বললেন, এই নোট না পড়লে পাশ করবি কি করে?
শান্ত স্বরে শ্যামলী বলেছিল, চর্যাগুলো খুব ইন্টারেস্টিং। পড়তে ভাল লাগে।
বারো ক্লাসের সিলেবাসে মূল চর্যাগানগুলি পাঠ্য ছিল না। কেবল তা নিয়ে কিছু আলোচনা ছিল। কিন্তু শ্যামলী মূল চর্যা পড়ে ফেলেছে শুনে শিক্ষক অবাক হলেন। একটু রুষ্টও হলেন। শ্যামলীকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন আচ্ছা বল্ দেখি, নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী/ বুদ্ধ নাটক বিসমা হোই, এই কথার তাৎপর্য কি?
শ্যামলী সেদিন বলেছিল, স্যার আপনি অর্থ জানতে চান নি। তাৎপর্য জানতে চেয়েছেন। সেই জন্যে বলি, এটি চর্যাগাথার ছাব্বিশতম পদ। পটমঞ্জরী রাগে শ্রদ্ধেয় বীণাপাদ এটি রচনা করেছেন। সকল চর্যাগানেই সহজসাধন তত্ত্ব, কুন্দুরযোগ এইসব বিষয় সহজ রূপকের মধ্য দিয়ে শেষ অবধি শূন্যতা ও নির্বাণের কথা বলা আছে। সাধকের জোহ্নাবাড়ি।
তার পর সে ছাব্বিশ নং চর্যাটি পুরো শুনিয়ে বলেছিল বজ্রসত্ত্ব গান গাইবেন, আর গানের তালে তালে দেবী নাচবেন , এটাই হবার কথা। কিন্তু বুদ্ধনাটকের ব্যাপার স্যাপার অন্য রকম। এখানে দেবী গাইছেন, আর বজ্রসত্ত্ব নাচছেন।
শিক্ষক তো বটেই, গোটা ক্লাস অবাক হয়ে গিয়েছিল।
আজ প্রবালের লেখায় ক্যাবারে নাচের মাধ্যমে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার পর্যন্ত তুলে ধরা হয় জেনে শ্যামলীর সেই ছাব্বিশ নং চর্যা আর বুদ্ধ নাটকের কথা মনে পড়ে গেল।
এমন সময় জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে শ্যামলী দেখতে পেল ভোর হচ্ছে।