দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯৯)
by
·
Published
· Updated
পর্ব – ৯৯
১৯৮
গাড়ি থেকে নামার সময় করবী মিত্র বললেন, তুই যদিও আমার থেকে অনেকটাই অন্য রকম, তবুও জানবি, তোকে আমি খুব ভালবাসি।
সহসা ম্যাক্সিম গোর্কির একটা কথা মনে পড়ে গেল শ্যামলীর। লেখক বলছেন, When one loves somebody everything is clear – where to go, what to do – it all takes care of itself and one doesn’t have to ask anybody about anything. কিন্তু গোর্কির কথাটা নিজের শিক্ষককে মন খুলে বলতে আর ভরসা পেল না সে।
গাড়ি ছেড়ে দেবার আগে করবী বললেন, প্রফেসর সান্যালের কথাটা খেয়াল রাখিস শ্যামলী। পড়াশুনাটায় আরো একটু যত্ন নিস।
তাকে করবী মিত্রের গাড়ি থেকে নামতে দেখলেন এক পল্লীবৃদ্ধ। তাঁর চোখে কেমন একটা বিশ্রী কৌতূহল মুহূর্তে পড়ে নিল শ্যামলী। সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে কিছুতেই চলে যেতে দিলেন না বৃদ্ধ। প্রায় গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে জানতে চাইলেন, গাড়িতে কে ছিল? শ্যামলী স্থির করল কিছুতেই ওঁর কথাটা কদর্থে নেবে না সে। স্মিতমুখে সে বলল, আমার কলেজের ম্যাডাম। আমাদের কলেজে পড়ান। শ্যামলীর ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলল, অধ্যাপক শব্দটা শুনলেই বৃদ্ধ ধরে নেবেন পুরুষ সংসর্গ করতে গিয়েছিল সে। আর লিঙ্গসাম্যে সে নিজে গভীরভাবে বিশ্বাস করে বলে, তার পক্ষে অধ্যাপিকা বলাও অসম্ভব।
বৃদ্ধ জানতে চাইলেন, তা তুমি গিয়েছিলে কোথায়?
শ্যামলী ঠিক করে নিল, সে সহজ ভাবেই উত্তর দেবে। বলল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সায়েন্টিস্ট এর কাছে গিয়েছিলাম।
বৃদ্ধ বললেন, অ। তা তোমাকে আজকাল দেখি গাড়িতে করে এখানে ওখানে যাচ্ছ।
শ্যামলী হাসল। বলল, আপনি ভাল আছেন তো? শীতকাল আসছে। রোজ স্নান করবেন। বেশি করে জল খাবেন।
বৃদ্ধ বললেন, আর আমাদের ভাল থাকা! এবার চলে গেলেই হয়। তোমার ঠাকুমা চলে গেছে। এক গ্লাস জলও নিজেকে গড়িয়ে নিয়ে তবে খেতে হয়। নিজের মনের মতো খাবার খাওয়া আর নেই। যা বউমারা রান্না করে ঠক করে নামিয়ে দিয়ে যায়, তাই গিলতে হয়। বুড়ো হবার অনেক কষ্ট। তা তুমিও সাবধানে থেকো। যতই লেখাপড়া করো না কেন, একটা কথা জানবে, মেয়েছেলের বারোহাত কাপড়েও কাছা হয় না।
শ্যামলী “মেয়েছেলে” শব্দটা শুনলেই বিরক্তি বোধ করে। ব্যবহারকারীর রুচির নিন্দাও করে প্রকাশ্যে। কিন্তু আজ গৌতম বুদ্ধ তাকে কেবলই শলা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, কেউ যদি তোমায় একটা ফল দিতে চায়, আর তুমি যদি সেটা গ্রহণ না করো, তাহলে সেই ফলটা যে দিতে এসেছিল, তারই থেকে যায়। একই ভাবে, কেউ যদি তোমাকে কুবাক্য বলে, আর সেই কুবাক্য যদি তুমি নিজের অন্তরে ঢুকতে না দাও, তাহলে তেমন কুবাক্য ওই রকম উচ্চারণকারীর কাছেই থেকে যায়। কারো অসংগত আচরণে রাগ করা মানে, অন্যের অপরাধে নিজেকে শাস্তি দেওয়া।
শ্যামলী বলল, এখন মেয়েরা পড়াশুনা করতে সুযোগ পেয়ে নিজের নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দিচ্ছেন। পদ্মজা নাইডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, ক্যাপটেন দুর্বা ব্যানার্জি, মহাশ্বেতা দেবী, লেডি রাণু, সফল মহিলাদের নাম আমি আরো বলতে পারব।
বৃদ্ধ বললেন, ওই অত লেখাপড়া শিখতে গিয়েই তো সমস্যা হচ্ছে। স্বামীকে মানতে ইচ্ছে করছে না। সংসার টিঁকছে না। আমাদের সময়ে মেয়েদের কচি বয়সে বিয়ে হত। নতুন সংসারে তাদেরকে মনের মতো করে গড়ে পিটে ঘষে মেজে নেওয়া যেত। যতই লেখাপড়া শেখো, মেয়ে হয়েছ যখন, হাতাখুন্তি ধরতে হবেই।
শ্যামলী বলল, আচ্ছা, আজ আমি আসছি। আমি মধ্যে মধ্যে হাতাখুন্তি ধরি। কোনো দিন ভালমন্দ রাঁধলে, আপনাকে পাঠিয়ে দেব।
বলে শ্যামলী প্রগলভ বৃদ্ধের উত্তরের অপেক্ষা না করেই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতেই টের পেল বিপত্নীক যৌন বুভুক্ষু বৃদ্ধের চোখ দুটো তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে লেহন করছে। বয়স গিয়েছে, সম্ভোগের শারীরিক শক্তি গিয়েছে, অথচ যৌন কামনার ঊর্ধ্বায়ন হয় নি। এই জন্যই কি বৃদ্ধকে পুত্রবধূরা পছন্দ করে না? বয়সের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি যৌন কামনার উদবর্তন না ঘটে, তাহলে সেই ভারসাম্যহীনতা একধরণের অশান্তি সৃষ্টি করে। পুরু আর যযাতির গল্প মনে এল তার। অতৃপ্ত যৌনকামনা মেটাতে পিতা হয়ে পুত্রের কাছে যৌবন প্রার্থনা করলেন। অন্য পুত্রেরা অসম্মত হলেও, একটি পুত্র রাজি হল। পুত্রের যৌবন নিয়ে হাজার বছর ধরে যৌন পিপাসা মেটালেন রাজা। মহাভারতকার এমন একটা বাস্তব সত্যের ইঙ্গিত করতে এতটুকু ভয় পেলেন না!