পর্ব – ৯৬
১৯৫
অধ্যাপক সান্যাল তাঁর বৈঠকখানা ঘরে শ্যামলীদের বসালেন। সেখানে কাচের বাক্সে একটা জাপানি পুতুল দেখে শ্যামলীর খুব ভাল লাগল। তাকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে সান্যাল বললেন, আমারও এই পুতুলটা খুবই ভাল লেগেছিল।
শ্যামলী বলল, কি নিখুঁত করে বানানো তাই না?
অধ্যাপক সান্যাল হাসলেন। অথচ দ্যাখো সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে মানুষের চেহারার কি বিপুল ফারাক। কেউবা লম্বা, কেউ ভীষণ বেঁটে, কেউ ফরসা আবার কারো গায়ের রঙ কালো। নাক চোখ ঠোঁটের গড়নে দেশে দেশে কতো না বৈচিত্র্য।
শ্যামলী বলল, একই দেশের মধ্যে কাশ্মীরে আর কেরালায়, অরুণাচল আর আমেদাবাদে চেহারার কতো না ফারাক।
অধ্যাপক মিত্র যোগ করলেন রাশিয়ার মানুষ একরকম ফর্সা, আবার নরওয়ের লোকের ফর্সা রঙ আরেক রকম। কালোও নানা রকম। কিন্তু চুলের যে বৈচিত্র্য, তার যেন আমি থই পাই না।
শ্যামলী বলল, কি বলব, আমার কলেজের বন্ধুদের প্রায় সবাই বাঙালি হিন্দু, তবুও তাদের হাতের নখের গঠনে অনেক তফাত।
অধ্যাপক সান্যাল শ্যামলীর দিকে চেয়ে জানতে চাইলেন, তুমি বলতে পারো কেন এত তফাৎ?
শ্যামলী বলল, অনেক গুলো কারণে তফাৎ হতে পারে। তার একটা নিশ্চয়ই জিন।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, জিন তো বটেই, ভৌগোলিক কারণেও তফাৎ হয়। কাশ্মীরের মেয়েদের চেহারার সঙ্গে দ্রাবিড় রাজ্যগুলির কন্যাদের চেহারা তুলনা করো, দেখবে রৌদ্র কিরণের সাথে গাত্রত্বকের সম্পর্ক আছে।
শ্যামলী বলল, আমি পড়েছি রম্যাঁ রলাঁ লক্ষ্য করেছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চাইতে তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথের গায়ের রঙ বেশ চাপা। অথচ অন্য জায়গায় দেখেছি কবির বড়মেয়ে মাধুরীলতা একেবারে বেলফুলের মত ফর্সা ছিলেন। কবি আদর করে বেলা, বেলবুড়ি, এইসব বলতেন।
অধ্যাপক সান্যাল বললেন, জানো শ্যামলী, এই এ বছর, ১৯৮৪তেই আমেরিকা হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেছেন। আচ্ছা, শ্যামলী বলোতো, জিন কথাটা জীবন বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় কে আনলেন?
শ্যামলী বলল, এক কথায় বলতে গেলে বলতে হবে, ডেনিশ বটানিস্ট উইলহেলম লুডভিগ জোহানসেন ১৯০৯ সাল নাগাদ এই শব্দটা ব্যবহার করেন। কিন্তু জেনেসিস নামে শব্দ ছিল অনেক দিন থেকে। সংস্কৃতে জনক জননী শব্দ ছিল।
অধ্যাপক সান্যাল বললেন, শ্যামলী তুমি এটা ঠিক বলেছ। আমি এর সাথে যোগ করব বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন এর ব্যবহার করা প্যানজেনেসিস কথাটা, আর জেমমিউল শব্দটা। হুগো ডি ভ্রীস ১৮৮৯ সালে একটা বই লেখেন, তার নাম দেন ইনট্রা সেলুলার প্যানজেনেসিস।
জানো শ্যামলী, জেনেটিক্স এর কথা বলতে গেলে গ্রেগর যোহান মেণ্ডেলের কথা বলতেই হবে।
শ্যামলী বলল, হ্যাঁ, মটরশুঁটি গাছের পরীক্ষার ফলাফল থেকে বৈজ্ঞানিক সত্য বের করে এনেছিলেন তিনি।
অধ্যাপক সান্যাল বললেন, মেণ্ডেলের জেনেটিক্স এর সাথে ডারউইন সাহেবের ইভোলিউশনকে মিলিয়ে অনেক ভাবনা চিন্তা করেছিলেন জুলিয়ান হাক্সলি। তারপর রিচার্ড ডাউকিনস জিনকে জীবের বৈশিষ্ট্যের মূল দায়িত্বে বসালেন।
আজ ত্রিশ একত্রিশ বছর হল, ১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ’র স্ট্রাকচার নিয়ে আইডিয়া দিলেন।
শ্যামলী বলল, ওঁরা ওটা জানতে পারলেন রোজালিণ্ড ফ্রাঙ্কলিন আর মরিস উইলকিনস এর কাজ থেকে।
অধ্যাপক সান্যাল বললেন, ফ্রাঙ্কলিন আর মরিস এক্স রে ক্রিস্টালোগ্রাফি প্রযুক্তির ব্যবহার করে বলেছিলেন ডিএনএ’র হেলিক্যাল স্ট্রাকচার এর কথা। সেখান থেকেই ওয়াটসন আর ক্রিক এগিয়ে গিয়ে ডাবল হেলিক্সের কথা বললেন।
অধ্যাপক মিত্র বললেন, বেশ প্যাঁচোয়া ব্যাপার তাই না?
শুনে সবাই হেসে উঠলো।
শ্যামলী বলল, আমি যদিও কিছুই তেমন জানি না, তবুও বলছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় পেয়েছি, শক হুণ দন পাঠান মোগল একদেহে হল লীন, এই কথাটার মধ্যে দিয়ে জাতি হিসেবে ভারতীয়দের একটা পরিচয় তিনি দিয়েছেন।
অধ্যাপক সান্যাল সপ্রশংস চোখে শ্যামলীর দিকে চাইতে উৎসাহ পেয়ে শ্যামলী বলল, আর একটা কবিতায় রবি ঠাকুর বলছেন, পিতামহদের কাহিনী লিখিছ মজ্জায় মিশাইয়া, এই কথাটাও খুব ভাবায় আমায়।
অধ্যাপক করবী মিত্র অধ্যাপক সান্যালের দিকে তাকিয়ে বললেন, শ্যামলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা খুব পড়ে। আজই আমায় একটা কবিতা শুনিয়েছে। আর আমরা একসাথে আগুনের পরশমণি গান গাইতে গাইতে এসেছি। কি রকম চটপট কেটে গেল আসার রাস্তাটা, তাই না রে!
শ্যামলী হেসে বলল, ভাল সময়গুলোর ডানা আছে। চটপট উড়ে যায়। খারাপ সময়গুলো এঁটুলি হয়ে জড়িয়ে থাকে।
ক্রমশ…