• Uncategorized
  • 0

দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ৯৪)

পর্ব – ৯৪

৯৩

শোয়ার তোড়জোড় করতে করতেই শ‍্যামলী খেয়াল করল মা দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে। শ‍্যামলী বলল, কিছু বলবে মা?
বাসন্তীবালা বললেন, গতকাল রাতে তোর কাছে এসে একটু ঘুমাতে পেরেছিলাম। আজকে কি আর ঘুম আসবে? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
শ‍্যামলী বলল, মা, আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট, তাই না?
বাসন্তীবালা বললেন, তা নয় রে, আজ একটা বিপদ ঘটে গিয়েছে।
শ‍্যামলী কিছু না বলে জিজ্ঞাসু মুখে তাকালো।
বাসন্তীবালা বললেন, কি হয়েছে জানিস, তুই যে পুজোর জামাকাপড় কেনার জন‍্যে টাকা দিয়েছিলি, সেটা থেকে শান্তনু আর অতনুর বিলের টাকা ধরিয়ে দিয়েছি। তনু আর জামাইয়ের বিলের টাকাও পাঠিয়ে দিয়েছি। তনু টাকা হাতে পেয়ে ফোন করেছিল।
শ‍্যামলী বলল, তারপর?
তার মা বললেন, যে কয়টা টাকা আমাদের এই কজনের জন‍্য পড়েছিল, সে টাকাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
শ‍্যামলী নিজেকে খুব কষ্ট করে চুপ করিয়ে রাখল।
মা বলল, তুই কিছু বলবি না?
মেয়ে বলল, কি বলব মা, তুমিই বলো।
বাসন্তীবালা বললেন, আমি ঠাকুরের শয়ন যেখানে দিই, সেই ঠাকুরের বিছানার নিচে টাকা কটা রেখেছিলাম। সন্ধে থেকে আর দেখতে পাচ্ছি না। ঠাকুরের কাছে কত কাঁদলাম, ঠাকুর টাকা ক’টা ফিরিয়ে দাও। ক‌ই, এখনো তো দয়া হল না।
স্টিলের আলমারির লকারে টাকা না রেখে ঠাকুরের তোশকের নিচে টাকা রাখার যুক্তি কি, তা একবার জানতে চাইবে ভাবল মেয়ে। তারপর প্রবল চেষ্টায় নিজেকে সংযত করল।
শ‍্যামলী আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল, মা তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?
বাসন্তীবালা সচকিত হয়ে বললেন, ওরে, তোকে আমি সন্দেহ করব কি করে? তুই তো শেষ দুপুরে অনসূয়ার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লি। তারপরেও আমি দেখেছি টাকাটা ছিল।
শ‍্যামলীকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, তুই কিছু বলবি না?
শ‍্যামলী বলল, আমি কোন্ অধিকারে বলব মা? টাকাটা বাবার কারবারে লাভের থেকে এসেছিল। তোমাকে দিয়ে ভাউচারে স‌ই করিয়ে নিয়েছিলাম। কারবারে হিসেবের খাতা বলবে তুমি টাকা পেয়েছিলে। এবার বিশ্বাস করে তুমি কাউকে রাখতে দিয়ে থাকলে, আমি কেন বলতে যাব?
আমি যে ঠাকুরের কাছে অনেক ভরসা করে রেখেছিলাম রে!
মায়ের সরলতাকে অজ্ঞতার নামান্তর হিসেবে চেনে মেয়ে। আর অবুঝ অজ্ঞতার উপর তার রাগ, না বিতৃষ্ণা, কোন্ টা বেশি ভেবে পায় না শ‍্যামলী।
শ‍্যামলী বলল, মা আমি আজ পিসিমণিকে একটা শাড়ি এনে দিয়েছি।
বাসন্তীবালা বললেন, তা বেশ করেছিস, আজ ষষ্ঠীর দিন। তা, হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলিমা, তুই টাকা পেলি কোথায়?
মেয়ে বলল, আমার স্কলারশিপের টাকা কিছু বাঁচিয়ে রেখেছিলাম মা। সেই টাকা থেকে পিসির জন‍্য একটা শাড়ি আর কারখানায় একটা বাচ্চা কাজ করে, ওকে জামাকাপড় দিয়েছি।
বাসন্তীবালা জানতে চাইলেন, তোর নিজের কিছু কিনলি না কেন?
শ‍্যামলী হেসে বলল, আমার আলমারিতে কত জামাকাপড় আছে তুমি জান? আমার পোশাক অত ছেঁড়ে না।
বাসন্তীবালা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।, তোর সব কিছুতে কত যত্ন। তোর বাবা বলছিল। লেবারগুলোকে বোনাস দিতে পেরেছিস। তোর বাবা খুশি।
শ‍্যামলী বলল, এতে আলাদা করে খুশির কি আছে। বিবেকানন্দ বলতেন শাকের পয়সা মাছে দিও না‌। তার মানে একটা খাতের টাকা অন‍্য খাতে বেভুল হয়ে খরচ কোরো না।
বাসন্তীবালা কাতর হয়ে বললেন, আমি এখন কি করি বল্ তো?
শ‍্যামলী বলল, দ‍্যাখো মা, আমি নাস্তিক লোক। ঠাকুর দেবতার সঙ্গে আমার সম্বন্ধ নেই। কিন্তু, তোমার সাথে আছে। তুমি ভাল বুঝেই নিশ্চয় ঠাকুরের জিম্মায় টাকা রেখেছিলে। আমি আলমারির লকারকে বিশ্বাস করি। তুমি ঠাকুরের উপর বিশ্বাস করো। এ নিয়ে আমি কি বলব মা?
বাসন্তীবালা বললেন, দ‍্যাখ শ‍্যামলী, তুই যে এই কথায় কথায় নিজেকে নাস্তিক বলিস, এটা কিন্তু আমার ভাল লাগে না।
শ‍্যামলী ম্লান হেসে বলল, কি করব মা, যার মনের গড়ন যেমন। আমি মনে করি, মানুষের জীবন অন‍্য মানুষের ভাল মন্দ আচরণের উপর নির্ভর করে, প্রাকৃতিক ঘটনার উপর নির্ভর করে। কিন্তু ঈশ্বরের উপর নির্ভর করে না। ঈশ্বর ভালও করতে পারেন না, খারাপ কিছুও করতে পারেন না। তাই আমি ঈশ্বর নিয়ে নির্লিপ্ত থাকি।
বাসন্তীবালা মেয়ের গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, ওরে তিনিই তো এই সূর্য চন্দ্র সব কিছুকে চালাচ্ছেন। তিনি বিশ্বনিয়ন্তা প্রভু। তিনি না চাইলে গাছের পাতাটি পর্যন্ত নড়ে না।
শ‍্যামলী বলল, মা, যদি সত‍্যি সত‍্যি তাই মনে করো, তাহলে ধরে নিচ্ছ কেন যে টাকা কটা হারিয়ে গেছে? ভাবছ না কেন, বিশ্বনিয়ন্তা ওটা যেখানে রাখবার, সেখানেই গুছিয়ে রেখে দিয়েছেন?
বাসন্তীবালা মেয়ের কথা শুনে হাঁ হয়ে গেলেন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।