• Uncategorized
  • 0

দাসপ্রথা উচ্ছেদ নিয়ে আমার কিছু কথা

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

লিখেছেন – মৃদুল শ্রীমানী

আজ যে দাসপ্রথা উচ্ছেদের দিন। কী অবর্ণনীয় জীবন কাটিয়েছেন কিছু মানুষ দাসপ্রথার দাপটে। বাংলাভূমিতে কি দাসপ্রথা ছিল? জানি না। তবে সেই সদ‍্যোকৈশোর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুরাতন ভৃত‍্য পড়েছি। কেষ্টা, কদাচিৎ যে কৃষ্ণকান্ত, তার জীবনটা চোখের সামনে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর পড়তাম বিদ‍্যাসাগর মশায়ের ভ্রান্তি বিলাস। পড়তে গিয়ে কখনোই মনে হয় নি যে ওটি অনুবাদ মাত্র। শেক্সপিয়র এর কমেডি অফ এররস একটি নাটক। কিন্তু ভ্রান্তি বিলাস তো নাটক নয়। অন‍্যরকম সাহিত্য আঙ্গিক। ওখানে চাকরের নাম কিঙ্কর। আরে, কিঙ্কর মানেই তো চাকর! চিরঞ্জীব, দুই যমজ ভাই, বায়োলজির ভাষায় আইডেন্টিকাল টুইন।  দুজনের নাম‌ই চিরঞ্জীব। একটি চিরঞ্জীব বিবাহিত। অন‍্যটি অব‍্যূঢ়। বিবাহিত চিরঞ্জীব উচ্চতর সমাজের মাননীয় সদস্য। তার অনূঢ়া শ‍্যালিকার সাথে বিয়ের কথা বলেন বিদ‍্যাসাগর। কিঙ্কর দুজন‌ও যমজ। এরাও আইডেন্টিকাল টুইন। কিন্তু এদের বিয়ের কথা জানতে পারি না।

বিদ‍্যাসাগর কত মানুষকে দান ধ‍্যানে অনুগৃহীত করেছেন। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা কৃতবিদ‍্য নিশ্চিতরূপে মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মাইকেল এর মেঘনাদবধ কাব‍্যে  কথায় কথায় দাদার কাছে ভাই নিজেকে দাস বলে, কাকার কাছে ভাইপো নিজেকে বলে কিঙ্কর। আমি দেখি দেশমাতাকে মাইকেল মধুসূদন বলছেন, রেখো মা দাসেরে মনে। এদিকে বিদ‍্যাসাগর অত অর্থ উপার্জন করতে করতেও পোশাকে আশাকে এমন ভাবে থাকতেন যে লোকজন তাঁকে কুলি বা চাকরবাকর বলে মনে করে মাথায় মোটঘাট চাপিয়ে দিতে দ্বিধা করত না।

পুরাতন ভৃত‍্য কেষ্টাকে কত যে গালমন্দ করা যায়, ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। যা কিছু হারায়, গিন্নি ওই কেষ্টাকেই চোর সাব‍্যস্ত করে থাকেন। অথচ, কেষ্টা র ঠিক কোথাও যাবার যায়গা নেই। তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছি বললেও আত্মসম্মান রক্ষা করার তাগিদেও সে চলে যায় না। তাকে টিকি ধরে টেনে আনা চলে, প্রহার করা চলে, বাছাই করা অপশব্দে গাল দেওয়া চলে। আচ্ছা, কেষ্টা কি একটু অসুস্থ? সে যে কেন মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ে, তা নিয়ে কি কেউ ভাবে? কেষ্টার চোখের সামনে মালিক পক্ষ স্বামী স্ত্রী দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করছে, কিন্তু কেষ্টার জীবনে কোনো জৈবিক চাহিদা পূরণ করার প্রাসঙ্গিকতা আছে কিনা, তা তো কেউ ভাবে না। কেষ্টা যেন জীবন্ত রোবট। তার যৌনতা বোধ নিয়ে সমাজ ভাববে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের চোখ খুলে দেন। দেখান, সর্বক্ষণ মানুষের অধিকার হতে বঞ্চিত হতে হতেও কেষ্টা নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলে মানুষ টাকে মরতে দেয়নি। প্রবাসে বন্ধু পরিত্যক্ত প্রভুকে সে জীবন বিপন্ন করে শুধু সেবাই করে নি, জীবনের আশাও যুগিয়েছে।
নিজের জীবন থেকে এক চাকরের গল্প বলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনস্মৃতিতে। আমি ঈশ্বর চাকরের কথা বলছি। ঈশ্বর পাড়াগাঁয়ের পাঠশালায় গুরুগিরি করত। আর্থিক দিক থেকে পাড়া গাঁর পাঠশালার গুরু যত দুর্বল‌ই হোন না কেন, দেবেন ঠাকুরের বাড়িতে চাকরের কাজ নিতে হ‌ওয়া ঈশ্বরের কথা ভেবে চোখে জল আসে। মনুষ্যত্বের কত বড় অপচয়! হোক পাড়াগাঁয়ের পাঠশালা, ঈশ্বর গুরু তো বটে। তার মানে লিখতে পড়তে জানা মানুষ। তাকে শহরে এসে গৃহভৃত‍্যের কাজ করতে দেখলে মরমে মরে যেতে ইচ্ছে করে।
পোস্ট মাস্টার গল্পের বালিকা রতনের কথা ভুলতে পারিনি। কি সহজে তাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গর্ভে ফেলে চলে আসতে পারেন শহরের শিক্ষিত যুবক। এত‌ই যদি নিরাসক্ত হবেন, তাহলে রতনকে কাছে নিয়ে পড়াতেন কেন? নিজের পারিবারিক গল্প করতেন কেন রতনের সাথে? ঝি চাকরের কি মন বলে কিছুই থাকতে নেই?
আমার ভিতরে ছটফটে প্রশ্ন উসকে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আর খোকাবাবুর প্রত‍্যাবর্তন। একটা মানুষ চাকর হয়ে কোন্ মাত্রায় আত্মনিগ্রহ, আত্মপ্রতারণা ক‍রতে পারেন, বুকের রক্তে কলম ডুবিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

চাকরবাকর আর ঝি নিয়ে অনেক গল্প।  বাংলা শব্দের ভাঁড়ারে বেটা মানে “বিনা মাইনের মজুর”, আর ঝি কথার উৎস “দুহিতা” জানতে পেরে আমি অবাক হয়েছিলাম।

আমার মনে পড়ে ষাটের দশকের শেষে আমাদের বাড়িতে একটি চাকর ছিল। বড় জ‍্যাঠাইমায়ের বাপের বাড়ি থেকে তাকে পাঠানো হয়েছিল। সে আমাকে আদর করে ডাকত, “ঝামেলা”। না, এই বিশ্বজগতে আমার মতো লোকের ঠিক কী অভিধা হ‌ওয়া উচিত, সে আমার শৈশবেই তা উপলব্ধি করেছিল। আমি তার দূরদর্শিতার প্রশংসা করি। কিন্তু আমার গণিতপ্রেমী পিতামহ ওঁর দূরদর্শিতা দেখে বিরক্ত হতেন। পিতামহ অন্ধ স্নেহবশতঃ আমাকে অত্যন্ত মেধাবী ভাবতেন, এবং আমার শত অপদার্থতা স্নেহের চক্ষে ঢেকে নিতেন। আমাকে “ঝামেলা” আখ্যায়িত ক‍রায় বাড়ির অভিভাবক হিসেবে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে দূরদর্শী চাকরটিকে বিদায় ক‍রে দিয়েছিলেন।
আজ আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিরোধী দিবসে সেই বরখাস্ত হওয়া চাকরটিকে স্মরণ করি।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।