ঝিল্লির জেঠু একদিন দোকানে গিয়ে বলেছিলেন, একটা মাগি দাও তো। দীর্ঘদিনের চেনা দোকানদার আঁতকে উঠেছিল তাঁর এহেন কথায়। বোঝার চেষ্টা করছিল তার পরিচিত নিপাট ভদ্রলোকটির মুখে এইরকম ভাষা কেন? খানিক পরে সে ধরতে পেরেছিল জেঠু সদ্য বাজারে আসা, দু মিনিটে হয়ে যায় সেই চটজলদি ম্যাগির প্যাকেট চাইছেন। আমরা কিন্তু এখনো বুঝিনি জেঠু ম্যাগির উচ্চারণটা বুঝতে না পেরে অমন বলেছিলেন, না স্রেফ দুষ্টুমি করে।(তবে মাগি শুনে অত কানে আঙ্গুল দেবার কিছু নেই।জ্ঞানেন্দ্রমোহনে আছে সংস্কৃত মাতৃগাম থেকে এর উদ্ভব। হরিচরণে পাচ্ছি শব্দটি মাগ এর সঙ্গে ই যোগে নিষ্পন্ন। মাগ এসেছে মাউগ বা মাগু থেকে, মৈথিলীতে মৌগী বা মাগু দুয়ের অর্থই নারী। আর সুকুমার সেনের মতে শব্দটি এসেছে মার্গিতা থেকে, যার অর্থ মাগিবার জিনিস) দুষ্টুমিই নিশ্চয়, কারণ একটা ‘এ’ থাকলে উচ্চারণ যে অ্যা হবে, তা তো শিশুও জানে। কিন্তু অনেক পণ্যের নির্মাতারা এমন নামের বানান রাখেন, যে তা থেকে সংশয় তৈরি হয়।এটাও একটা বিপণন কৌশল। যেমন মনের জিনিস মনজিনিস, একে অনেককেই মনগিনিস বলতে শুনেছি। খুব স্বাভাবিক। কারণ জিনিসের বানানে জে নেই, আছে জি, তাতে গ উচ্চারণই হয়। তবে বিজ্ঞাপনের জোরে কী না হয়? সেই যে পুরোনো একটা গল্প আছে, এক ব্রাহ্মণ পুজো করে একটা পাঁঠা পেয়েছেন, সেটা নিয়ে ফিরছেন্, তিনটে ঠগসড় করে, বারবার বলতে বলতে সেই পাঁঠাকে কুকুর প্রমাণ করেই ছাড়ল। তিন নম্বর জন বলার পর ব্রাহ্মণের মনে হল তিন তিনটে লোক বলছে যখন, তখন এটা অবশ্যই কুকুর। তিনি তখন তাকে ফেলেই চলে গেলেন আর পাঁঠাটা গেল ওই তিনজনের পেটে।
এই হচ্ছে বিজ্ঞাপনের মহিমা। এতবার বলা হচ্ছে যখন তখন প্রোডাক্টটা ভালই নিশ্চয়।অনেকেরি স্বভাব আছে বিজ্ঞাপিত সব ক্রিম, মাথার তেল, টাকে চুল গজাবার ওষুধ নিজের ওপর পরখ করার।তার ফল প্রায়ই খুব সুবিধের হয় না।কাজ কি আর হয় না? হয় বৈকি। তবে অন্যরকম কাজ হয়। শিবরাম চক্রবর্তীর গল্পে আছে টাকে চুল গজাবার ওষুধে মাথার বাকি চুলগুলো উঠে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই তেল ভুল করে পায়ে ঘষায় পায়ে গুহামানবের মতো লোম গজায়! এরে কয় বিজ্ঞাপনে কাজ দ্যায়।
বিজ্ঞাপনের একটি বড় আকর্ষণ মুফত তোফা। বাংলায় যাকে ফ্রি গিফট বলা হইয়া থাকে। প্রথম এইরকম ফ্রি গিফট – বিনাকা সঙ্গীতমালা খ্যাত বিনাকা টুথপেস্টের সঙ্গে পাওয়া প্লাস্টিকের তৈরি ছোট্ট ছোট্ট, ভারি মিস্টি জন্তু জানোয়ার। এগুলো জমাত না, এমন খুব কম শিশুকেই পাওয়া যাবে। সেই বিনাকা পরে নাম পালটে হল সিবাকা, আর এই অতীব সুন্দর মিষ্টি উপহারগুলিও হারিয়ে গেল, স্বপ্নের শৈশবের মতো।
জীবনে প্রথম যে বিজ্ঞাপনী প্রচার মুগ্ধ করে –তা হল সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন। এই বোরোলিন বাড়ির মেয়ে বিখ্যাত শুটার সোমা দত্ত, তা অনেক পরে জেনেছি। রবিবার দুপুরেরমুখ্য আকর্ষণ ছিল মাংস-ভাত (অবশ্যই খাসির। আর ওইদিন আমার যে একটু বেশি বেশি খিদেও পেত, তা নিশ্চয় বলে দিতে হবে না।সারাদিন প্রেসারকুকারের কাছেই মনটা ঘুরঘুর করত। সকালে লুচি দিয়ে, দুপুরে ভাত, বিকেলে পাঁউরুটি, রাতে রুটি দিয়ে রবিবাসরীয় অধিবেশনের সমাপ্তি। তবে বিকেলের জলখাবারে আলু ঝোল দিয়েই চালিয়ে নিতাম, এটা হলফ করে বলতে পারি) , আর রেডিওয় বোরোলিনের সংসার। শ্রাবন্তী মজুমদারের মাদক কণ্ঠে বিখ্যাত জিংগল ‘ত্বক যদি ফেটে যায়, কেটে যায়, খসখসে যদি হয়, রোদ্দুরে ঝলসায়, সারা গায়ে মেখে নিন, সুরভিত অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম বোরোলিন’
আর সেই অনবদ্য টিপসগুলো- ‘শীতকালে সারাগায়ে তেল মাখার সময় তো রোজ পাওয়া যায় না। তাহলে উপায়? এক মগ ঈষদুষ্ণ গরম জলে দু ফোটা নারকেল তেল মিশিয়ে গায়ে ঢালুন। দেখবেন সমস্ত ময়লা বেরিয়ে ত্বক একদম ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে উঠবে।’ এ হচ্ছে বিজ্ঞাপনের রেডিও যুগ, তারও আগে পত্রপত্রিকায় সাদাকালোয় বিজ্ঞাপন দেখেছি। ‘দেশে’র পাতায় দেখা সাবেকি খোঁপা, পিঠে চাবির গোছা ফেলা নারী, আর আধুনিক, চাকুরে, ছোট চুল নারীর পাশাপাশি ছবি থাকত, আর বেশ একটা গল্পের ঢঙ্গে বলা থাকত, দিন বদলেছে, কিন্তু আজকেরব্যস্ত নারীর কেশচর্চায় সমান অপরিহার্য কেয়োকার্পিন।
আরও কতগুলো বিজ্ঞাপন মনে আছে চমৎকার কপির জন্যে।
‘সুলেখা কালি সুলেখা কালি, মনের কথা তোমায় বলি
তোমার রঙ বড় মধুর লেখা যেন কবিদাদুর’
‘কাকভুষুণ্ডি কাক বলে কা কা কা
সঞ্জয় ছাড়া কেউ সাইকেলে উঠবে না’ (অ্যাটলাস সাইকেলের কপি অনেকটা কমিক্সের মতো ছিল)
একটা বার্ষিকী দেশের পাতায় দেখা একটি বিজ্ঞাপন আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল। একটা ড্রেস মেটিরিয়ালের বিজ্ঞাপনেমডেল নারী বলছেন ‘ আমি একজন লেখিকা। তাই পোশাকের শৈলী আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ এটা দেখে আমার মনে হয়েছিল লেখা যথেষ্ট গ্ল্যামারাস পেশা, লেখকরাও, বিশেষ করে লেখিকারাও বিজ্ঞাপনের মডেল হতে পারেন।আর সেই বোধহয় প্রথম আশাপূর্ণা দেবী- টাইপ ঘরেলু ইমেজ ভাঙ্গা কোন ফ্যাশনেবল লেখিকার ছাঁচ এল কপিরাইটারদের কল্পনায়। এর বহ পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে দু তিনটি পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে দেখেছি, একটা বোধহয় কোন মোবাইল ফোন। কিন্তু কখনো কোন লেখিকাকে কোন পণ্যের বিজ্ঞাপনে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।জানি না, অমৃতা প্রীতম বা কমলা দাস কখনো বিজ্ঞাপন করেছেন কিনা।
প্রিন্ট অ্যাডে সেসময় মনে পড়ছে, খুব প্রেসারকুকারের অ্যাড থাকত, যার ক্যাচলাইন হত, এত ঝটপট রান্নাবান্না হয়, যে নারী পায় নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ।যদিও আরও অনেক গ্যাজেটের মতো প্রেসারকুকারকেও প্রথমে ভালো ভাবে নেওয়া হয়নি। তারাপদ রায়ের বিখ্যাত ‘কাণ্ডজ্ঞান’-র প্রেসারকুকার রম্য রচনায় এর প্রমাণ আছে। তারাপদ রায় প্রথম প্রেসারকুকার দেখেন ১৯৫৮ সালের এক শীতের সন্ধ্যায় বনগাঁ লোকালে। যার দাম ছিল ষাট টাকা। এর কিছুদিন পরে এক সদ্য বিবাহিত বন্ধুর বাড়ি নিমন্ত্রণে গিয়ে শুনলেন নুন আর আলুভাজা ছাড়া সেদিনের সব আহার্য যথা ভাত ডাল তরকারি মাংস সবই বিয়ের উপহারে পাওয়া প্রেসারকুকারে হয়েছে।এই শুনে এক বিলেত ফেরত বন্ধু বললেন প্রেসারকুকারের রান্না খেলে গেঁটে বাত হয় এবং চোখের অসুখ করে। গৃহকর্ত্রী, যিনি আবার একজন শিক্ষিকা, তাঁকে বুঝিয়ে পারলেন না এবং সেই বন্ধুটি সবাইকে অস্বস্তিতে ফেলে সেই দুপুরে শুধু দই ভাত খেলেন।
এর পর এল রঙ্গিন বিজ্ঞাপন সিনেমা শুরুর আগে। ক্লোজ আপ আর লিরিল। লিরিলের মেয়েটি পর্দায় আসতেই সবার হাহুতাশ শোনা যেত, ‘আহা রে, মেয়েটা মারা গেছে’
বন্ধুরা মনে পড়ছে নিশ্চয়, আমার লুক অ্যালাইকরাও সব মরে গেছে আমি দেখার সুযোগ পাবার আগেই। এখানেও লিরিলের মেয়েটি মারা গেছে। ওহঃ নট এগেন!
‘কী করে মারা গেল?’
‘আরে ওই ঝর্ণায় চান করছিল না? জলের তোড়ে ভেসে গেছে’
কেউ বলল পাথরে মাথা ফেটে মারা গেছে। আরও কেউ অন্য কোন তত্ত্ব দিল।লিরিলের মেয়েটির মৃত্যুরহস্যের মতো আর একটা রহস্যও আমি বুঝতে পারিনি। সাবানের বিজ্ঞাপনে সুইমিং কসটিউম পরাই দস্তুর, কিন্তু ঠান্ডা পানীয় বা সুটকেস এমনকি কলমের বিজ্ঞাপনেও মেয়েরা বিকিনি পরে কেন?গ্রে ম্যাটার কি কম পড়িয়াছে?
একটা কথা আমরা সেসময় কেউই বুঝতে পারিনি।আমরা আসলে অজান্তেই বিজ্ঞাপনের মায়াজালে জড়িয়ে যাচ্ছি, অর্থাৎ আগে যা ছিল নেহাতই পণ্যটির সম্পর্কিত তথ্যসূচক, এখন তাই হয়ে উঠল স্বতন্ত্র বিনোদন। বিজ্ঞাপনের মডেলদের স্টার ভ্যালু হিরো হিরোইনদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।সিনেমার আগে এতদিন দেখানো হত সরকারি ডকুমেন্টারি, খুব কম লোকেই সেগুলো দেখত, তারা বসে বসে গালাগাল দিত আর ভাবত এসব ব্যাড়ব্যাড়ানি বন্ধ হয়ে সিনেমা শুরু হলে বাঁচি। তারাই এই বিজ্ঞাপনের লোভে সাদা পর্দা থেকে দেখতে চাইত। লিরিল ছাড়া আর যে তিনটি সিনেমা শুরুর বিজ্ঞাপন হৃদয় হরণ করেছিল, তার সর্বাগ্রে ছিল ক্লোজ আপ। টুথপেস্ট যে অত গ্লসি লাল রঙের হয়, আর দাঁত মাজা ব্যাপারটা যে অত গ্ল্যামারাস হতে পারে তা ক্লোজ আপ শেখাল। আর সবচেয়ে বড় কথা, দাঁতের যত্ন ব্যাপারটা ডাক্তারের চেম্বারের আর শিশু পাঠ্য বইয়ের পাতা থেকে তারা এনে ফেলল প্রেমের নন্দনকাননে। মফস্বল বুঝতে পারল, যতই স্নো পমেটম মাখো না কেন, শ্বাসে দুর্গন্ধ থাকলে প্রেমিক প্রেমিকা জোটানো মুশকিল!
এরপর হরলিকস।আইকনিক হয়ে গেল ‘দিনরাত লোডশেডিং, ট্রামে বাসে বাদুড় ঝোলা, আরে বাবা শরীরটাকে তো রাখতে হবে’ আর ‘আমি তো এমনি এমনি খাই’
এবং নবরূপে বোরোলিন ‘জীবনের ওঠাপড়া যেন সহজে গায়ে না লাগে’
আর টিভির অডিও ভিশুয়াল বিজ্ঞাপনগুলো প্রায়ই তো অতি স্বল্প দৈর্ঘের সিনেমা, অর্থাৎ তারা গল্প বলে।
কে ভুলতে পারে, ক্যাডবেরি খেতে খেতে ক্রিকেটমাঠে ঢুকে পড়া মেয়েটির উচ্ছল নাচ, কিংবা সানফ্লাওয়ার তেলে ভাজা জিলিপির লোভে গৃহত্যাগ করতে গিয়েও বাড়ি ফিরে আসা বালকটিকে?!অনলি ভিমল আর গ্রাভিয়েরার বিজ্ঞাপন পর্দায় এলে শশী কাপুরের ছেলে করণ কাপুরকে দেখে মেয়েদের দীর্ঘশ্বাস পড়ত। আর সেই অপূর্ব জিংগলসগুলো, যারা সবসময় যেকোন ফিল্মের গানের চাইতে ঢের ঢের ভালো-
-বুলন্দ ভারত কি বুলন্দ তসবির, হামারা বাজাজ,
– মেরা পেয়ার শালিমার
-এই উজ্জ্বলতার স্রোতে এই বুকের ভিতর হতে, ফিরে আসে বারবার, শালিমার শালিমার
অনবদ্য সব ক্যাচলাইন –
বরাতিকা স্বাগত পানপরাগ সে কিজিয়ে (দা গ্রেট শাম্মী কাপুর),
লিখতে লিখতে লাভ হো যায়ে,
খানে কা বাদ কুছ মিঠা হো যায়ে,
দিমাগ কা বাত্তি,
মনমে লাড্ডু ফুটা,
কুছ খাট্টা কুছ মিঠা,
এই শব্দগুলো যেমন আমাদের কথায় ঢুকে গেল, তেমনই আমাদের অনেকেরি ঘরে ঢুকে পড়ল ম্যাগি এবং রসনা। এই এক প্যাকেট রসনা গুলে সারা পাড়াকে খাওয়ানোর কন্সেপ্ট পাবলিক এমন খেল যে, আমি, গেলেই রসনা খেতে হবে এই ভয়ে কত বাড়ি যাইনি!
সেই সময়, বিজ্ঞাপন বিরতিকে বলা হত কমার্শিয়াল ব্রেক, যাকে আমার এক পরিচিত মহিলা জানতেন কামারশালের বেগ বলে। এই ব্রেক এলে বয়স্ক মানুষদের খুব বিরক্ত হতে দেখেছি। এখন অবশ্য পুরোটাই কামারশালের বেগ, মাঝে মাঝে কিছু অনুষ্ঠান গুঁজে দেওয়া হয়। আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে সেই অনুষ্ঠান শুরু হলে আট থেকে আশি সবাই যৎপরোনাস্তি বিরক্ত হয়ে থাকেন বলে শুনেছি!