সেদিন হঠাৎ একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে গেল। কলকাতার নামজাদা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অতি জনপ্রিয় দুই ইংরেজি শিক্ষকের(যাঁদের কাছে প্রাইভেট টিউশন নেবার জন্যে এক বছর আগে বুক করতে হয়) প্রাক-বিবাহ ফোটোশুটের ভিডিও। শাহরুখ কাজলের ‘দিলওয়ালে’ সিনেমার জনম জনম গানটির সঙ্গে সমুদ্র, পাহাড়, বালিয়াড়ি, কোথায় না বিচরণ তাঁদের? এঁরা থাকতে নাকি টলিউড নায়ক নায়িকা পায় না? এবার থেকে কাস্টিং ডিরেক্টরদের টিউটোরিয়ালগুলো ঘুরে দেখার অনুরোধ করি। যেখানে দেখিবে জুতো , ছাড়িও না কোন সুতো, পাইলে পাইতে পারো নায়ক-রতন।
জুতো বললাম এই কারণে যে আমাদের মফস্বলে টিউশন ঘরে ঢোকার আগে জুতো খুলে ঢুকতে হত। বাইরে থেকে কোন ভর্তিতে আগ্রহী পড়ুয়ার অভিভাবক ওই জুতোর সংখ্যা দেখে মাস্টারের এলেম আন্দাজ করতেন। যত জুতো, তত টি আর পি। তবে আজকাল কলকাতার এয়ারকন্ডিশনড টিউটোরিয়ালগুলোতে জুতো খোলা বাধ্যতামূলক নয়। একবার শো হাউসে একটা সাপের সিনেমা এসেছিল, তার টিকিটের সঙ্গে একপাতা টিপ ফ্রি দেওয়া হচ্ছিল। এরে কয় খদ্দের ধরার কৌশল, বাংলায় মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি। কে না জানে, বাংলায় সবচেয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে শিক্ষা, যেখানে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ বিক্রি হয়, আর সেই ভবিষ্যৎ কখনো মায়া প্রকাশনীর মায়াগণিত, কখনো এই ভিডিওর মাধ্যমে ব্যক্তিমায়া বিপণন (সবই মায়া বুঝলেন কিনা)। হায়, আমাদের সময় এসব কোথায় ছিল!এখন তো টিউটরিয়ালে বিজয়ায় চিকেন রোল খাওয়ান হয়। সেসময় সামান্য কুচো নিমকি আর নাড়ুই অনেক ব্যাচে দুর্লভ ছিল।আর ছেলেপিলেরাও এত উন্নততর (উন্নততর বামফ্রন্টের মতো) হয়নি, তাদের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ঘুগনি। যে স্যার ঘুগনি খাওয়াতেন, তিনি তাদের কাছে ছিলেন ভগবান।
ভিডিওটা দেখে মাস্টার আর মাস্টারের বউ বলতে চিত্রপটে আঁকা যে ইমেজ-তা একেবারে খানখান হয়ে গেল।মলিন ধুতি পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা মাস্টারদের এখনো গ্রামে গঞ্জে দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু শহর মফস্বলে তাঁদের আর দেখা মেলে না। তাঁরা সুন্দরবনের রয়্যাল বেংগল টাইগারের মতো সংরক্ষণযোগ্য হয়ে পড়েছেন।
আমার মফস্বলে মাস্টাররা তখনি অনেকে প্যান্ট শার্ট পরতেন, যেমন সরল মাস্টারমশাই, যিনি ‘বাঘের চোখ দেখেছিস?’ বললেই নিচের ভাড়াটে কাকুর দুই পুত্র কন্যা ববি পাপু দুদ্দাড় করে পালাত। কোন একটা সিনেমা দেখতে গিয়ে শো হাউসে, দেখেছিলাম,সরল মাস্টারমশাই তাঁর স্ত্রী, মেয়ে নিয়ে গিয়েছেন। মাস্টাররা যে সিনেমা দেখতে যেতে পারেন, সেটাই তো অকল্পনীয় ছিল। যেকোন সেলিব্রিটির ইন্টারভিউতেই তাঁদের বলতেশুনি, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আগের মতো ফুচকা খেতে পারেন না, (পড়তে পড়তে আমার মনে হয়েছে এটাই বুঝি সেলিব্রিটি হবার মানদণ্ড। অনেকে যে পেটের জন্যে খেতে পারেন না, সেটা বোধহয় অত গ্ল্যামারাস অজুহাত নয়।) আমাদের মফস্বলে মাস্টারদের সিনেমা দেখা সেইরকম। মবড হয়তো হতেন না, কিন্তু ছাত্র বা তাদের অভিভাবকদের নজরে পড়ে গেলে ভারি অস্বস্তি।
আর সেখানে এই দুই জেন-ওয়াই মাস্টার যুগল বালিতে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন, একটাই স্ট্র দিয়ে ডাব খাচ্ছেন, আরো কী কী সব কান্ড করছেন, দেখে আমার গর্ব হচ্ছে। কে বলে বাঙালি ঘুমোচ্ছে। বাঙালি জাগছে।ওই যে শুনছেন না, মিয়াও!
এই তো সেদিন দেখলাম আমদের মফস্বলের সবেধন নীলমণি রবীন্দ্রভবন থেকে উচ্চনিনাদে হিন্দি গান নাচের আওয়াজ।একেবারে ফুল্টু এন্টারটেন্মেন্ট। কৌতূহলী হয়ে দেখি বাইরে ফেস্টুনে লেখা জনৈক স্যারের বর্ষপূর্তি উৎসব। মানে প্রাইভেট টিউশন-ডন কোন স্যার তাঁর ব্যাচ কে ব্যাচ ছেলেপিলেদের নিয়ে একটু আমোদ আহ্লাদ করছেন।আহা, সারা বছর পড়াতে গিয়ে মুখের ফেকো উঠে যায়, একটু ফূর্তিফার্তা না করলে চলে? শরীরখানা তো রাখতে হবে।
ভেবে দেখুন তো আমাদের সময়ে কী সব মাস্টারদের হাতে পড়ে আমাদের হাড়মাস ভাজা ভাজা হয়েছে! এরকম বিনোদন তো দূরের কথা, সিনেমা থ্যাটারের নাম পর্যন্ত শুনলে তাঁরা এন্সাইক্লোপিডিয়া নিয়ে তাড়া করতেন। সমাজেরও প্রত্যাশা ছিল মাস্টার হবে বামুনের গরুর মতো, খাবে কম, দুধ দেবে বেশি। সমাজের বিবেক হবার সমস্ত দায় তাঁদের। তাঁরা পড়াবেন, মাইনে পাবেন না, পেলেও পুরো মাইনে তো কখনোই নয়, তাই তাঁদের নানান ফন্দিফিকির করতে হবে সংসার চালানোর জন্যে। অশনি সংকেতের গঙ্গাপণ্ডিতের মতো ছেলেদের কাছে চেয়ে নিতে হবে কলাটা মুলোটা বেগুনটা। জেলের কাছে মাছ, শিউলির কাছে খেজুরের রস। তাঁদের ছেঁড়া জুতো, ভাঙ্গা ছাতা, কাঁধের ঝোলা কিছুতেই ঘুচবে না। সেই বুনো রামনাথ পণ্ডিতের স্ত্রী যেমন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের স্ত্রীকে সগর্বে বলেছিলেন, তাঁর হাতের এই লাল সুতো, যা নিয়ে ঘাটের রমণীরা হাসি ঠাট্টা করছে, তার ওপর কৃষ্ণনগরের ভবিষ্যত নির্ভর করছে, সেইরকম মাস্টারদের ছেঁড়া জুতো, ভাঙ্গা ছাতা আর কৃচ্ছসাধনের ওপর যেন সমাজের শুদ্ধতা নির্ভর করছে।
একসময় একটা ছড়া সবার মুখে মুখে ফিরত-
পুলিশ তুমি যতই মারো
মাইনে তোমার একশো বারো
পুলিশের কম মাইনের শোধ যেমন সে তুলেছে ঘুষ নিয়ে, মাস্টাররাও শোধ তুলেছে সুকুমারমতি বালক বালিকার ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। মাস্টারদের বেতন কম ছিল, তাই বেত ছিল উদ্যত। যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষাব্যবস্থাকে গরাদের বাইরে প্রকৃতির কোলে নিয়ে গেলেন, তিনিও বালক বয়সে তাঁর রেলিং ছাত্রদের কি নির্মমভাবে পেটাতেন, তা স্মরণে আছে নিশ্চয় সবার।একটা সময় বাল্যবিবাহ, অকালবৈধব্য ও তার ফলে সমাজে যে অনাচার তৈরি হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গে কে যেন বলেছিলেন, তেষ্টার মুখে ওদের জল খেতে না দিলে ওরা তো নর্দমার জলই খাবে। সেইরকম সারা সমাজ ভোগ করবে আর যত কৃচ্ছসাধন ও আত্মত্যাগের দায় যদি বেচারা মাস্টারের কাঁধে চাপানো হয়, তবে তাঁরা তো ছেলেপিলেদের বেত মেরেই সেই শোধ তোলবার চেষ্টা করবেন, হয়ে উঠবেন তিক্ত, বদমেজাজী, সংকীর্ণমনা।তাঁদের অবদমিত যৌনতা বিষাক্ত সাপের মতো লুকিয়ে থাকবে মনের গহন খাঁজে, সুযোগ পেলেই বিশ্রীভাবে বেরিয়ে ছোবলাতে চাইবে শরীরের আড় না ভাঙ্গা সদ্য কিশোরীকে। হয়তো স্ট্যাটিস্টিক্স নিলে দেখা যাবে, বাড়ির বাইতে যত মি টু, তার চেয়ে সংখ্যায় কম নয় বাড়ির ভেতরে ঘটা মি টু, যা ঘটান অতি প্রিয়জন ও গৃহ শিক্ষকরা।
আমার এক বন্ধুকে বাড়িতে বাংলা পড়াতে আসতেন এক সৌম্য দর্শন শিক্ষক, দুটি ছেলে, স্ত্রী নিয়ে সুখী সংসার তাঁর। তিনি একদিন, তাঁর গোড়ালির বয়সী ক্লাস নাইনের মেয়েটির হাত চেপে বললেন- তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছ। মেয়েটির মা জানতে পেরে তৎক্ষণাৎ তাঁর আসা বন্ধ হল। ক্ষত বা ক্ষতি সেভাবে হবার আগেই, তাকে ঠেকানো গিয়েছিল। কিন্তু অনেকসময় বড় দেরি হয়ে যায়, আর তার ফল জীবনভর ট্রমা, স্বাভাবিক সুন্দর যৌনতায় অনীহা।
এই ঘটনাটি অবশ্য আমাদের বন্ধুমহলে একটা হাসাহাসির বিষয় হয়েই রইল। বাংলা ফিল্মের হিরোর ডায়লগ যদি জেঠুর বয়সী মাস্টারমশাইয়ের মুখে চলে আসে, তা একই সঙ্গে ট্রাজিক ও কমিক। অর্থাৎ তা বিপদ এবং আপদ দুটোই।
তবে, বিশ্বাস করি, এঁরা সংখ্যায় সামান্যই। বেশিরভাগ শিক্ষকের কাছে তাঁর ছাত্র ছাত্রী এখনো সন্তান তুল্য। তবে ওই ভাইরাল ভিডিওর ঝাক্কাস শিক্ষক-যুগলের তুলনায় মান্ধাতার বাপের আমলের মাস্টারদের যে কোথায় রাখব, বুঝতে পারছি না।তাপ্পি মারা জিন্স, ব্র্যান্ডেড চশমা আর নাইকের জুতোর পাশে তাঁদের ধুতি চাদর কিংবা পাড়ার দরজির বানানো প্যান্ট-শার্ট আর ঝোলা ব্যাগ কোথায় মুখ লুকোবে কে জানে। মনে পড়ছে সেই সময়ের অতি জনপ্রিয় ফিজিক্স স্যার (কবিও, কংক্রিটের সাঁকো নামে একটি কবিতার বই আছে তাঁর) সুনীল স্যারের বিয়ের কথা। একটা রুচিস্মমত আমন্ত্রণপত্রে চমৎকার বাংলায় লেখা ছিল বিবাহোত্তর প্রীতিভোজ-মানে রেজিস্ট্রি বিয়ের পর খাইদাই আরকি। তাতেই শহর তোলপাড়। ছাত্রছাত্রীরা একেবারে ফিদা! ভাবতে হৃতকম্প হচ্ছে, সুনীল স্যার শাহরুখ খান হয়ে পাহাড় সমুদ্রে নেচে নেচে গাইছেন- রঙ দে মুঝে গেরুয়া, আর তাঁর বক্ষল্গনা অদিতিদি, ডিজাইনার পোশাক পরে ধুম মাচিয়ে দিচ্ছেন, আর সেই ভিডিও দেখে মিম বানিয়ে ফেলছে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা!