• Uncategorized
  • 0

ছোট গল্পে সুশোভন কাঞ্জিলাল

অনকোলজি ডিপার্টমেন্ট

সরকারি হসপিটালের অনকোলজি ডিপার্টমেন্ট। একশ জনের মতন লোক অপেক্ষা করছে। যার মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ লোক যমের সঙ্গে যেন লড়াই করছে আরো কিছুদিন এই নোংরা পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য। কিছু লোক মেঝেতে চাদর পেতে শোয়া, কিছু চুলবিহীন মানুষ বসে ধুঁকছে, কিছু মানুষ ভাঙ্গার মুখে কিন্তু না মচকে মাথায় মাফলার বা ওড়না ঢেকে জানি না কার কাছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাকি সুস্থ পঞ্চাশ শতাংশ যারা মৃত্যুর পথযাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে এসেছে তারা মনে হয় আরো বেশী ভয়ার্ত আর শোকাহত। যেমন শোক শ্মশানযাত্রীদের চোখে, মুখে, আবেগে, সাধারণত দেখা যায়।
আমার কাকুর ক্যান্সার ধরা পরেছে খাদ্যনালীতে। তাই আমিও এসেছি যমের সঙ্গে এক হাত লড়তে সেই লোকটার জন্য যে আমার ছোটবেলার কল্পতরু। সময়ের অনেক আগে পৌঁছে যাওয়ায়, আমরা চারজন, সবাই বসার জায়গা পেলাম একটা কাঠের বেঞ্চে। আমাদের যে কেউ দেখে বলে দেবে যে চারজনের মধ্যে যাকে সবচেয়ে সাহসী লাগছে সেই লোকটাকেই আজ তিন নম্বর কেমোথেরাপি আর পাঁচ নম্বর রেডিও একটিভ রে নিতে এসেছে।
নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে এসেছি তাই সব কিছু দেখছি ঘুরেঘুরে| ঢোকার দরজার সামনে দেখি একজন বুড়ো দাদু কাঁদছে। আমি তার সঙ্গের লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে খুব ব্যাথা হচ্ছে কি ওনার? তিনি বললেন “আব্বা কিসুতেই মাইনতাসে না যে এই কেমো খাইদ্য নয়। রোজা নস্ট হইব না!” বেরিয়ে সিগারেট ধরাতেই বছর পঁচিশের এক সুদর্শন যুবক এসে বললো “দাদা একটু আগুন হবে?” না নেভানো দেশলাই কাঠিটা এগিয়ে দিতেই হাত কেঁপে আগুনটা নিভে গেলো। ছেলেটার কপালে দেখি কালো স্কেচপেনের জ্যামিতিক রেখা টানা কয়েকটা। সে বুঝে নিজেই বলল “হ্যাঁ! ব্রেন ক্যান্সার! দিন দেশলাইটা।”
নিজেকে খুব বোকা লাগছিল বলেই হয়ত মেকআপ দিয়ে প্রশ্ন করে ফেললাম যে ওর সাথে কে আছে? একটা লম্বা সুখটান দিয়ে বলল “নো ওয়ান! বাড়িতে কেউ জানে না এখনো। বাবার দুবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে| খুব অভাবের সংসার, এখনো চাকরী পাইনি। যদি দেখি আর বাঁচার চান্স নেই তো সন্যাসী হয়ে যাচ্ছি বলে পালিয়ে যাব|এটলিস্ট বুড়ো বুড়ি আমার ফেরার আশায় বেঁচে থাকবে|” চোখে জল চলে এসে ছিল তাই খুব বেশী করে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে মুখ লোকালাম| বাইরে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে ধাক্কা লাগলো একটা লোকের সঙ্গে| সে চিৎকার করে আমায় গালাগালি দিলো| “আহাম্মক দেখতে পারিস না|মেয়েটার যদি লাগতো!” আমার মনটা এমনি কাহিল। থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওনার সঙ্গের মহিলা বললেন “দাদা মেয়েটা খুব কাঁদছে, তাই ওর বাবার মাথার ঠিক নেই”| আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে খেয়াল করলাম লোকটার কোলের ছোট মেয়েটার একটা চোখ তুলো দিয়ে ঢাকা| ভুল জায়গায় এসেছে! আমি বললাম “বৌদি চোখের বিল্ডিংটা এখান থেকে সোজা গিয়ে বাঁদিকে”|লোকটা এবার শান্ত গলায় বলল “দাদা চোখের মনিতেও এই রোগ হয়| আমার মেয়ের পাঁচ বছর বয়েস আর শেষ এক বছর আমরা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছি”| ছোট্ট মেয়েটা এক চোখের মিষ্টি হাঁসি হাসলো আমার দিকে তাকিয়ে|
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। কেন আমি এতজনের দুঃখ দেখব আর সহ্য করব? আমি ফিরে গেলাম নিজের কষ্টের জায়গায়| কাকু মাথা এলিয়ে বসে আছে তার ক্ষয়িষ্ণু জীবনের একমাত্র সম্বল, নিজের ছেলের কাঁধে| কাকুর ছেলে আমায় দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো “দাদাভাই তুই বোস”| সেই ফাঁকে একটা অল্প বয়সী মেয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে ফাঁকা জায়গাটায় বসে পড়ল ছোঁ মেরে| আমার আজীবন ঠান্ডা মাথার রুগ্ন কাকু হয়ত প্রথমবার জীবনে রেগে গেল “এটা কি ঠিক হলো! এটা তো অসভ্যতা”| কাকু কে আমি আর ভাই শান্ত করানোর চেষ্টার আগেই কাকুর ডান পাশের মহিলা কাকুকে বলল “ভাই ওটা আমার মেয়ে| একটু বসুক| ওর বাবা আমায় ছেড়ে চলে গেছে| তার বদলে এই রোগ সঙ্গ দিয়েছে| দীর্ঘ তিন বছর ও আমায় বাঁচানোর জন্য অবিরাম দৌড়ে যাচ্ছে| ক্লান্ত হয়ে সেচ্ছায় যখন আজ একটু বসতে চাইছে একটু বসতে দাও ভাই”| বাঁচার আশায় উদ্ভাসিত মুখটার মাথায় একটিও চুল নেই| হতাশা চকচক করছে তার মাথায় আর তার ক্লান্ত মেয়ের দুটো চোখে|
এবার আসল গল্পে আসি| আমরা সবাই খালি পেটে যখন সকাল সাতটায় এসে দুপুর দুটো অবদি অপেক্ষা করছি যে কখন কাকুর কেমোর পালা আসবে তখন দেখি একজন টাই পরা ধোপদুরস্ত লোক ঢুকল বিশাল ওয়েটিং হলে| সেই মর্মান্তিক পরিবেশে সে কিন্তু একদমই বেমানান| মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ মনে হলো| আমি কৌতুহল বশতই ওর পেছন নিলাম| কতক্ষন আর একভাবে বসে থাকা যায়! কিন্ত সে লোক খুব চালাক নিজেই হঠাৎ পেছন ঘুরে আমাকেই বলল “আপনি কোন একান্ত আপনকে এই মৃত্যুপুরীতে নিয়ে এসেছেন স্যার!আপনি আমায় মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভ ভাবছেন? কিন্তু আমি আসলে হলাম একজন সামান্য সেলসম্যান”| আমি অপ্রস্তুত হয়ে সরে গেলাম|
তিন ঘন্টা পরে যখন দেখলাম সবাই সেই লোকটাকে ঘিরে ধরে মারছে তখন আমি স্বভাবতই আটকানোর একটু চেষ্টা করলাম| পারলাম না| মানুষের সেই ভীষণ আক্রোশ আর ক্ষোভ রোখার ক্ষমতা আমার নেই| কারন সেই সেলসম্যান নাকি মুক্তি বিক্রি করছিল| চুপিসারে ক্যান্সার পেশেন্টদের কানে কানে গিয়ে বলছিল “চলো বিপ্লব করি! তোমার মনে দুঃখ যে ক্যান্সার হয়েছে! তুমি তো ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছো| কিন্ত তোমার প্রিয়জনরা কি দোষ করেছে? জন্ম যখন হয়েছে মৃত্যু অবসম্ভাবী| আরে আমরা তো মানুষ! এত কষ্ট কেনই বা পাবো! আর নিজের ভালবাসার লোকেদেরই বা কেন কষ্ট দেবো! নিয়তি যেখানে ডাক দিয়েছে সেখানে পাল্টা আঘাত করে মরে গেলেই সবার মঙ্গল|”
যারা সেই অভিশাপে ভুগছে তাদের কাছে কথাগুলো মুক্তির কথা মনে হয়ে ছিল তাই তার প্রডাক্ট বিক্রী হচ্ছিল|
সে এখন পাবলিক মার খেয়ে পুলিশ থানায়| আমার জন্মগত কৌতুহল বেশী তাই সব খোঁজ লাগিয়ে থানায় গিয়ে সেই মুক্তির দালালের সঙ্গে দেখা করলাম|
পঁচিশ বছরের ছেলেটার নাম গণেশ দাশ| সে ইঁদুর মারার বিশ বিক্রি করে| মা ক্যান্সারেই মারা গেছে দুবছর আগে| এই মার্কেট তখনই ওর চেনা| জীবনে সে বড় হতে চায়| তাই চাকরী বাঁচাতে সে ইঁদুর মারার টার্গেট মানুষের মাধ্যমে হয়ত অ্যাচিভ করতে চেয়েছে| অনুসূচনাহীন দৃষ্টি নিয়ে গনেশ দাস আমায় সাবলীল ভাবে জিজ্ঞাসা করল “স্যার জীবনে বেঁচে থাকতে পীড়িত মানুষকে কষ্টের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া কি দোষের? সমস্ত পৃথিবী জুড়ে তো এই চলছে| তাহলে আমার দোষ কি?”
তার প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে ছিল না| তাই দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলাম পুলিশ স্টেশন থেকে|
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।