তুলিকা দিদিমণি এসে পেছন থেকে কামিনীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, কিরে তোর নাকি কাল ছুটি হয়ে যাবে? এই কামিনী কিরে কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে, বলনা কালকে ছুটি হবে নাকি তোর? কথা শেষ করেই বেশ বুঝতে পারলো তুলিকা, কামিনীর বুক ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে।
কিরে কি হলো কি তোর? কাল ছুটি হবে এতো আনন্দের কথা রে, কাল থেকে তুই খাঁচার বাইরে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাবি, তা না এই আনন্দের দিনেও এমন করে কাঁদছিস কেন?
কোথায় যাব আমি? কে আমায় রাখবে? কি বলছো দিদিমণি, আমার কী আর কোথাও যাওয়ার জায়গা আছে। সেই কোন ছোটবেলায় বাবা মা বিয়ে দিয়েছিল ঘরে একটা পেট কমবে বলে, আর শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যত না ভাত খেতাম, তার থেকে তিনগুণ বেশি মার খেতে খেতে খাওয়ার ইচ্ছেটাই কেমন চলে গেলো। রোজ গলা অবদি মদ গিলে এসে কোনোদিন বেল্ট, কোনোদিন চটি যা হাতের কাছে পেতো তাই দিয়ে বেদম মারতো আমার স্বামীটা।রোজ মুখ বুজে সহ্য করে যেতাম। জানো দিদিমণি একদিন রাতে বাড়ি ফিরলো প্রায় একটা, আমি সেদিন জ্বরে কাতরাচ্ছি, ঘরে ঢুকেই আমায় মারতে শুরু করলো। সেদিন আমি আর পারিনি জানো, আমি বাধা দিতে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিলাম। আমার স্বামী আচমকা গিয়ে পড়লো মেঝেতে। তারপর দেখলাম রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশটা আমি কোনরকমে তোলার চেষ্টা করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম সে আর নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির লোকজন, আর পাড়া পড়শী এসে সবাই মিলে আমায় এলোপাথাড়ি মারতে লাগলো, তারপর তুলে দিল পুলিশের হাতে। তারপর কোর্ট কাছারির অলিগলি সব ঘুরে আমার ঠাঁই হলো এই সংশোধনাগারে। দিদিমণি,আমি সেদিন মারতে চাইনি মানুষটাকে, কেউ বিশ্বাস করলনা আমায়। যে মেয়েটা কোনোদিন সাত চড়ে রা করেনি সে একটা মানুষ মেরে ফেলতে পারে, সব্বাই যে এটাই বিশ্বাস করলো দিদিমণি।সেই থেকে তো এটাই আমার ঘর।
দিদিমণি আমি সত্যি বলছি আমি খুন করিনি গো, ওই ধাক্কা মেরে সরাতে গিয়ে, তারপর কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গেলো কামিনী। তারপর আবার বললো আমি এখন সংশোধনাগারে। হাহাহা আমার নাকি সংশোধন হবে, আমি তো কোনো অন্যায় করিনি দিদিমণি, তাও আমার কি সংশোধন করলো এই সংশোধনাগার।তবে এই কয়েক বছরে এই ছোট্ট চার দেওয়ালের খুপরিটা আমার নিজের মনে হতো, সেই মাথা গোঁজার ঠাঁই ও তো কাল থেকে থাকবেনা।
এই কয়েক বছরে বাবা একটা দিন দেখতে এসেছিল আমায়, এসেই বলে তোর মত খুনী মেয়ের জন্ম দেওয়াই পাপ হয়েছে আমার, তোর জন্য আমার মাথা কাটা যায়। সবাইকে বলি আমার কোনো মেয়ে নেই, আমার মেয়ে মরে গেছে। তোকে একটা কথা বলতে এসছি কাউকে বলবিনা যে আমি তোর বাবা, আমাদের সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই আর। সেইদিন আর চোখের জল ও আসেনি জানো দিদিমণি, শুধু দুচোখ ভরে শেষবারের মত বাবার মুখটা প্রাণ ভরে দেখে নিচ্ছিলাম। এই জন্মে এই তো শেষ দেখা তাই যতক্ষণ দেখা যায় আর কি। হাহাহাহা কেমন বাবাটাও কেটে পড়লো দেখলে দিদিমণি।হাসতে হাসতে অঝোরে কাঁদতে থাকে কামিনী তারপর আবার বলতে শুরু করে। আচ্ছা দিদিমণি আমি তো এখন এখানে চাষ করি, বাগান পরিষ্কার করি আমায় তোমরা রেখে দিতে পারনা। আজকে সকালে যখন ম্যাডাম বললেন কামিনী কাল তোর ছুটি। তারপর থেকে খুব মনে হচ্ছে জানো আমি কি যমের ও অরুচি, আমার মরন ও হয়না, দ্যাখো এই জেলখানাতেও আমার আর ঠাঁই হবেনা।
জানো দিদিমণি যখন আমি এইটে পড়ি, আমাদের পাশের পাড়ার মাধব আমায় রোজ দেখতো স্কুলে যাওয়ার সময়। তোমায় মিথ্যে বলবনা দিদিমণি আমিও আড়চোখে দেখে নিতাম সে এলো কিনা, কখনো আবার সোজাসুজিই তাকাতাম, তবে ওর চোখে কেমন কষ্ট ভরা ছিল জানো তাকিয়ে থাকা যেতনা, চোখ নামিয়ে নিতাম।সেবার রথের মেলায় মাধব আমায় একটা কাজ পেলেই বিয়ে করবে বলেছিল, বাবাকে সেকথা বলেও ছিলাম জানো? কিন্তু বাবা রাতারাতি বিয়ে দিলো জোর করে তারপর থেকে আর কোনোদিন মাধবকে দেখতে পাইনি।
তারপর হঠাৎ একদিন পুলিশের গাড়িতে কোর্টের সামনে, মামলার শুনানি ছিলো সেদিন। আমার সঙ্গে ছিলো মহিলা পুলিশ আর পরনে ছিলো একটা সিনথেটিক শাড়ি আর দুহাতে হাতকড়া। গাড়ির জানলা থেকে পরিষ্কার দেখলাম সামনের চায়ের দোকানে মাধব আর ওর বৌ দুজনে ভিড় সামলাচ্ছে। বেশ মানিয়েছে ওদের জানো দিদিমণি। কিন্তু আমার দুচোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তখন জলে, আবছা হয়ে গেলো মাধবের মুখটা। দুজন মহিলা পুলিশ যখন আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম মাধবকে। মাধব ও কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল তারপর নামিয়ে নিল চোখটা। কি জানি হয়তো সেও ভাবলো আমি খুনী।
আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে কামিনী। তুলিকা দিদিমণি কামিনীর মাথায় হাত রেখে বলে আমার সাথে যাবি কামিনী? আমি একটা এন জি ও চালাই, ওখানে অনেক রকম কাজ করি আমরা। কাজ করবি আমার সাথে? কামিনী হাতটা ধরে ফেলে দিদিমণির, তুমি আমায় যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যাবো। আমার যে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। জানো আমি গান শিখতে চাইতাম ছোটবেলায়, বাবা বলতো আর গান গেয়ে আমায় উদ্ধার করতে হবেনা, একটু বয়স হলেই একটা বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি। বাবা আসলে আমায় দেখতেই পারতোনা, তার কারণ খুঁজে পাইনি জানো। আর ঐযে আমার স্বামী সেও যে কেন এত মারতো সেও বুঝে পেলাম না। দিদিমণি সত্যি বলছি আমি কিন্তু খুন করিনি। কিন্তু কেউ কেন বিশ্বাস করলোনা বলতো?
আমি জানি কামিনী তুই খুন করিসনি। তৈরি থাকিস কাল ছুটির পর। কাল থেকে তোর নতুন জন্ম, নতুন করে জীবনটাকে শুরু করিস। কাল তোর জীবনের প্রথম সকাল, আমি অপেক্ষা করবো তোর জন্য এই জেলখানার বাইরে।
তুলিকার পায়ে হাতটা ছোঁয়ায় কামিনী, নতুন দিনের স্বপ্ন তখন ওর চোখে মুখে। দিদিমণি একটা গান আমার খুব মনে পড়ছে জানো।
আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে।