ছোটগল্পে স্বপন পাল

একটি ভাইরাল এফেক্ট
সকাল থেকে সাতবারের চেষ্টায় এইমাত্র পেলো রাধিকাকে। সদ্য গুটি এগিয়ে যাবার মতো রাধিকার ক্ষুদে ছবিটা সুরুৎ করে নেমে এলো নবেন্দুর লেখা, hi ki ko60 র ওপর। তারপর ছ’টা hi, একটা ফুলটুল পাঠাতে পারে ধরে নিয়ে খুঁজতে লেগে গেলো আজ নতুন কোনো প্রভাতী মেসেজ এসেছে কিনা। কিন্তু ওপার নীরব। বিরক্তি জমা হচ্ছে নবেন্দুর বুকে। কি যে করে মেয়েটা, শুধু চাপে রাখে। একটা ফোন করবে যে সে উপায় নেই। রাধিকার কড়া আদেশ। না মানলে কথা বন্ধ। আধঘন্টা পরে উত্তর এলো রান্না করছি। মায়ের জ্বর। দু’হাতে নুন তেল লেগে। পরে ফোন করবো। ফোন করবে রাধিকা এতেই নবেন্দু আত্মহারা। কি কি বলবে গুছিয়ে নিতে থাকে
মনে মনে। গতকাল সকালের পর কোনো যোগাযোগ হয়নি রাধিকার সাথে নবেন্দুর। এ বড় কঠিন সময়। এক ভাইরাস সারা দেশকে ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছে। সব চলাচল থেমে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে সব আনন্দের উৎস। কোনো রকমে চাট্টি খেয়ে মরার মতো পড়ে থাকো ঘরের ভিতর। হাঁচি-কাশি পেলেও জোরে শব্দ করা যাবেনা। কেউ যদি মিউনিসপ্যালিটিতে বা পুলিশে খবর দিয়ে দেয় তো কেলো। কবে যে বাস টাস চালু হবে, অফিস খুলবে। ওফ্, ছুটিও যে কি যন্ত্রণা দিতে পারে নবেন্দু উঠতে বসতে টের পাচ্ছে। প্রায় ঘন্টাখানেক পর এলো রাধিকার ফোন। অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে স্নান করতে বাথরুম ঢুকতে যাবে ওমনি ফোন বাজলো। রাধিকার উদ্বেগ আর উত্তেজনায় মেশানো গলা শুনলো নবেন্দু। এই কি করছিস রে ? উত্তর দেবার সুযোগ
না দিয়েই একেবারে হুকুম দিয়ে বসলো, তাড়াতাড়ি তোর গাড়িটা নিয়ে চলে আয়, মাকে মনে হচ্ছে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। খুব জ্বর আর সঙ্গে কাশি, বুঝতে পারছিস, তাড়াতাড়ি কর। মাথাটা বনবন ঘুরে চলেছে। গাড়িটা লকডাউনের আগে গ্যারেজে দেওয়া হয়েছিল, তারপর থেকে লকডাউন, তাই সেটা আনা হয়নি, রাধিকা তা জানেনা, বা জানলেও ভুলে গেছে। এখন এসব কথা ওকে বলাও যাবে না। মাসিমার এতোটা খারাপ অবস্থা। প্রথমেই রাজীবকে ফোন করলো নবেন্দু, রাজীব গাঁইগুঁই করছে দেখে আলোক। আলোকের ফোন লাগলো না। শেষে পার্থ বললো, দাঁড়া দেখছি কি করা যায়। নবেন্দুর মনে পড়লো, পার্থটাতো ওর গাড়ি বেচে দিয়েছে ভাল দাম পেয়ে, এখনো নতুন গাড়ি কিনতে পারেনি যদ্দূর জানে, তাহলে ও কি দেখবে ? ফালতু দেরি করিয়ে দেবে আর মাসিমার অবস্থা আরও খারাপ হবে। ভাবতে ভাবতেই আবার পার্থর ফোন। বললো, পনেরো মিনিটে আসছি দাঁড়া। নবেন্দুকে কিছু জিজ্ঞাসা সুযোগই দিলো না। ফ্ল্যাটের দরজায় তালা মারতে মারতে নীচে পার্থর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। শালা ষাঁড়ের মতো চেঁচায়। আশপাশের সব লোকজনকে জানিয়ে ছাড়বে দেখছি। নীচে এসে সেকথা পার্থকে বলতেই গালা ছেড়ে হাসলো, তারপর একটা প্যাকেট এগিয়ে দিলো, বললো, এতে মাস্ক আর গ্লাভস আছে, পরে নে। তুই নিশ্চয় মাস্ক নিয়ে বেরোসনি ? লজ্জা পেলো নবেন্দু। নাঃ, সত্যিই সে
ভুলে গেছে। গাড়ি চালাতে চালাতে পার্থ বললো, আমার পাশের বাড়িতে ডাক্তার থাকে আমার বন্ধু, ওই আমাকে দু’জোড়া সিল করা মাস্ক আর গ্লাভসের প্যাকেট দিয়েছিল। একদিন বেরিয়েছিলাম ওই বস্তিতে খাবার দিতে দলে পড়ে, তো সেদিনই সন্ধ্যেয় সৌরভ এগুলো দিয়ে গেলো বুঝলি। নবেন্দুর প্রশ্ন, গাড়িটা কার আনলি ? একটু চোখ টিপে পার্থ জবাব দিলো, ওই স্বেচ্ছাসেবকদের কারো হবে, চাবিটাও রেখে গিয়েছিলো তাই নিয়ে চলে এলাম। ওদের ফান্ডে বোধহয় আর তেমন টাকা-পয়সা নেই তাই বস্তিতে খাবার দাবার দেয়ার প্রোগ্রাম আপাতত স্থগিত। পথ দেখিয়ে রাধিকাদের পুরোনো বাড়িটার সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই পার্থকে গাড়িতে বসতে বলে নবেন্দু নেমে গেলো। রাধিকা অপেক্ষাই করছিলো। মাসীমা খুব কষ্ট করে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠতেই নবেন্দু আর রাধিকা উঠে বসলো। পার্থ জানতে চাইলো কোন হাসপাতাল ? রাধিকা বললো, প্রথমে আমার সম্পর্কে মামা হয়, ওঁর একটা নার্সিংহোম আছে, ফোনে কথা হয়েছে, বেশি হৈচৈ না করে ওখানে গেলে ভর্তি করে নেবে। ওদের আইসোলেশন ওয়ার্ড আছে। তারপর জ্বর-কাশি এসবের মতিগতি দেখে টেস্ট করাবে। নার্সিংহোম প্রায় জনশূন্য। রাধিকার ডাক্তার মামা আর একজন নার্স ছিলো সেই সময়। প্রায় মহাকাশে যাবার মতো পোশাক তাদের। আধঘন্টার মধ্যেই সব দেখেশুনে ভর্তি করা হলো রাধিকার মাকে। ডাক্তারবাবু বললেন, এখন কিছুই বলা
যাচ্ছেনা। জ্বরটা কমে কিনা আগে দেখি। তারপর আগামীকাল সোয়াব টেস্টের জন্য স্যাম্পল পাঠাবো। সে রিপোর্ট আসতে একদু’দিন লেগেই যাবে। তারপর ওদের তিনজনের দিকে চোখ তুলে বললেন, কিন্তু সমস্যাটা অন্য যায়গায়, এই যে তোমরা পেশেন্টকে আনলে এর জন্য তোমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। দ্যাখো, আমার নার্সিংহোমের একটা সুনাম আছে। এসময়ে কোথাও চট করে প্রাইভেট ডাক্তার পাবেনা, নার্সিংহোম ভর্তি নেবেনা। কিন্তু আমি আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরি রেখেছি। অতো ভীতুও নই আমি। কিন্তু সরকারি নিয়মকানুন তো মানতে বাধ্য, তাই না ? কাজেই বিশ্বস্ততার সাথেই তোমাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। আপাতত পেশেন্টের টেস্ট রিপোর্ট আসা পর্যন্ত। রিপোর্ট পজেটিভ হলে পাক্কা দু’সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইন থেকে তোমাদেরও টেস্ট হবে। কোনো রকমে আচ্ছা বলে নার্সিংহোম থেকে বেরোনো গেলো। কিন্তু এবার নবেন্দু তার ফ্ল্যাটে ফিরবে কি করে ? আবার শর্ত ভাঙ্গলে, কেউ যদি পুলিশে খবর দেয় তাহলে দেখতে হচ্ছে না। গাড়িতে বসে রাধিকা বললো, আমাদের বাড়ির দোতলার ঘর ফাঁকা আছে। খাটবিছানা
টয়লেট সব পাবি, আমাদের বাড়িতে আপাতত থাক তো। মায়ের টেস্ট হোক, তারপর দেখা যাবে। ফ্রিজে এক সপ্তাহের বাজার আছে, আমি রান্না করে দেবো, কোনো অসুবিধে হবেনা চল। অগত্যা। গাড়ি থেকে নেমে রাধিকার বাড়ি ঢুকতে যাবে পিছন থেকে পার্থ বললো, না রে। আমি ফিরেই যাই। আমার তো ফ্ল্যাট নয় নিজেদের বাড়ি। বাবা-মা দেশের বাড়িতে, এখন আসতেও পারবে না। আমি ওখানেই হোম কোয়ারেন্টাইনে
থাকবো। শুধু গাড়িটা কাল শ্যাম্পূ দিয়ে ধুয়ে ভেতরটা স্যানিটাইজার দিয়ে মুছতে হবে বুঝলি। অনেক কাজ। আমাকে শুধু মাসীমার রিপোর্টটা জানাস। এই বলে পার্থ গাড়ি নিয়ে চলে গেল। সূর্য ডুবতে এখনো একটু দেরী আছে। রাধিকা বললো, জামা-প্যান্টগুলো ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দে। তারপর বাথরুমে গিয়ে ভালো করে
সাবান মেখে চান কর। আমি অন্যটায় ঢুকছি। চান হয়ে গেলে খেয়ে নিবি, আজ দুপুরে আমাদের কারো খাওয়া হয়নি। পার্থটা আমার রান্না মিস করলো। স্নানের জল গায়ে লাগতেই একটা শিহরণ খেলে গেলো নবেন্দুর প্রতি রোমকুপে। হলোটা কি ? সে আর রাধিকা একবাড়িতে ভাবা যায় ? মাসিমার অসুস্থতা নবেন্দুকে কি একটু বেশিই খুশি করে তুললো ? মাথাটা কেমন ভোঁ ভোঁ করছে নবেন্দুর।