ছোটগল্পে সন্দীপা বসু
রূপকথার জন্ম
দেখি দেখি দেখি… সাইড, সাইড…
হেলেদুলে চলতে দলটির কাছাকাছি পৌঁছে পেছন থেকে তাড়া দেয় ঝাঁকা মাথায় লোকটি। সারদা আলগোছে ঘাড় ঘুড়িয়ে আদুরে গলায় বলে, “আগে আমরা দেখি।” বলেই সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে রিনরিনে কন্ঠে হেসে ওঠে। সঙ্গীদের মুখেও তখন ছেলেমানুষি হাসি। ঘিঞ্জি বাজার এলাকার অন্ধকার গলিগুলির মধ্যে সূর্য ঢুকতে পারে না দিনেমানে, মানুষ তো কোন ছাড়। একজন, ঘেঁষাঘেঁষি করে কোনোরকমে পাশাপাশি দুজন, ব্যাস। তার মধ্যেই ঝাঁকা মাথায় কুলি, পাইকারি ক্রেতা-বিক্রেতা, কলেজের ছাত্রছাত্রী, আপিসের লোকজন, স্থানীয় বাসিন্দা সকলের যাতায়াত। দৌড়ে চলা মৃত মুখের সারির মাঝে এক ঝাঁক নবীন প্রাণ এই ছাত্রছাত্রীগুলো, জীবনের দৌড় এখনও যাদের সেভাবে ছুঁতে পারেনি।
বিরক্ত হয় লোকটা। ফাঁক খোঁজে। একটু জায়গা পেলেই ঠিক ওদের সাইড করে চেপে বেড়িয়ে যাবে। কিন্তু সারদারাও নজর রেখেছে, কিছুতেই ফাঁক দেয়না। গলিটি একজায়গায় দুভাগ হয়েছে। সেখানে পৌঁছতেই লোকটা ছোট্ট একটি লাফে ওদের পেরিয়ে এগিয়ে গেলো। হৈহৈ করে উঠল ওরা। “আরে, আরে, ও কাকু… এটা কেমন হল?” বলতে বলতে তারা দৌড়তে থাকে কুলিটির পেছনে। বই-এর ব্যাগ দুহাতে মাথার ওপর তোলা, যাতে অন্য পথচারির সাথে ধাক্কা না খায়। কুলিটির মুখেও তখন বিরক্তি ভুলে মুচকি হাসি। ওরা ধরে ফেলার আগেই সে ঢুকে পড়ে আরও একটি গলিতে। ব্যাগ নামিয়ে হতাশ হয়ে হাত ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা কিছুক্ষন। তারপর গলা তুলে বলে, “আচ্ছা কাকু, কাল আবার দেখা হবে। কাল আমরাই জিতব, দেখো।“
হালকা পায়ে, যেন মেঘের ওপর ভর করেই হাসি গল্পে ভেসে বড় রাস্তায় পৌঁছে যায় ওরা। পথ এখানে এসে ভাগ হয়ে যায়। একদল দাঁড়িয়ে পড়ে বাসের প্রতীক্ষায়। আরেকদল পায়ে পায়ে ষ্টেশনের দিকে এগোয়। ষ্টেশন পৌঁছে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তারাও। কেউ যাবে শহরের উত্তর প্রান্তে, কেউবা দক্ষিনে, কেউ হয়ত আরও দূরে যাবে। আমাদের গল্পের মেয়েটি, সারদা, ট্রেন যাত্রী। আরও কয়েকজনের সাথে সে ও প্ল্যাটফর্মে ঢোকে, রানিং এল ই ডি বোর্ডে চোখ বোলায়, ট্রেন দিল কি প্ল্যাটফর্মে?
বন্ধুরা একে একে বিদায় নিতে থাকে। সারদাও নিজস্ব গন্তব্যের নির্দিষ্ট ট্রেনটির দিকে এগিয়ে চলে ধীর পায়ে। পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় এক ব্যাস্তসমস্ত মানুষ। সারদা সরে জায়গা করে দেয়। একটু আগের সেই লঘু চাপল্য সরে গিয়ে এখন তার চোখদুটি ক্লান্ত। ক্লান্তি জড়িয়েছে তার চলার ছন্দেও। একটু যেন সাবধানী, হিসেবী অথচ একইসাথে অমনোযোগী, উদাসীন।
ট্রেনের দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে পরে সারদা। বসার জায়গা নেই। ইচ্ছেও নেই। মাত্র তো কয়েকটা ষ্টেশন, দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাবে। একটা একটা করে ষ্টেশন পার হয়ে ট্রেন যখন শহর পেরিয়ে মফঃস্বলে ঢুকে পরে, সবুজ বেড়ে যায়। সবুজ সবুজ গন্ধ ভাসে হাওয়ায়। চোখ বন্ধ করে থাকলেও তফাতটা বোঝা যায় স্পষ্ট।
ট্রেনে আসতে আসতে পায়ের তলার মেঘগুলো রোজই যেন লোহার মত ভারী হয়ে যায়। একসময় সেগুলো শিকলের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে দুই পা। ট্রেন থেকে নামতেই সে ভার টের পায় সারদা। রোজই। ভার টেনে টেনেই ডাইনে বাঁয়ে দেখে খোয়া ভরা রেল লাইন পার হয় সাবধানে।
লাইন পার হয়ে ছোট্ট বাজার। গুটিকয় দড়মার দোকান। শাকসবজি, মাছের গামলা, মুরগির খাঁচা, পাশে বঁটি নিয়ে বসে থাকা দশাসই মানুষটি মাছি তাড়ায়। রোল-চাউমিনের ঠেলা একটা। চাটুতে খুন্তিতে আওয়াজ ওঠে ঠং ঠং। পায়ে পায়ে পার হয়ে চলে সারদা। ডাইনে নরেন ঠাকুরের মিষ্টির দোকানে কাঁচের বাক্সে পাতিলেবুর সাইজের রসগোল্লা, পাঁচ টাকা পিস। শাঁখ সন্দেশ, দানাদার, লাল লাল ছানার গজা। ছোপ ধরা কাঁচের বাক্সে মাছি ভনভনায়। বাক্সের পেছনে বসে নরেন ঠাকুর কাঁধের গামছা দিয়ে মাছি তাড়ায়, মুখ মোছে। ঘাড় উঁচু করে দেখে, ঘোষেদের বাড়ির মেয়েটা না? কেমন হাড় জিড়জিড়ে চেহারা হয়েছে দেখো! আহা, বাপ মা মরা মেয়ে, দেখার কেউ নেই তো তেমন। মরেনি, বেঁচে আছে, তাই বড় হচ্ছে। বেচারা…
“ভালো তো, মা?” গলা তুলে বলে নরেন ঠাকুর।
“হ্যাঁ কাকা, ভালো।“ ঘাড় নাড়ে সারদা। ম্যাড়ম্যাড়ে হলদে আলোয় চকচক করে তার ঘামে ভেজা মুখ। কোনরকমে উত্তর দিয়েই দ্রুত পায়ে পার হয়ে যায় দোকান। ও জানে এখন নরেন ঠাকুর কী ভাবছে। স্পষ্ট করেই জানে। ভালো লাগে না এসব ওর। ওর বয়সী আরও তো কত মেয়ে আছে এই তল্লাটে। কই, তাদের তো ডেকে ডেকে সবাই এতো কথা বলে না। কুশল জিজ্ঞাসাও করে না। তাহলে ওকে কেন? এও কি একরকমের করুণা করা নয়? কে চেয়েছে করুণা? খারাপ লাগে সারদার। মনটা আরও যেন ভারী হয়ে আসে ওর। মুখ নামিয়ে নেয় আরও, যাতে কারোর চোখে চোখ না পড়ে, কেউ ডাকলেও যাতে না শুনতে হয়। আনমনা উদাসীনতার মুখোশটুকু ঝুলিয়ে হাঁটতে থাকে আপনমনে। একাই ভালো, একাই ভালো।
বাজার শেষ হয়েও হয়না। সরু রাস্তার দুপাশে সারি সারি দোকান। ফটিক দর্জি আপনমনে কাজ করে। সাবানের পাতলা টুকরো দিয়ে কাপড়ে দাগ দেয়। ধারালো কাঁচি দিয়ে কেটে ফেলে এক নিমেষে। শ্যামল মুচির দোকানের সামনে আসতেই সেদিকে চোখ চলে যায় নিজের অজান্তেই। দড়মার দেয়ালে পেড়েকে টাঙ্গানো কিছু নতুন জুতো, চপ্পল। শ্যামল জুতো সারায় আবার তৈরিও করে। সারদা নিজের পায়ের দিকে তাকায়। নকল চামড়ার ওপরের ছাল উঠে সাদাটে ছোপ এখানে সেখানে। স্ট্র্যাপগুলোও ছিঁড়ে ছিঁড়ে আসছে। পুজোর এখনও ঢের দেরী। এখনই জুতোর জন্য টাকা চাইলে কাকিমা দেবে না, রাগ করবে। কিন্তু যেমনই হোক, কাজ চালানোর মত একটা চপ্পল এখনই দরকার। এটা যে কোন দিন ছিঁড়ে যাবে। কত দাম হবে চপ্পলের? বাড়িতে বই-এর ভাঁজে কিছু জমানো আছে, তাতে কুলোবে কি? ভাবতে ভাবতেই ওদিকে মনিহারির দোকান। ওখানে গল্পের বই রাখে কিছু। সামনেই কাঁচের ভেতর সাজিয়ে রাখা। সেদিকে আড় চোখে একবার তাকিয়েই আবার চোখ নামিয়ে নেয় মাটিতে। দোকানি চেনা লোক, এই ছোট মফঃস্বলে সবাই সবাইকে চেনে, যদি ওখান থেকেও কেউ কথা বলে, জানতে চায় কেমন আছে সে! আবারও সেই করুণা মাখা চোখ দেখতে হবে। না, কিছুতেই না।
দোকান বাজার শেষ হয়ে আসে এক সময়। চৌমাথায় মোড় ঘুরতেই পাকা রাস্তা শেষ হয়ে কাঁচা রাস্তা শুরু। দূরে দূরে ল্যাম্পপোস্ট, হলুদ আলো। সরু কালো রাস্তা বিচ্ছিন্ন কিছু হলুদ আলোর বৃত্ত নিয়ে আধো অন্ধকারে শুয়ে আছে নিঝুম। মাঝে মাঝে এক আধটা বাড়ির খোলা জানলা গলে বেরিয়ে আসা চৌকো কিছু আলো। লোকজন নেই বিশেষ। ওই মাঝে মাঝে এক দুজন, ব্যস। নির্জন আলোআঁধারিতে খানিক স্বস্তি পায় সারদা। কিন্তু তখনই যত স্মৃতিরা জেগে ওঠে। পায়ের শিকলটা আবারও ভারী হতে শুরু করে ক্রমশ। মাথা ঝুলে পরে আরও। গতি আরও শ্লথ হয়।
পুরুষটির একটি ছবি আছে, স্পষ্ট। নারীটির ছবি একটু ধূসর। আছে ছোট আলমারি ভরা কিছু বই, আর লাল চামড়ায় বাঁধানো কয়েকটা ডায়েরি। একটা থমকে যাওয়া ঘড়ি। আর একটা সাদা টেবিল ক্লথের অসমাপ্ত এমব্রয়ডারি – সবুজ পাতার ফাঁকে গোলাপি ফুল। কিছুটা সেলাই করা, বাকিটা পেন্সিলে আঁকা। যেন কেউ এখুনি রঙ্গিন সুতোর বাক্সটা নিয়ে এসে বসবে, শেষ করবে বাকিটুকু। তারপর পরম যত্নে পেতে দেবে পালিশ করা মেহগনি কাঠের টেবলটায়। একপাশে তার কয়েকটি বই, পেন স্ট্যান্ড, চাবি ঘোরানো টেবল ঘড়ি, রুপোর গেলাশে ঢাকা দেওয়া জল।
‘সেসব এখন কোথায় রে? কী হল সেগুলোর?’ – ধূসর ছবির নারীটির গলায় জিজ্ঞাসা।
কখন যেন পাশে পাশে হাঁটতে শুরু করেছে এসে, অন্ধকারে খেয়াল করেনি সারদা। প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে জংলা ছাপ সিল্কের শাড়ি পরেছে নারীটি। কপালে ছোট্ট টিপ, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। এক ঝলক সেদিকে দেখে সারদা উত্তর দেয়, ‘কাকিমা তুলে রেখেছে নিজের কাছে। রূপোর গেলাশে নাকি রোজ রোজ কেউ জল খায় না। টেবল ক্লথটা ফেলে দিয়েছিল। আমি এনে রেখেছি, বাক্সে আছে।‘
আর টেবলটা?
আছে ওদের ঘরে। এখন তো ওই ঘরে ওরা থাকে।
কিন্তু ওগুলো যে তোর!
আমাকে যে ওরা দুবেলা খেতে দেয়। জামা, বই, লেখাপড়ার খরচ…
নীরবতা নেমে আসে তারপর। আড়চোখে সারদা দেখে নারীকে। বিষাদ মাখা সে মুখ যেন অভিমানে আবছা হতে হতে মলিয়ে যাচ্ছে প্রায়। ম্লান হাসি খেলে যায় সারদার মুখে।
ছুটিছাটার দিনে সামনের গোল বারান্দায় পুরুষটি বসে থাকত আরামকেদারায়। বাচ্চা মেয়েটি গায়ে মাথায় উঠে খেলত। বায়না জুড়ত এটা সেটা। হাসি মুখে সে বায়না সামাল দিত পুরুষটি। গল্প শোনাত দেশ বিদেশের। কবিতাও। ওই বারান্দাতেই শেষ বারের মত শুয়ে ছিল সেই পুরুষ ও নারীটি। পাশাপাশি। দরজার আড়ালে বোকা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাচ্চাটি। কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে ভয় পেয়েছিল হয়ত। প্রতিবেশী কেউ একজন কোলে তুলে নিয়েছিল তাকে, বারান্দায় শুয়ে থাকা পুরুষ ও নারীটির পা ছুঁইয়ে প্রণাম করিয়ে এনেছিল। সময়ের প্রলেপে সে প্রতিবেশীর মুখ এখন ঝাপসা। ম্যাটাডোরে করে নিয়ে গিয়েছিল ওদের, ওই যারা বারান্দায় শুয়েছিল, সেই নারী ও পুরুষটিকে। লোকজন যারা এসেছিল একে একে বিদায় নিল সকলে। রয়ে গেল শুধু কিছু হাসি গান আর গল্পস্মৃতি। জড়িয়ে রইল ডায়েরির পাতায়, মোটা মোটা বই-এর ভাঁজে, রূপোর গেলাসে, ভিক্টোরিয়ান টেবল আর অসমাপ্ত টেবিলক্লথে, লাল গোল বারান্দায়। আর রয়ে গেল বাচ্চা মেয়েটা, তার কাকা কাকিমার সংসারে।
থমকে থাকা মুহূর্তেরা জমতে জমতে পাহাড় হয়। দেওয়াল তোলে চারপাশে। নিকষ কালো দেওয়ালগুলি প্রতি মুহূর্তে আরও একটু দূরত্ব কমিয়ে আনতে থাকে। ঘেঁষাঘেঁষি করে কাছে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার গ্রাস করতে থাকে সময়, অস্তিত্ব। প্রাণবায়ু কমে আসে ক্রমে। থমকে থাকা বাতাসে ভেসে থাকে মৃত্যুগন্ধ। ক্লান্ত অসহায়তা বুকে হাঁটু চেপে প্রহর গোনে চুপচাপ।
বাড়ি এখনও বেশ খানিকটা দূর। হাঁটতে ভালোই লাগে সারদার। এভাবেই যদি হেঁটে চলা যেত অনন্তকাল, বাড়ি যদি পৌঁছতেই না পারি, মন্দ কী? নাহয় রইল না বাড়ি। নাহয় আমি পথেই রইলাম। নাহয় আমি ভবঘুরেই হলাম… ইচ্ছেগুলোকে লোফালুফি করতে করতে সারদা পেরোতে থাকে মফঃস্বলের প্রত্যন্ত গলি।
এসব দিকে এখনও কোন কোন বাড়িতে উনুনে আঁচ পরে। ঘুঁটে পোড়া গন্ধ জড়িয়ে থাকে বাতাসে। এই বাড়িতে কেউ একজন ডালে ফোড়ন দিলে ও বাড়ি থেকে দুতিনটে হাঁচির শব্দ শোনা যায়। মাঠের পাশে ছোট একতলা বাড়িটার অল্পবয়সী বৌটি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভেতর থেকে খনখনে গলায় ডেকে ওঠে এক বুড়ি, “নগেন বাড়ি আইল নি, অ বৌ? দরজা খুলিস ক্যান?” বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ায় বৌটি। জবাব দেয় না।
রাস্তা যেখানে দুভাগ হল, মোড়ের বাড়িটিতে জানলার পাশে বসে গলা সাধে এক কচি গলার দুই বিনুনি। সুরে ভুল হয়, শুধরে নিয়ে আবার গায়। ক্লান্ত পায়ে চলতে চলতেই সারদা ধরে ফেলে সুরের ভুলটুকু। গুনগুনিয়ে শুদ্ধ সুরটি লাগায় সে। ঠিকঠাক সুর লাগতেই মনে হালকা খুসির ছোঁয়া। একসময় অল্প কিছুদিন গান শিখেছিল সে। অনাথের পক্ষে শখ যতদিন মানায় ততদিন।
পায়ে পায়ে গলি পেরোয় পরপর। টুকরো স্মৃতি লোফালুফি করতে করতেই একসময় দূর থেকে বাড়ির আলো দেখতে পায়। এত তাড়াতাড়ি পথ ফুরিয়ে গেল? লোহার শিকল যেন শিকড় চাড়িয়ে দিয়েছে পথের মাটিতে। পা ওঠে না আর। উল্টো পথ টানতে থাকে সমানে। যাওয়া যায়না? উল্টো পথে আবার স্টেশনের দিকে যাওয়া যায়না? যে কোন একটা ট্রেনে উঠে পড়তে পারে না? যদি এই মুহূর্তে বাড়ি না ফেরে, যদি একেবারে হারিয়ে যায়, যদি আর ফিরতে না হয় এখানে কেমন হয়? পথের জীবন কত আর খারাপ হবে? মৃত্যুই যদি আসে, আসুক নাহয়। কার কী আসে যাবে? কে খোঁজ নেবে? এখনও কী বেঁচে আছে সে?
ভাবতে ভাবতেই সারদার চোখ চলে যায় রাস্তার পাশে গ্রিল ঘেরা ছোট্ট সেই বারান্দাটিতে, যেখানে ছেলেটি বসে আছে ঠায়, যেমন থাকে রোজই। হাতের ফোনে খুটুর খাটুর, নীলচে সাদা আলো তার মুখে। সে বসে থাকে ঘামে ভেজা একটি মুখের অপেক্ষায়, বিষণ্ণতা জড়িয়ে থাকা গভীর দুটি চোখে চোখ রাখার অপেক্ষায়। শুধু তারই জন্য সে মোবাইলে মনের মত গান খোঁজে।
সারদাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ায় সে, এগিয়ে আসে বারান্দার কিনারে। তার উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়ে মেয়েটির চোখেও। দু মিনিট তারা দাঁড়ায় সেখানে। বিষণ্ণতারা ছুটি নেয়। লোহার শিকলগুলো আলগা হয়ে কখন যেন খসে পরে। ভুল ট্রেনে উঠে হারিয়ে যাওয়া ইচ্ছেগুলো স্থগিত হয়ে যায় আপাতত।
মফঃস্বলের সরু গলির অন্ধকারে এভাবেই চুপিসারে জন্ম নেয় এক রূপকথা।
মোবাইলে তখন বেজে ওঠে প্রিয় গান “তুম আয়ে তো আয়া মুঝে ইয়াদ, গলিমে আজ চান্দ নিকলা…”