• Uncategorized
  • 0

ছোটগল্পে গৌতম বাড়ই

এও এক কঙ্কাল কাহিনী

(এ গল্প কিছুটা সত্যের ওপর ভিত্তি করে)

এ সেই পঁচিশ বছর আগের কথা।এখনো মনে পড়লে ভয়ে হিম হয়ে আসে এ শরীর। পঁচিশ বছর আগে তার কথা মনে পড়লে ভীষণ কষ্ট হয় এ মনে।
সবে ঘুমোনোর চেষ্টা করছি হস্টেলের ঘরে আমার রুমে এমন সময় খটখটে হাতে মাথায় টোকা— বলি আপনি কি ঘুমিয়ে পড়লেন?
আমার মুখ দিয়ে বেরুলো শুধু অ! কে আপ নি?
হালকা আলো জ্বলছিলো ঘরে সেই মশারির আবছায়াতে দূরে দেখলাম কোণে রাখা কঙ্কালটি নেই।তার আগে অতি বীরত্ব দেখিয়েছিলাম।রাতে ঘরে শুতে এসে খালি এপাশ ওপাশ করে কখন যে ঘুমিয়েছি ঠিক নেই।তারপর এই খটখটে হাতের আঙুলের টোকা দিয়ে কথা বলা।রাত কত কে জানে? বালিশের তলা থেকে তখনকার সেই রেডিয়াম লাগানো এইচ এমটি হাত ঘড়িতে চকিতে দেখলাম, মনে হলো রাত তিনটে মতন।
বাণীপুর পিজিবিটির ছাত্রছাত্রী আমরা তখন।উত্তর চব্বিশ পরগণার এই পিজিবিটি কলেজটি অনেক পুরোনো।সেইসময় শীতকালে বাণীপুর লোকসংস্কৃতি উৎসবে আশপাশের মানুষের উৎসাহ আর উদ্দীপনার তুমুল আগ্রহে এক বিরাট মেলার রূপ পেত। যাত্রাপালা গান টেরাকোটা মাটির পুতুল মিষ্টি কত কী।তো আমরা পিজিবিটির ছাত্রছাত্রীরা সেখানে নাটক মঞ্চস্থ করবো মনোজ মিত্রের ‘সত্যি ভূতের গপ্পো’।তাতে স্বর্গের দরজা আর নরকের দরজা দুটো আলাদা দরজা ছিলো।নরকের দরজাটা ভয়ংকর দেখাতে কঙ্কাল এনেছিলাম কলেজের বায়োল্যাব থেকে খুব দায়িত্ব সহকারে।তাতে থাকবে আলোর চমকপ্রদ ব্যবহার।
নাটক শেষ।কঙ্কাল সাথে ফিরলাম রাতে।ঐ রাতে তো আর ল্যাবে রাখা যাবে না,একজন কারো রুমে রাখতে হবে।সকালে গিয়ে ল্যাবে রেখে আসবো।সবাই এড়িয়ে গেল,কেউ আর নিজের রুমে রাখতে চায়না কঙ্কালটি আর আমরা জানতাম এটা একটি নারীদেহের কঙ্কাল।সত্যিমিথ্যে জানিনা। সহপাঠীদের ভীতুর ডিম এইসব বলে ব্যাঙ্গ করে তারপর বীরপুরুষ ভাব দেখিয়ে নিজের রুমে নিয়ে এসে রাখলাম কঙ্কালটি। আবার ঐ কঙ্কালের দায়িত্ব আবার আমার কাঁধেই দেওয়া।উপায় নেই।বাণীপুরের সেই পিজিবিটি হস্টেল তখন গাছগাছড়ায় ভর্তি,গা ছমছম করা ভৌতিক পরিবেশ, এমনিতেই রাত হলেই হয়ে উঠতো।রুমমেট নুদরত ও নেই। বীরভূমের বাড়িতে গেছে।ঘরের এককোণে কঙ্কালটি রেখে ভালো করে মশারি গুঁজে শুয়েছি কিন্তু ঘুম আসছে না।বারবার চোখ ঘরের ঐ কোণে যাচ্ছে।এপাশ ওপাশ করছি।ভাবছি কঙ্কালটি যদি কোন মহিলার হয়,তাহলে তিনি কে ছিলেন?কত রূপসী ছিলেন?কিভাবে মারা গেলেন?অপঘাতে নয়তো? এইসব ভাবছি আর ভয় ধরলো মনে বেশ করে। বীরপুরুষের বীরত্ব চুপসে গিয়েছিলো,ঘুম আসছে না।কখন যে ঘুমিয়েছি তা জানিনা।ঘুম ভাঙ্গলো হাড়ের স্পর্শ পেয়ে।শুকনো খটখটে আঙুলের।
সেই জেনানা কঙ্কালটি আমার মশারির বাইরে দাঁড়িয়ে।আমি মশারির ভেতর বসে আরো ভালো করে দেখবার চেষ্টা করছি।অবিকল মানুষের ভঙ্গীমায় তার কাঠামো মাথা নিচু করে মানে করোটি হেলিয়ে আমায় বলছে— অনেক অনেক প্রশস্ত রাত গিয়েছে কাউকে দুটো মনের কথা বলবো পাইনি।আজ যখন তোমায় একা পেয়েছি আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে।ভয় পেয়োনা।আমি দুটো কথা বলেই চলে যাবো।আমার এই কথা আজ পঁচিশ বছর ব্যথা হয়ে জমে আছে বুকে।কাউকে পায়নি নিভৃতে,আজ আমার সেই ব্যথা কথা ব্যক্ত করবার দিন।তবে শোনো–
আমি দেখলাম মশারির ভেতর থেকে দুটো গোলগোল চোখের গোল্লা আমার দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয়।
আমি ছিলাম ফরিদপুরের মাদারীপুরের তরুবালা সরকার।সালটা ১৯৭১, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে।একদিন কি হলো খানসেনা আর রাজাকার বাহিনী সারাদেশে লুটতরাজ ধর্ষণ বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সন্ত্রাস চালাচ্ছে।সন্ত্রাসীদের প্রথম লক্ষ্য থাকে নিরীহ নারী আর শিশু।আর নারীদেহ ভোগের এই সুবিধা সন্ত্রাসীরা ছাড়ে না।আমরা দলবেঁধে পুব পাকিস্তান থেকে ভিটে মাটি ঘটি ছেড়ে লাখো লাখো না খেয়ে বুভুক্ষু তৃষ্ণার্ত সবাই রাতের অন্ধকারে ভারতবর্ষে হেঁটে চলেছি।শুধু পৃথিবীতে বেঁচে থাকবার আশায়।আমরা শরণার্থী হয়ে গেলাম রাষ্ট্রের নিদারুণ উপহাসে।তরুবালা সরকার আমি, মাদারীপুরের কলেজে পড়বার সময় অধ্যাপক ছাত্রছাত্রী একবার সবাই আমার দিকে না তাকিয়ে পারতো না।কলেজে না গেলে দুদিন পর জিগ্গেস করতো কি ভালো তো? কি হয়েছিলো আপনার?
তরুবালা বলেই চলেছে আমি তন্ময় হয়ে শুনছি।
হেঁটে চলেছি ওদের চোখ ফাঁকি দিয়ে।পেট্রাপোল বর্ডার নাকি শুনলাম আজ ভোরের দিকে আমরা পেয়ে যাবো।তাহলে কাল ভারতের নিরাপদ আশ্রয়ে।সেই ভয়ার্ত রাতের কালো অন্ধকারে হঠাৎ বেশ শক্তিশালী তিনচারটে জওয়ান, খানসেনা আমায় ঝটপড়তি সেই শরণার্থীর দঙ্গল থেকে তুলে নিয়ে গেলো হাত পা মুখ চেপে ধরে।ভীষণ শারীরিক অত্যাচার চললো।ধর্ষিত হতে হতে একসময় জ্ঞান হারালাম।তারপর বুকে পিঠে অসম্ভব খোঁচা।বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে আমাকে মেরে ফেলে দেয় নর্দমায়।তবু মেয়েছেলের জান বলে বেঁচে ছিলাম।পেছনের কোন এক শরণার্থী দলের কেউ একজন নর্দমার ভেতর থেকে গোঙানীর আওয়াজ পেয়ে আমায় কাঁধে তুলে আবার হাঁটতে থাকে ভারতের দিকে।ভারতে এসেও একবেলা বেঁচে ছিলাম।তারপর যশোরের ঐ শরণার্থীর দল আমাকে মাটি চাপা দেয়।কবর দেয়।সেখান থেকে কঙ্কাল হয়ে এই তোমাদের বাণীপুর কলেজের বায়োল্যাবে।
আমার ভয় কখন উবে গিয়েছে‌‌।গল্প শুনতে শুনতে জিগ্গেস করি সেই শ্রীমতি তরুবালা কঙ্কালকে।সবই তো শুনলাম, খুব খুব দুঃখের করুণ কাহিনী।এ তোমার সাথে আরও লাখো জনের দুঃখের কাহিনীর মিল।তোমার বিশেষ আরও কোন দুঃখ আছে?
তরুবালা বললেন-আছে বলেই সেটা শেষে জানাচ্ছি এবং তোমায় একটা দায়িত্ব ও দেবো।
এবারে আমি আরও টানটান হয়ে বসলাম।একজন শ্রীমতি কঙ্কাল আমায় দায়িত্ব দিচ্ছে বুঝুন রাতের অন্ধকারে। কানপেতে রইলাম মশারির বাইরের শব্দের আশায়।
আমার একজন বিশেষ কেউ ছিলো।কলেজের তরুণ অধ্যাপক সমীর।সে শুনেছি বীরভূমের নলহাটিতে থাকে।তোমার রুমমেট ও বীরভূম থাকে‌,তাকে দিয়ে সমীরের কোন খোঁজ আনতে পারো,অধ্যাপনা শেষে সে ওখানে বাড়ি করে গাছপালা বাগান আর সাহিত্য নিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে মেতে আছে।সমীর বিশ্বাস,মনে থাকবে।
ভোরের আলো ফুটে আসছে।কাঁচের জানালায় তার আভাস।আরও একবার শুনতে পেলাম, কি মনে থাকবে তো!
আমি খুব ধীরে ধীরে বললাম সে তো তুমি ওখানে গিয়ে নিজেই নিয়ে আসতে পারো।তুমি তো কঙ্কাল!
সে করুণ স্বরে বললো— নিজে খোঁজ খবর আনতে পারলে তোমায় আর বলবো কেন?আমি তো বেশি দূর যেতে পারি না।সমীরের কথা খুব মনে পড়ে।তাই।
ভোরের আবছা আলোয় দেখলাম শ্রীমতি কঙ্কাল ঘরের সেই কোণে একদম দাঁড়িয়ে ঠিকঠাক।আমি বিছানা ছেড়ে ঘরের মেঝেয় এলাম।সেই আলোতে তাকিয়ে আছি তার দিকে।কত ব্যথা কত কষ্ট জমা হয়ে থাকে তাহলে দুনিয়ার সব কঙ্কালের বুকে। কিছুমাত্র লোক পৃথিবীটা ভোগ করে তাদের নিজেদের ক্ষমতার জোরে অথচ আম নাগরিক হাজারটা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে চলে ভেক সভ্যতার হাত ধরে।হাজার হাজার বছর ধরে এই চলে আসছে।এই চলতে থাকবে।শ্রীমতি কঙ্কালের গর্ত কোটর চোখেও কি জলের ধারা শুকিয়ে আছে।আমার চোখ বোধহয় একটু ভিজে এল এই শীত ভোরে।
রবি ঠাকুরের কঙ্কাল গল্পটি পড়তে গেলেই আমিও আমার পঁচিশ বছর আগের বাণীপুর পিজিবিটি হস্টেলের সেই রাতে ফিরে যাই বারবার‌ আর জীবন্ত হয়ে ওঠে সেই রাতটি।শ্রীমতি তরুবালা এখনো অবচেতনে আমার সাথে রাতদুপুরে মাঝেমাঝে কথা বলে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *