রমেশ বাবু এ বিয়েতে মত দিতে গররাজি, কিছুতেই না; তাঁকে নিজের মেয়ের বিয়েতে অনেক গহনা,নগদ-টাকাও দিতে হয়েছে।সে সব ঋন শোধ করতে তাঁর কত বছর লেগেছে,কেউ খোঁজ নিয়েছে? না,বলে তিনি দোতলায় উঠে গেলেন।
“বাবা, তুমি তো জানো,এখন দেশের আইনে যৌতুক দেওয়া বা নেওয়া আইনতঃ দণ্ডনীয়”,বলে সকাল থেকে রঞ্জন তার বাবাকে বোঝাবার চেষ্টা করেছে।
রঞ্জনের মা,মালতী দেবী,ছেলের মাথায় ও গালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন”বাবা,উনি যে কথাটা বলেছেন একটু চিন্তা কর,কত টাকা খরচ হয়েছে তোমার দিদির বিয়েতে, তোমার পড়ার খরচ মেটাতে লোকটা কোন সখ-আহ্লাদ মেটাতে পারেনি;যদি সে টাকার কিছুটা তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে দাবী করে থাকে, তো আমি কোন অন্যায় দেখি না। আইন তো তোমার দিদির বিয়ের সময়ও ছিল। কীভাবে ঘুরিয়ে, পেঁচিয়ে সব আদায় করেছে, তুমি তো সঙ্গে থেকে বাজার করেছো,সব জানো।যাক্, তোমার বাবা যা বলেছে, তোমার ভাবী শ্বশুরকে তাই বোলো,এটা এমন কিছু নয়;এটা না হ’লে আমাদের মান-সম্মান থাকবে না আত্মীয়-স্বজনের কাছে;তারা বলবে, ভট্টাচার্য-মশাই কোন হা-ঘর থেকে ছেলের বৌ এনেছে।
রঞ্জন আর সীমার ভালোবাসা সেই কোন যুগ থেকে। রঞ্জন,ছাত্র হিসেবে খুবই ভালো। তাই সীমার বাবা, ধনঞ্জয় চক্রবর্তী, তাঁর মেয়ে সীমাকে একটু-আধটু অঙ্ক ও ইংরেজি দেখিয়ে দেবার অনুরোধ ক’রলে সে না বলতে পারেনি।সীমা তখন ক্লাস নাইনের ছাত্রী,আর রঞ্জন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।সীমারা একই পাড়ার বাসিন্দা হ’লেও তাদের সঙ্গে এর আগে ভট্টাচার্য-পরিবারের কোন ঘনিষ্টতা ঘটার সুযোগ হয়নি।কলেজ থেকে ফিরে বিকালে সীমাকে পড়াতে গিয়ে জলযোগটা ওখানেই সে সেরেছে বহুদিন।তারপর, কলেজের পাট চুকিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সে বোম্বাই আই-আই-টিতে ভর্তি হয়েছে।যোগাযোগটা বিভিন্ন-ভাবে রয়েই গেছে;সীমাও এদিকে স্কুলের গণ্ডী টপকিয়ে কলেজের পড়া শেষ করেছে: ছুটিতে বাড়ি এলে সীমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন থাকতোই। কিছুদিন অদেখার জন্যই হয়তো তাদের সম্পর্ক টা আরও গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে।
দেনা-পাওনার ফর্দটা শুনে ধনঞ্জয় বাবু একটু আশাহত হলেও ইঞ্জিনিয়ার সু-পাত্র হাত-ছাড়া করতে চাননি বা মেয়েকে সুখী দেখার উদগ্র বাসনায় দাবী ও যথাসাধ্য পূর্ণ করেছেন, কিন্তু ভট্টাচার্য’র বিরাট “হাঁ” বন্ধ করা তাঁর সাধ্যাতীত ছিল।
ক্ষুন্ন হলেও পুত্রের পীড়া-পীড়িতে দুই পরিবারের মধ্যে অখুশি-জনিত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।সীমা যথাসাধ্য শাশুড়ি ও ননদের মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ভট্টাচার্য দের মনের জোগান-পূরণ সীমার অসাধ্য থেকেছে।ফল-স্বরূপ জুটেছে হা-ঘরের মেয়ের
অপবাদ,কথায়,কথায় বাক্যজ্বালা।
অসহ্য হ’লেও সীমা, অসীম শক্তিতে রঞ্জনের মুখ চেয়ে তা সহ্য করে এসেছে।পুত্র, ভালোবেসে বিয়ে করেছে,এটা আর কিছু নয়, চক্রবর্তীরা ফাঁ দ পেতে তাদের ভোলে-ভোলা ছেলেকে ফাঁদে ফেলেছে ইত্যাদি,ইত্যাদি,যত রকম বাক্য-বানে জর্জরিত করা যায় আর কী!
রঞ্জন, একমাত্র পুত্রসন্তান, না পারছে বাবা-মাকে বোঝাতে,না পারছে সীমার মানসিক যন্ত্রনার জ্বালা প্রসমিত করতে,তার অবস্থা বেকারীর-গামলায় ময়দার তালের মত,যে পারছে একবার করে দলে
দিচ্ছে।অবসর সময়টুকুর বেশী-ভাগই সে বন্ধু-বান্ধবদের সংঙ্গে কাটায়।সংসারের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করে। সময় তড়তড়িয়ে এগিয়ে চলেছে।
সীমা এখন পুত্র-সন্তানের জননী।নতুন প্রজন্ম আসার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের দাবার পাশাও উল্টাতে আরম্ভ করেছে।দাদু-ঠাম্মাই শিশুর পরিচর্যা করে।নাতি বলতে অজ্ঞান। এদিকে সীমার মানসিক ভারসাম্যের গণ্ডগোলটা সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। কখন যে ঐ অবস্থার সৃষ্টি হবে তা বোঝা দায়।এই দেখা গেল বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছে,হয়তো তার পরই ঘরের জিনিসপত্র ভাঙ্গছে, কখনও, কখনও কাটারি নিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ীর দিকে এগিয়ে আসছে। সীমাকে একমাত্র রঞ্জনই
যা সামলাতে পারে, কিন্তু তারও তো অফিস আছে;কতদিনই বা ছুটি নেওয়া যায়। অফিসে এই ক’দিন আগে একটা ভালো প্রমোশন পেয়েছে, দায়িত্ব টাও বেড়েছে। কোথায় একটু সবাই মিলে আনন্দ করবে,না, ভারসাম্যহীন স্ত্রীকে নিয়ে জেরবার। শহরের প্রায় সব ডাক্তারই একরকম দেখানো হয়েছে; না,কোন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
অফিসের সহকর্মীরা তাকে প্রায় রোজই জিজ্ঞাসা করে”কী কিছু উন্নতি লক্ষ্য করছো”। আচ্ছা,অমুক ডাক্তারের কাছে একবার নিয়ে যাও,যেচে তারা ফোন নং দেয়। রঞ্জন,এক রকম বিধ্বস্ত,কোন কিছুই সে বাকী রাখেনি।এখন ভ্যায়োলেন্টের সময়
সীমাকে সামলানো দায় হ’য়ে উঠেছে।বাবা-মা,নাতির পরিচর্যায়
থাকে, তাদের মনেও আনন্দ বা সুখ অন্তর্হিত।দিদি আর এ বাড়ি মুখো হয় না।
কোলকাতার মোটামুটি সব মনোবিদ,নার্ভের ডাক্তার দেখানো হয়েছে,অবস্থা পূর্ব-বৎ।শুধু ছেলেকে খাওয়াবার সময়টুকু তাকে স্বাভাবিক দেখায়,সে তো কয়েকঘন্টার জন্য, আবার যে কে সেই।বাবা-মা’র মুখখানা দেখলে রঞ্জনের দুঃখ হয়; একমাত্র ছেলের বৌ”পাগল বা উন্মাদ”।লোকে নানান কথা বলে।আত্মীয়-স্বজনেরা মুখ টিপে হাসে,হিংসায় তারা অপবাদ দিতে ছাড়ে না।তাঁদের অবস্থা রঞ্জনের চেয়ে করুণ। একদিকে উন্মাদ বৌমার উন্মত্ততা অপরদিকে শিশু-নাতির পরিচর্যায় তাঁরা নাজেহাল।
একদিন পাড়ার ই এক শ্রদ্ধেয় প্রবীন বিপদভঞ্জন রায় মহাশয়, রঞ্জনকে ডেকে বললেন,”বাপু হে,
তোমার অবস্থা আমি শুনেছি;তবু বলছি, আমার এক ডাক্তার বন্ধু আছে,দিনে দশটা মাত্র রোগী এখনও দেখে,নার্ভের ডাক্তার, আবার মনোবিদ ও বটে; তুমি একবার তার কাছে যাও।আমি বলে রাখবো। বেড়াতে যাবার নাম ক’রে বৌমাকে নিয়ে যাবে। অনেক তো করলে,একবার শেষ চেষ্টা না হয় ,কর”। রঞ্জন, তাঁকে শ্রদ্ধা করে,বললো,”বেশ, আপনি একটু বলে রাখবেন”।
দিন দেখে রঞ্জন ও সীমা ডাঃ শঙ্কর ব্যানার্জির চেম্বারে গেল;আগেই বিপদভঞ্জনবাবু ব্রিফ করে রেখেছেন।যাওয়া মাত্রই চেম্বারে ডেকে ডাঃ ব্যানার্জি ওদের কাছ থেকে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন। সীমাকে পরীক্ষা করে আগের প্রেসক্রিপশন গুলো ভালো করে দেখে রঞ্জন কে বললেন”তুমি একটু বাহিরে অপেক্ষা কর,আমি সীমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই”। রঞ্জন বাহিরে গেলে ডাঃ ব্যানার্জি, সীমাকে বললেন,”আমি সব রকমভাবে পরীক্ষা করে নিশ্চিত, তুমি সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ এবং প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ গুলো তুমি খাওনি,খেলে তোমার স্থান হোত কোনো পাগলা-গারদে: ওষুধ গুলো তুমি কী করেছো?”সীমা মুচকি হেসে বললো”ওগুলো আমি কমোডে ফেলে ফ্লাশ করে দিতাম”।ডাঃ ব্যানার্জি বললেন,”বুদ্ধি মতী,তা,এদের তো নাস্তানাবুদ করে দিয়েছো,এবার একটু ক্ষান্ত হও”। সীমা রেগে বললো”এরা আমাকে কম জ্বালিয়েছে,আমি সুদ-সমেত এখন তুলছি”।
“তোমার স্বামী তো তোমাকে ভালোবাসে,তবে একে কষ্ট দিচ্ছ কেন,মা,”বললেন ডাঃ ব্যানার্জি।”বেশ,তবে আলাদা হোক্”, উত্তরে সীমা বললো।
ডাঃ ব্যানার্জি, বেল টিপে রঞ্জন কে চেম্বারে আস্তে বললেন। সীমাকে বললেন,”তুমি এবার বাহিরে অপেক্ষা কর,আমি এর সাথে কিছু কথা বলবো”। সীমা বাহিরে গেলে ডাঃব্যানার্জি বললেন”দেখ রঞ্জন, তোমার স্ত্রী ভালো হয়ে যাবে,অসুখ,সেরকম কিছু নয়। আমি এই প্রেসক্রিপশন টা করে দিচ্ছি,যেমন লেখা আছে ঐ রকমই ব্যবস্থা করবে।সব ঠিক হয়ে যাবে।যদি প্রয়োজন মনে কর,বিপদবাবুর সাথে কথা বলে যোগাযোগ করবে,মনে হয় না দরকার হবে”বলে উনি রঞ্জনের হাতে প্রেসক্রিপশন টা ধরিয়ে দিলেন।
রঞ্জন, প্রেসক্রিপশনের দিকে তাকিয়ে দেখলো কতকগুলো অদ্ভুত সাংকেতিক বর্ণ লেখা,sp,he,st.ডাঃব্যানার্জি মুচকি, মুচকি হাসছেন।”বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে,বলেই বললেন,sp-separation,he-hearthএবংst-stoneঅর্থাৎ বাংলায় এক কথায় হাঁ ড়ি-ভাঙ্গা।বাড়ি গিয়ে রান্না ঘর আলাদা করার ব্যবস্থা কর।অসুখ একদম সেরে যাবে”
বাড়ি এসে রঞ্জন সেই ব্যবস্থা করেছে। ভট্টাচার্য্য দের হাঁ ড়ি আলাদা হয়েছে। যোগসূত্র শুধু নাতিটা,সেটার দুঃখেও মা-বাবার করুণ অবস্থা।সীমার মনের ভারসাম্য ফিরে এসেছে।শুধু রঞ্জনের একটু খাটুনি বেড়েছে,দুটো প্যাকেটে বাজার আনতে হচ্ছে। দোতলায়, সীমা ও রঞ্জন ,আর একতলায় মা-বাবা থাকে।বাতের জন্য সিঁড়ি ভাঙ্গার অসুবিধা ভেবেই এই ব্যবস্থা হয়েছে।দু’টো সংসার রঞ্জন কে টানতে হচ্ছে,তা হোক্,সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। হাঁ ড়ি-ভেঙ্গে সংসারে শান্তি এসেছে।