এবার আসি প্রজাপতির কথায়। আমি প্রজাপতির ছবি বিশেষ তুলি না। আসলে তুলতে পারি না বললেই ভালো হয়। খুবই ধৈর্যের কাজ প্রজাপতির ছবি তোলা। অনেক প্রজাপতি আছে যেগুলো সহজেই ছবি তুলতে দেয় কিন্তু অধিকাংশই প্রচণ্ড চঞ্চল এবং ভীতু প্রকৃতির হয়ে থাকে। তবে আমি বিভিন্ন রকম প্রজাপতি দেখেছি উত্তরবঙ্গে থাকতে। বেশ কিছুর ছবিও তুলেছি। সেগুলির সংখ্যা বেশী নয়। আমাদের ক্যাম্পাসেই যেমন অনেক রকমের প্রজাপতি দেখা যায়। প্লেন টাইগার(আফ্রিকান মোনার্ক), স্ট্রাইপড টাইগার, কমন মরমন, ব্লু টাইগার, রেড বেসড এবং রেডস্পট জেজেবেল, ক্যাবেজ হোয়াইট, কমন ফাইভরিং, লাইম বাটারফ্লাই এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্যে কিছুর ছবি আগের পর্বেই দিয়েছিলাম।
উত্তরবঙ্গে থাকতে তিনবার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্প গিয়েছি। একবার বন্ধুদের সাথে, আর একবার সিনিয়রের প্রোজেক্টের কাজে। দ্বিতীয়বার যখন গিয়েছিলাম তখন এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা লাভ করি, যা খুব কম ব্যাক্তিরই হয়ে থাকে। বক্সার কোর অংশে গিয়েছিলাম সেবার। তখনই বুঝেছিলাম যে একটা জঙ্গলের কত ধরনের রূপ হতে পারে। বক্সার ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকমের জঙ্গল দেখেছি। ভুটানের সীমান্তের দিকে গেলে বক্সার ভেতরে দেখা যায় পাহাড়ি গাছের জঙ্গল। এখানে মাটি পাথুরে গোছের। মাটিতে ঘাসও নেই সেভাবে। বনরক্ষী বলছিলেন, বক্সার বাঘগুলো নাকি এদিক দিয়েই যাতায়াত করে থাকে। যদিও বক্সার বাঘ দেখা আর আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়া একই রকম বিরল ব্যাপার। সমতলের দিকে আবার বক্সার ভোল পালটে যায়। এখানে জঙ্গল অত্যন্ত ঘন। বনরক্ষী বলছিলেন যে এসব জঙ্গলে ঘাসের মধ্যে শুয়ে থাকে বড় বড় বার্মিজ অজগর, যারা হরিণও মেরে খেতে পারে। আমি অবশ্য অজগরের দেখা এখানেও পাইনি। তবে প্রজাপতি দেখেছিল প্রচুর। যারা বক্সা-জয়ন্তী গিয়েছেন তারাই জানেন বক্সায় কত রকমের প্রজাপতি দেখা যায়। গাড়িতে থাকার জন্য মাত্র একরকমেরই ভালো ছবি হয়েছিল। এছাড়া দেখেছিলাম মালাবার জায়েন্ট স্কুইরেল এবং বক্সার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, গ্রেট হর্নবিল। তৃতীয়বারের বক্সা দর্শনও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে একটা বিশেষ কারণে। ডিপার্টমেন্টের পিকনিক ছিল সেদিন। তারই সাথে পরের দিন ছিল আমাদের ডিজাইন অফ এক্সপেরিমেন্টসের পরীক্ষা। পিকনিক সেরে, অজস্র ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে ফিরেও পরের দিন পরীক্ষা খারাপ দিইনি; বরং ঐ বিষয়েই সবচেয়ে বেশী মার্কস তুলেছিলাম।
২ বছর হয়ে গেছে আমি উত্তরবঙ্গ ছেড়ে এসেছি। ২০১৬-২০১৮ এই ২ বছর ছিলাম ওখানে। এখন বুঝি, ২ বছর আসলে কম সময় নয়। কিন্তু আমার ছবি তোলার নেশার জন্য হয়তো কমই ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার আগে প্রকৃতি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে আমার সময় শেষ হয়ে আসছে। বিদায় জানানোর আগে তাই উপহার দিয়েছিলেন অনেক। বড় বসন্তবৌরি, লক্ষ্মী প্যাঁচা এবং কালপ্যাঁচার মোটামুটি ভালো ছবি পেয়েছি একদম শেষের দিকেই।
আমার অধিকাংশ ছবিই বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরেই তোলা। ক্যাম্পাসে আমি অনেক রকমের পাখি পেয়েছি। তার মধ্যে ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল, বাঁশপাতি, ব্ল্যাক রেডস্টার্ট, গ্রাসবার্ড বা চাতকের মত পাখি থেকে ইয়েলো ব্রেস্টেড বান্টিং এর মত ক্রিটিক্যালি এনডেঞ্জার্ড পাখিও আছে। সেই ছবিগুলোর কিছু এখানে দেওয়া হল। বাকি ছবির কথা তো আগেই বলেছি; বক্সা টাইগার রিজার্ভ, লাভা নয়তো কাছের সেই জঙ্গলে তোলা। উত্তরবঙ্গে থাকতে আমি একবারই লাভা গিয়েছি। এই ছোট্ট জনপদটি বিভিন্ন পাহাড়ি পাখির জন্য ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারদের মধ্যে বেশ বিখ্যাত। এখানে গিয়ে ব্ল্যাক থ্রোটেড বুশটিট, রুফাস বেলিইড ঈগল জাতীয় বেশ কিছু পাখি পেয়েছিলাম। ভবিষ্যতেও আবার লাভা যাওয়ার পরিকল্পনা আছে আমার।
তবে এর আগে আরেক জায়গার কথা উল্লেখ করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। সেই জায়গাটা হল ভুটান। আমরা যারা উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলাম তাদের অধিকাংশেরই পকেটের রেস্ত বেশী ছিল না, কিন্তু ঘোরার ইচ্ছা ছিল ষোলআনা। তাই আমরা ফাঁক পেলেই চলে যেতাম বিদেশভ্রমণে। মাত্র দুই ঘণ্টার রাস্তা হলে কী হবে, ভুটান তো আসলে বিদেশই নাকি! মুলত ফুন্টশোলিং গিয়েই ঘুরে চলে আসতাম আমরা।এই ফাঁকে বলে রাখি, যারা সোমরস বিলাসী তাদের জন্য ভুটান স্বর্গ বললে অত্যুক্তি হয় না। আমাদের কিছু বন্ধু মুলত এই কারণেই ভুটান যেত। আর আমি যেতাম ছবির আশায়। বলা বাহুল্য, ভুটান গিয়ে আমার বিশেষ কিছুই ছবি হয়নি।
তবে ভুটানে ছবি হয় না এরকম বলা অত্যন্ত অন্যায়। ভুটান তার জীববৈচিত্র্যের জন্য এমনিতেই বিখ্যাত। রয়াল বেঙ্গল টাইগার, রেড পান্ডা, ক্লাউডেড লেপার্ড, হিমালিয়ান ভালুক, ইত্যাদি ভুটানের দক্ষিণ দিকের অরণ্যে পাওয়া যায়। আবার উত্তর ভুটানে স্নো লেপার্ডের অস্তিত্বও টের পাওয়া গিয়েছে। পূর্ব-হিমালয়ে অবস্থিত এই ছোট্ট পরিবেশ সচেতন দেশটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বললে ভুল হয় না। এই দেশটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং শান্তিসূচকে প্রথম দিকেই অবস্থান করে।
আগে ভুটানে যেমন ভোটার কার্ড দেখিয়েই ঢোকা যেত, এখন আর সেরকম ব্যবস্থা নেই। এখন সম্ভবত ভারতীয়দের জন্যও এন্ট্রি ফি চালু হয়েছে। যদিও ভ্রমণবিলাসী বাঙালির কাছে এটা তেমন কোনো বাঁধা নয়। প্রত্যেক পাহাড়প্রেমী ভ্রমণবিলাসীর উচিত অন্তত একবার ভুটান ঘুরে আসা। অত্যন্ত পরিষ্কার এবং সুসভ্য এই দেশটি নিরাশ করবে না।
যাই হোক, স্বল্প পরিসরে অনেকটা লিখে ফেললাম। পাঠককে আর বিব্রত করতে চাই না। আশা করি পাঠক লেখা এবং ছবি উভয়ই উপভোগ করেছেন। আপাতত চিত্রকাহনের উত্তরবঙ্গ পর্ব এখানেই সমাপ্ত হল।
অলমিতি।